ধর্মপ্রাণ ও ধর্মব্যবসায়ী ।। মুসতাক আহমদ

ধর্ম ও দর্শন লাইফ স্টাইল
শেয়ার করুন

ধর্মপ্রাণ বলতে আমরা বুঝি নীতি ও নৈতিকতা সম্পন্ন আদর্শ মানুষ। নৈতিকতা এমন একটা গুণাবলী যা মানুষকে সত্য সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা জোগায়। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব বোধ সৃষ্টিকরে। আর এটিই ধর্মের শিক্ষা। ধর্ম মানুষকে ন্যায়-অন্যায় এবং সুনীতি-দুর্নীতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে সহায়তা করে।

ধর্মের অনুশাসনে জীবন পরিচালিত হলে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়। অবশ্য ধর্মীয় পরিচয় ধারণ করে ধর্মের অপব্যবহারকারী আলাদা, যাদের ধর্মব্যবসায়ী বলা হয়। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাসে এদের কথা রয়েছে। যারা আল্লাহর শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে।

ধর্মের নামে বহু পন্ডিত-পুরোহিত মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায় উপায়ে ভক্ষণ করেছে। মূলত তারা ধর্মীয় পরিচয় ধারণ করতো, কিন্তু ধর্মকে মান্য করতো না। বরং ধর্মকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করতো।

তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সংবাদ দাও। (সুরা তাওবা : ৩৪)

ধর্মের চাহিদা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অন্তর্গত। তাই ধর্মের জন্য চাহিদা সৃষ্টি, উৎপাদন এবং বাজার সৃষ্টি করতে হয় না। তবে বাজার ধরে রাখার জন্য ধর্মের নামে ফেরকা সৃষ্টি করে নতুন নতুন ব্যাখ্যার পাশাপাশি অডিয়েন্স নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়।

পৃথিবীতে আজ যত ধর্ম প্রচলিত আছে তার সবই এখন কমবেশী ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত। এরা মুলত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। ধর্মব্যবসায়ীদের নিকৃষ্ট এই কর্ম সম্পর্কে আজকের দুনিয়ার অধিকাংশ ধর্মভীরু ব্যক্তিই অনবহিত।

কেউ ধর্মের ধ্বজাধরে ধর্মীয় পুস্তকাদির মুখস্ত বিদ্যা আউড়িয়ে অর্থ উপার্জন করছে, কেউ কেউ আবার এটাকে একটি পাবলিক স্পিকিং আর্ট হিসেবে বেঁচে নিয়েছে। দিন দিন নতুন নতুন শৈল্পিক উপস্থাপনায় ওয়াজ নসিহত রিমিক্সিং হয়ে মার্কেটে আসছে। যিনি বক্তৃতায় যত মারমুখি, পরনিন্দায় যত পারদর্শী তার মার্কেট ততই ভালো এবং ফি ততই বেশি। ডিজিটাল যুগের অগণিত গ্লোবাল অডিয়েন্স এবং ভিউয়ার্সের জন্য ধর্মচর্চায় এ যেনো একটি নতুন মাত্রার সংযোজন।

অবস্থাদৃষ্ঠে অনেক সময় মনে হয়, পুরোনো দিনের সংশোধনমূলক ওয়াজ নসিহতের বদলে মাহফিলগুলো যেনো আজ এক স্পিরিচুয়াল বিনোদন, যেখানে আত্ন-সংশোধন বা এর প্রচেষ্টার বিষয়টি অত্যন্ত গৌণ, বক্তার শৈল্পিক মিথ্যাচার এবং নিজের ও দলের জনপ্রিয়তার বিষয়টিই যেনো মুখ্য।

ডিজিটাল ব্লেসিংসের বদৌলতে আপামর জনসাধারণের নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রাণ এবং সত্যিকার জ্ঞান-পিপাসুরা যে কত বিশালভাবে উপকৃত হচ্ছেন সেটি অস্বীকার করার প্রশ্ন তো নয়ই বরং বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ধর্ম-ব্যবসায়ীরাও এর থেকে কম ফায়দা নিচ্ছে না।

মানবতার মুক্তির পথ ইসলাম রূপ লাভ করেছে তথাকথিত মোল্লাতন্ত্রে। সমাজে একটি যুবক আজ যতটা না তার পিতাকে সম্মান করে তার চেয়ে বেশি সম্মান করে কথিত মাওলানা সাহেবকে। যে যুবক নবী করিম (স:) এর অনুকরণে হিলফুল ফুযুল গঠন করে সমাজ-সংসারে বর্তমান পঙ্কিলতা দূর করার প্রয়াস চালাবে, সে আজ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তার হুজুরের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ধর্মব্যবসার বীভৎস রূপ দেখতে পাই যখন দেখি পিতা তার সন্তানকে অভুক্ত রেখে দিনভর উপার্জনের টাকা মাজারের দানবাক্সে ফেলে আসে, মোল্লার কাছ থেকে তাবিজ কিনে আনে অথবা কোন পীর সাহেবকে নজরানা দেয়।

ধর্মব্যবসার ভয়ংকর রূপ দেখে আমি শিউরে উঠি যখন শিশু নির্যাতনের নির্মম ঘটনা অহরহ পত্রিকার হেডলাইন হয়, অবলা নারী ফুটপাথে সন্তান প্রসব করে রক্তাক্ত অবস্থায় সদ্য প্রসূত সন্তানের জীবন রক্ষায় শিয়ালের সাথে রাতের গভীরে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্তিতে বেহুশ হয়ে পড়ে, নিরীহ কোন একটি কুকুর এসে বাচ্চাটিকে রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করে আর ফজরের নামাজ শেষে ধর্মব্যবসায়ীদের কেউ কেউ যখন এই দৃশ্য দেখে মহিলাটিকে ভৎসনা করে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে পড়তে বাসায় ফিরে।

কিন্তু এই সংবাদগুলো কোন তথাকথিত ইসলামিক দল, তথাকথিত পীর সাহেব বা শেখ সাহেবের পক্ষ থেকে আলোচনা এবং প্রতিবাদের বিষয়বস্তু হয়ে উঠে না।

ভেবে অবাক হই, যখন দেখি বক্তা এবং শ্রুতা উভয়েই, ‘যার প্রতিবেশী অভুক্ত ঘুমায় সে মুমিন নয়’ মর্মে রাসূলের হাদিস খানার দারস শুনে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে, কিন্তু পথিমধ্যে কোন এক দশতলা দালান কোঠাসম্পন্ন মনোরম বাসভবনটিতে যেতে যেতে তারই নিচে কোন এক গাছতলায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার হাজার প্রশ্ন রাখা চোখে বুভুক্ষ-হাড্ডিসার অর্ধ-নগ্ন চেহারা দেখে তাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় না, আমরা অনুকম্পা প্রদর্শনে এগিয়ে আসি না।

মনে হয় ইসলামী রাষ্ট্র এবং সমাজ নির্মাণে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত কিন্তু নিজের এলাকা এবং গলিপথটিকে ইসলামের আলোকে সাজাতে আগ্রহ বোধ করিনা। কতইনা অদ্ভুত আমাদের ইসলাম চর্চা।
যখন আলেম সমাজ যার যার মাকাতিব, দল এবং মত প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেন তখন দুর্বল অসহায়দের জন্য মানবতার জন্য নিস্বার্থভাবে কাজ করার মনমানসিকতাসম্পন্ন লোকের আকাল পড়াটাই স্বাভাবিক। এই রকম পরিস্থিতিতে ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মবাণিজ্য জমজমাট রূপ লাভে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ।

ইসলামে যেখানে ধর্মের অনুসারীদের সহাবস্থানের কথা বলা হয়েছে সেখানে এই ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেট উম্মতের ভিতরে দাঙ্গা বাধানোর অপকর্ম এবং অপচেষ্টায় লিপ্ত। আজ আমাদের এবং আমাদের তথাকথিত আলেমদের (ইল্লা মাশাআল্লাহ) কাছে, ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়ার গুরুত্বের চেয়ে নিজ নিজ দল এবং মতের প্রতি দাওয়াতের গুরুত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

আমরা প্রত্যেকে ইসলামের মুবাল্লিগ হওয়ার দাবি করছি, বিশ্বময় মুসলিম ব্রাদারহুড গড়ে তুলার জন্য আহবান জানাচ্ছি, কিন্তু যখনই কেউ কোরান হাদিসের কোন বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আমার মতের সাথে অমিল রাখছে, তখনই তার প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছি, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছি, বিষবাষ্পের্ ধুয়া তুলছি।

আমাদের এরকম মনোভাবের মাধ্যমে আমরা জেনেশুনে অথবা মনের অজান্তে নিজেদের জন্য এক এক রকম করে ইসলামকে নির্মাণ করে তুলছি এবং নিজেরা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উম্মায় বিভক্ত করে ফেলছি যা ইসলামে কঠোরভাবে অপছন্দনীয় এবং নিষিদ্ধ।

ফলশ্রুতিতে তথাকথিত আলেমরাই ইসলামের এবং উম্মাহর প্রধান শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছেন। বাইরের শত্রুকে মোকাবেলা এবং দমন করার চেয়ে এদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অধিকতর মুশকিল।

আমরা কেউ কেউ আবার ইসলাম রক্ষা করতে গিয়ে অনেক বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য ইখতিলাফের বিষয় নিয়ে এত বেশি ধুয়া তুলতে যাই, কিন্তু এর মাধ্যমে যে ইসলাম দুর্বল হচ্ছে আর উম্মাহ হারিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়টি যেনো দেখেও দেখি না।

এই ধরনের মানসিকতার নাম ধার্মিকতা নয়, এটাকে বলে ধর্মান্ধতা বা ধর্মব্যবসা।
ময়লা এবং আবর্জনার মধ্যে যেমন মশামাছি জন্ম নিয়ে পরিণামে উপদ্রব এবং মহামারী সৃষ্টি করে বা করার সম্ভাবনা রাখে ঠিক তেমনি ধর্মব্যবসা হচ্ছে ধর্ম-জগতের ময়লা যার পরিশোধন এবং নিষ্কাশনের অভাব হলে সমাজের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ধর্মান্ধ নামক মশা-মাছির রূপ নেয়।

ময়লার পরিমান বৃদ্ধিতে এই মশা-মাছিগুলো আকারে বড় হতে থাকে, তারপর সমাজের চারিপাশে ওয়াজ নামক ভন-ভন আওয়াজ করে বেড়ায়। ধর্মপ্রাণ লোকগুলো প্রথমে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেও ধীরে ধীরে মানব মনের সংবেদনশীলতা হারিয়ে এদের খপ্পরে পড়ে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে আত্মার অপমৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়।

ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব ধর্ম-ব্যবসায়ীদের জন্য খুলে দেয় অপার সম্বাবনা। তারা তখন চতুর্দিকে তাদের নিজ নিজ ধর্ম-ব্যাখ্যার সার্জারী-ক্লিনিকস স্থাপন করতে শুরু করে এবং তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়ার সকল সুযোগ লুফে নেয় ।

ধর্মান্ধ এবং ধর্ম-ব্যবসায়ীদের চেনার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে তারা ইসলামের চেয়ে তাদের নিজ নিজ দল এবং মতকে, উম্মতের স্বার্থ থেকে নিজ দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, উম্মতের মধ্যে বিরোধ এবং বিভাজন সৃষ্টিতে সহায়ক ও অনুপ্রেরণামূলক ওয়াজ নসিহত এবং বক্তৃতা দিয়ে বাজার গরম করে রাখে বা রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে।

পক্ষান্তরে যারা নির্ভেজালভাবে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন, তাদের কথাবার্তায় এবং আচার-আচরণে ইসলাম, মুসলিম উম্মাহ এবং বিশ্ব-মানবতার ঐক্য, সংহতি ও কল্যাণ কামনার আকাঙ্খা বা অভিলাষ ফুটে উঠে যা হচ্ছে ধর্ম-চর্চার মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

ধর্ম-ব্যবসায়ীদের মন-মানসিকতা এমন হয় যে তারা তাদের উস্তাদ, আমির, শেখ, কিবলা, নেতা গং নামক মহাজনদের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারে না এমনকি মারমূখী হয়ে রক্তপাত ঘটাতেও কুন্ঠিত হয় না।

কিন্তু ইসলামের শিক্ষাতে আমরা কি দেখি? আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক এবং আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও। যদিও এটা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের বাবা, মা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাঁদের চেয়েও বেশি কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকোনা। আর যদি তোমরা পেচানো কথা বলো অথবা সত্যকে পাশ কেটে চলো, তাহলে জেনে রেখো তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন।” [সুরা নিসা, আয়াত- ১৩৫]

একবার হযরত আলী (রা.) বিরুদ্ধ পক্ষের এক বীরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর বসে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলে ভূমিতে পতিত বীর হযরত আলী (রা.) এর মুখের উপর থুতু নিক্ষেপ করলো । এতে আলী (রা.) তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অবাক বিস্ময়ে তখন হযরত আলী (রা.) কে সে বীর জিজ্ঞেস করেছিল, “হাতের মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন?” হযরত আলীর (রা.) উত্তরটি ছিলো – “যুদ্ধাবস্থায় তোমাকে হত্যা করলে আমি সওয়াব লাভ করতাম কিন্তু তুমি আমার মুখে থুতু নিক্ষেপ করায় আমার হৃদয়ে তোমার সম্পর্কে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ জেগে উঠেছে। এখন আমি তোমাকে হত্যা করলে তা হতো ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে। আর এমন হত্যা মহাপাপ। এই শিক্ষা ইসলাম আমাকে দিয়েছে।”

ইসলাম শাশ্বত, অবিনশ্বর-চিরন্তন এবং একটি মোকাম্মেল নিজামে হায়াত। দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামী জিন্দেগির পরতে পরতে ইনসাফ বা ন্যায়নীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য জায়গায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় বক্তব্য রয়েছে। ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কারো প্রতি বিদ্বেষ ও অন্ধভক্তি কোনভাবেই কাম্য এবং গ্রহণযোগ্য নয় বা হতে পারে না।

আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। নির্দিষ্ট কোন দলের বা জাতির বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে তাদের প্রতি অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা নির্বিশেষে সকলের প্রতি সুবিচার কর, কারণ এটা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী। জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজের খবর রাখেন।” [সুরা মায়েদা, আয়াত- ৮]

এমন পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে আজ নিকৃষ্টতম পথে। ইসলাম ধর্ম অত্যন্ত সহজ-সরল হলেও তথাকথিত মুল্লা-মৌলভীদের একটি বিশেষ অংশ (মৌ-লুভীরা) এটাকে সাধারণের কাছে দুর্বুধ্য বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণ দিয়ে কঠিন করে তুলে আর এইসব ম্যারপ্যাচের ওয়াজ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে।

কোন সত্যনিষ্ঠ মানুষ ধর্মের মর্মবাণীকে সহজ সরলভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে যাতে না পারে সে ব্যাপারে মৌ-লুভী ধর্মব্যবসায়ীরা সদা সচেষ্ট থাকে, প্রয়োজনে তারা তাকে কাফের পর্যন্ত ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাদের কৌশল বাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে “এই ব্যক্তি ইসলামের কী জানে? সে কি আরবি জানে? সে কি মাদ্রাসায় পড়েছে? তার উস্তাদ কে? ইসলাম কি এতই সহজ? তার পোশাক-আশাক দেখেছো, সে তো ইহুদি নাছারাদের এক নাম্বার দালাল”।

নবী করীম (দ:) বলেছেন দীন অত্যন্ত সহজ, তোমরা একে জটিল কর না, এই দ্বীন প্রচারে এমন পন্থা অবলম্বন করোনা যাতে লোকজন এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে, তোমাদেরকে সহজতা বিধানকারী করে পাঠানো হয়েছে (আবু হোরায়রা (রা:) থেকে মোসলেম)।

দেখুন আল্লাহর রসুল (স:) বলেন দীন সহজ সরল আর আমাদের আলেমরা বলেন কঠিন ও জটিল। কার কথা সত্য ? আল্লামা ইকবাল এই মৌ-লুভীদের উদেশ্যে বলেছিলেন – “হর এক পর লাগাতাহে তু কুফর কে ফতোয়া / ইসলাম তেরে বাপ্ কি জায়গীর নেহি হে”

উপরোক্ত পংক্তি দুটোর অর্থ হচ্ছে, “ইসলাম তোমার বাপের জায়গীর নাকি যে তুমি যাকে খুশি ইচ্ছেমত কাফির বানিয়ে ছাড়ছো”। ধর্মব্যবসায়ীরা অবহেলিত মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী হয় না, তারা দুয়া-দুরুদ করে শর্টকার্ট বেহেস্তে যেতে চায়, ওরা মানুষের অধিকার হরণ করতে দ্বিধান্বিত হয় না, সমাজে সহিংসতা ছড়ায় এবং উম্মতের গলায় বিভক্তির ছুরি চালিয়ে ধর্মগ্রন্থকে চুমু খায়। এদের অবস্থান কাজী নজরুল ইসলাম তার মানুষ কবিতার দুটো লাইনে অত্যন্ত চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করেছেন।

“মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি/ ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/ যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।/ পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মুর্খ্যরা সব শোনো/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ,-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”

আপনি-আমি সাধারণ জনতা। আমরা ক্রেতার ভুমিকা পালন করছি এখানে। চিন্তা করুন আমরা কি এসব ইসলামের বিধান লংঘনকারী ব্যবসায়ীদের ফাদে পা দিব, নাকি ধর্মীয় মুল্যবোধকে এই বাজারিদের কাছ থেকে দূরে রাখব? আজ সময় এসেছে কায়েমী স্বার্থবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচনের।

সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৬ নং পর্যন্ত আয়াতগুলিতে ইরশাদ হচ্ছে , “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ কোরেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা (১) নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না, (২) কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, (৩) আল্লাহ তাদের পবিত্রও করবেন না, (৪) তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় কোরেছে, (৫) তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা, গোমরাহী ক্রয় কোরেছে, (৬) তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে (৭) আগুন গ্রহণ করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল”, মোটকথা তারা অর্থাৎ মৌ-লোভীরা, ধর্মব্যবসায়ীরা নিকৃষ্টতম জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত, সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব।

সুরা ইয়াসীনের ২১ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, “তোমরা তাদের অনুসরণ কোরো, যারা তোমাদের কাছে বিনিময় চায় না এবং যারা হেদায়াতে আছে।”

আসুন আমরা আগুনখোর মৌ-লুভীদের এত্তেবা করা থেকে বিরত থাকি, ধর্ম-ব্যবসায়িদের বর্জন করি এবং এ ব্যাপারে অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টিতে অগ্রসর ভূমিকা নেই।

* মুসতাক আহমদ ব্যারিস্টার অ্যাট ল, লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাউন্সিলর এবং ওভারভিউ ও স্ক্রুটিনি কমিটির চেয়ারম্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *