সিঙ্গাপুর স্টিং: রাশিয়া কী করে জার্মান জেনারেলদের কথায় আড়ি পেতেছিল

আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

জেসিকা পার্কার বিবিসি বার্লিন সংবাদদাতা

সিঙ্গাপুরে তখন মধ্যরাত।

জার্মান বিমান বাহিনী লুফটওয়াফের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার হোটেলের কক্ষেই ছিলেন।

তিনি এই অঞ্চলে এসেছেন এশিয়ার সবচেয়ে বড় বিমান প্রদর্শনীতে প্রতিরক্ষা শিল্পের যারা বড় বড় প্রতিষ্ঠান, তাদের সাথে কথা বলতে।

সারা দিন তার প্রচুর পরিশ্রম গিয়েছে কিন্তু তিনি এখনও ঘুমাতে যেতে পারেন নি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফ্র্যাঙ্ক গ্র্যাফেকে এখন তার বস জার্মান বিমান বাহিনীর কমান্ডারের সাথে একটা কাজের ফোন কল সেরে নিতে হবে।

যদিও বিমান বাহিনীর অপারেশনের প্রধান হিসেবে এটা খুবই একটা স্বাভাবিক বিষয় তার জন্য। তার দুই কলিগের সাথে বেশ হালকা মেজাজেই আলাপ করেন তিনি, এসময় তার হোটেল রুমের ‘বিশাল ভিউ’ নিয়ে কথা বলেন এবং জানান যে মাত্রই তিনি পাশের একটা হোটেল থেকে মদ্যপান করে ফিরেছেন যেখানে চমৎকার একটা সুইমিং পুল আছে।

“খুব একটা খারাপ না”, তাদের একজন মন্তব্য করেন।

অবশেষে তাদের সবার বস লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইনগো গেরহার্টজ ফোনে যুক্ত হন এবং তাদের মূল আলাপ শুরু হয়। এরপর ৪০ মিনিট ধরে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় সামরিক বিষয় নিয়ে আলাপ করেন, যার মধ্যে জার্মানি ইউক্রেনে টোরাস ক্রুজ মিসাইল পাঠাবে কি-না সেই নিয়ে বিতর্কের বিষয়টিও।

তবে তারা কেউ যেটি জানতেন না তা হল তাদের ফোনে আড়িপাতা হচ্ছে এবং কথোপকথোনটি রেকর্ড করা হচ্ছে।

এই ফোনকল হয়ে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর অডিও টেপটি প্রকাশ পায় রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আরটি চ্যানেলে।

জার্মানি এরপর বলেনি যে এই রেকর্ডিংটা বিকৃত করা হয়েছে কি-না, কিন্তু নিশ্চিত করেছে যে এই কলটি করা হয়েছিল এবং তাদের বিশ্বাস এটা রাশিয়ান গুপ্তচরদের কাজ।

জার্মান সরকার জানায় সিঙ্গাপুরে তাদের কর্মীর দ্বারা কোনভাবে ‘তথ্য প্রকাশ হয়েছে’।

যদিও তার নাম প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু মনে করা হচ্ছে এটা ফ্র্যাঙ্ক গ্র্যাফে যিনি দুর্ঘটনাবশত তাদের কলে আড়িপাতার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

এতে করে তাদের টপ সিক্রেট আলোচনা রাশিয়া রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচার হয় এবং সারা বিশ্বই জেনে যায়।

এই কলের সব বিষয়বস্তু এখন সবার জানা হয়ে গিয়েছে।

ফোন কলে অংশ নেয়া চারজন আলোচনা করেন যে যদি চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ কিয়েভে জার্মানির তৈরি টোরাস মিসাইল পাঠান, তাহলে সেগুলো সম্ভাব্য কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে, যে বিষয়টি নিয়ে পুরো জার্মানিতেই এখন বিতর্ক চলছে।

ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশ অস্ত্র চালান পৌঁছানোর বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায় এবং খুবই স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ যে ‘কিছু’ ব্রিটিশ এই মূহুর্তে ইউক্রেনে অবস্থান করছে সেরকম ধারণাও দেয়া হয়।

কিন্তু গুপ্তচররা কীভাবে আড়ি পাতে?

এর যে উত্তর আমরা পাচ্ছি তা শেষ পর্যন্ত মানুষের একটি ভুলকেই দায়ী করে।

জার্মান কর্তৃপক্ষ বলছে যে ‘তথ্য ফাঁসের’ ঘটনা ঘটেছে সেটা তাদের একজন অংশগ্রহণকারী অনিরাপদ লাইনে যুক্ত হওয়ার জন্য, হয় তিনি নিজের মোবাইল ফোন বা হোটেলের ওয়াই-ফাই ব্যবহার করেছেন।

ঠিক কীভাবে তিনি ফোন করেন তা “এখনো যাচাই করা হচ্ছে” বলে জানিয়েছে জার্মান সরকার।

“এইটা আমি মনে করি যে সবার জন্যই একটা ভালো শিক্ষা: আপনি যদি নিরাপদে কথা বলতে চান তাহলে কখনোই হোটেলের ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন না,” বিবিসিকে বলেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত মিগুয়েল বারজার। তবে এই উপদেশ বেশ দেরীতে এলো বলে মনে করতে পারেন কেউ কেউ।

শঙ্কা তৈরি হয় যখন জানা যায় যে এই কলটি বহুল ব্যবহৃত ওয়েবএক্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে করা হয়েছে-কিন্তু বার্লিন জোর দিয়ে জানায় তাদের কর্মকর্তারা একটি বিশেষভাবে নিরাপদ সার্টিফাইড ভার্সন ব্যবহার করেছে।

সারে সেন্টার ফর সাইবার সিকিউরিটির অধ্যাপক অ্যালান উডওয়ার্ড জানান, ওয়েবএক্স অ্যাপ ব্যবহার করলে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন এমনিতেই পাওয়া যায়।

কিন্তু ল্যান্ডলাইন বা হোটেলের উন্মুক্ত ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা মানে নিরাপত্তা বিষয়টি তখন আর নিশ্চিত থাকে না – আর রাশিয়ান গুপ্তচররা সেটারই অপেক্ষায় ছিল বলে এখন প্রতীয়মান হচ্ছে।

অধ্যাপক উডওয়ার্ড মনে করেন, “গুপ্তচররা সিঙ্গাপুর বিমান প্রদর্শনীতে গিয়ে হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় ছিল”।

প্রতি দুই বছর পরপর হওয়া এই প্রদর্শনী, যা এ বছরের ২০ থেকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়, সাধারণত বিভিন্ন দেশের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনা ও এই শিল্পের সাথে জড়িতরা এতে হাজির হন।

যদি আপনি একজন গুপ্তচর হন, “তাহলে এরকম সমাবেশ যদি আপনি পান, তাহলে কার পার্কে বসে থাকা বা কোন হোটেল রুমে থাকাটা সবসময়ই ভীষণ অর্থবহ হতে পারে।”

রাশিয়ানরা সম্ভবত দূরপাল্লার সক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টেনা যার সাথে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং যুক্ত, যেটা দিয়ে স্থানীয় নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিকে ঢোকা যায়, সেরকম কিছু ব্যবহার করেছে।

“এই সরঞ্জামগুলো নিয়ে আসলে দরজার সামনে বসে থাকার মতো এবং দেখা যে কী পাওয়া যায়,” অধ্যাপক উডওয়ার্ড বলেন, “একসময় কিছু না কিছু পাওয়া যায় যেটা খোলা।”

বার্লিনের ক্রিপ্টোগ্রাফির গবেষক হেনিং সেডলার মনে করেন, সবচেয়ে বেশি যেটা ঘটার সম্ভাবনা তা হল, ঐ কর্মকর্তা তার মোবাইল ফোন দিয়ে কল করেছেন এবং সেই কলটা গুপ্তচরদের অ্যান্টেনায় ধরা পড়ে, তারা সেই কলটি আবার প্রকৃত অ্যান্টেনায় “পাঠিয়ে” দিতে পারে।

কিন্তু এই পুরো সময়টা “তারা যা যা বলা হয় সেসব শুনতে থাকে এবং লিখতে থাকে।”

“এটা আসলে ডিনামাইট বিস্ফোরণের মাধ্যমে মাছ ধরার মতো। আপনি পুকুরে ডিনামাইট ছুঁড়ে মারেন ও এরপর দেখতে থাকেন যে কোন মাছটা ভেসে ওঠে।”

“আর এইটা ছিল তাদের সহজ শিকার।”

তবে আরেকটা যে তত্ত্ব আছে বার্লিন সেটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়নি – সেটা হল কোন রাশিয়ান স্পাই সরাসরি ঐ লাইনে ডায়াল করে যুক্ত হয় এবং সেটা কেউ ধরতেও পারে নি।

কিন্তু সরকার বারবারই জোর দিয়ে বলছে ঠিক কী ঘটেছিল তারা সেটি তদন্ত করছে তবে এটা আসলে কোন একজনের ব্যক্তিগত ভুলের মাশুল।

তাদের যুক্তি এই কলটা আসলে বিশ্বজুড়ে যেভাবে আড়িপাতা হয় সেভাবেই এটা ধরা পড়ে, এক্ষেত্রে গুপ্তচর সৌভাগ্যবান ছিল কিন্তু জার্মানির ভাগ্য সহায় হয় নি।

তবে সাবেক সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা এবং বুন্দেসটাগ সদস্য রডরিখ কিসওয়েটার ঠিক এই যুক্ত মানতে রাজি নন যে “এটা যে কারো সাথেই হতে পারতো”।

“আপনাকে আসলে এরকম বিপর্যয়ের পর কোন না কোন আড়াল খুঁজতে হয়,” বলেন মি. কিসওয়েটার যিনি নেটো সামরিক জোটেও কাজ করেছেন এবং এখন জার্মানির বিরোধী দল কনজারভেটিভ সিডিইউ পার্টির একজন সদস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *