ঐতিহাসিক জয় : টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান

যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

সাদিক খান লন্ডনের মেয়র হিসাবে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়ে তিনি ও তাঁর দল যেমন আনন্দিত, তেমনি দলের বাইরের বিপুল সংখ্যক শুভাকঙ্খী উল্লসিত। প্রথম কোন রাজনৈতিক নেতা এবং প্রথম কোন মুসলিম ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের মেয়র পদে পর পর ৩য় বার বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

বৃহস্পতিবার (২ মে ২০২৪) রাত ১০টায় ভোট গ্রহণ শেষ হলেও গণনা শুরু হয় শুক্রবার থেকে। শনিবার ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। বর্তমান সরকার দলীয় সুসান হলকে ২ লাখ ৭৬ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছেন লেবার দলের সাদিক খান। তিনি ৪৩.৮ শতাংশ তথা ১০ লাখ ৮৮ হাজার ২২৫ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। আর কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী সুসান পেয়েছেন ৩২.৭ শতাংশ তথা ৮ লাখ ১২ হাজার ৩৯৭ ভোট। ১৪টি নির্বাচনী এলাকার নয়টিতেই জিতেছেন সাদিক খান।

৬১ লাখ ৬৪ হাজার ১১৯ জন রেজিষ্টার ভোটারের মধ্যে ২৪ লাখের বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন। ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। সাদিক খান ও সুসান সহ মোট ১২ জন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যরা হলেন- লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির রব ব্লাকি, গ্রিন পার্টির জো গার্বেট, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির এমি গালাহের, অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার পার্টির ফেমি আমিন, কাউন্ট বিনফেস পার্টির কাউন্ট বিনফেস, ব্রিটেন ফার্স্টের নিক স্কেনলোন, লন্ডন রিয়েল পার্টির ব্রিয়ান রোজ এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রেস মিখলি, তারুন গোলাটি, নাথালি ক্যাম্পবেল।

ফলাফল ঘোষণার পর পূর্ব লন্ডনের সিটি হলে দেওয়া বিজয় ভাষণে সাদিক খান বলেন, আমি এই নগরীকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, যার সেবা করতে পারা আমার জন্য দারুণ সম্মানের। নগরবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমি সকলকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গত কয়েক মাস আমাদের কঠিন সময় গেছে। আমরা অবিরাম নেতিবাচক প্রচারণার মুখোমুখি হয়েছি। তবে, লন্ডনের বাসিন্দারা আজ ভয়ের পরিবর্তে আশাকে বেছে নিয়েছেন। তাঁরা বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

সাদিক খান দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, আজ এই নগরির ভবিষ্যতকে আরও উজ্জ্বল করার পথে এগিয়ে চলার দিন। তাই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মেট্রোপলিটন পুলিশে সংস্কার করা এবং লন্ডনকে আরো নিরাপদ করা। একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও নিরাপদ রাজধানীর প্রত্যাশা করেন তিনি। অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে মি. খান এই দশকের শেষ নাগাদ ৪০ হাজার নতুন কাউন্সিল বাড়ি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিজয়ী ভাষণে সাদিক খান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণার আহ্বান জানান।

এক বছর আগে সাদিক খান বিশ্ব পরিবেশের উপর ফোকাস করে লন্ডনের বাতাস পরিষ্কার করার জন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। নিউইয়র্কে গত বছরের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি মানুষকে ‘সচেতন’ করছেন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে জিরো কার্বন নির্গমনের যাত্রায় সকলকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। সেটি এখন মেয়রের প্রায়রিটি তালিকায় রয়েছে।

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান ২০১৬ সালে প্রথমবার লন্ডনের মেয়র নির্বাচিন হন। ইউরোপের দেশগুলোতে মুসলমানদের নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামকে এক করে যখন সর্বত্র হইচই চলছে- তখন ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লন্ডনের রাজধানীতে একজন মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়ে ছিলেন। ২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি।

কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথের চেয়ে সাদিক খান প্রায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি লাভ করেন ১৩ লাখ ১০ হাজার ১৪৩ ভোট আর গোল্ডস্মিথ পেয়েছিলেন ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৬১৪ ভোট। লন্ডনের সাবেক মেয়র পরবর্তীতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ দলের নেতা বরিস জনসনের হাত থেকে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন সাদিক খান। তখন কনজারভেটিভ পার্টির সাউন বেইলিকে হারিয়েছিলেন। প্রথম দফার ভোটে দুইজনের কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ হয়। সেখানে ৫৫.০২ শতাংশ পপুলার ভোট পেয়েছেন তিনি। তখনও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল।

অতীতের মতো এবারও মুসলিম পরিচয়কে সামনে এনে সাদিক খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। এমনকি তার সাথে উগ্রপন্থীদের যোগাযোগ আছে বলেও নানা রকম বিদ্বেষী প্রচারণা চালায় বিরোধীরা। এতে ক্ষতির চেয়ে তাঁর লাভ হয়েেছ। সর্বস্তরের মুসলমানদের ভোট পেয়েছেন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে লেবার দলের প্রধান স্যার কেয়ার স্টারমার বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হলেও সাদিক খান বেশ যোগ্যতার সাথে জনসমর্থন আদায় করেছেন।

১৯৯৪ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সাদিক খান লেবার পার্টির হয়ে লন্ডনের ওয়ান্ডসওর্থ বারার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ২০০৮ সালে গর্ডন ব্রাউন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি এবং পরে যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

২০১০ সালে লেবার পার্টি বিরোধী দলে গেলে সাদিক খান ছায়া মন্ত্রিসভায় বিচার-বিষয়ক ছায়া মন্ত্রী, ছায়া অর্থমন্ত্রী ও লন্ডন-বিষয়ক ছায়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে লন্ডনের মেয়র পদে নির্বাচনে জন্য পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন। পর পর ৩ বার মেয়র হিসেবে বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।

রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও আগ্রহ রয়েছে সাদিক খানের। তাঁর পছন্দের খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও বক্সিং। ২০১৪ সালে লন্ডন ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

সাদিক খানের জন্মের কিছুদিন আগে ১৯৭০ সালে তাঁর বাবা আমানুল্লাহ খান এবং মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সাদিক খান তাদের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে পঞ্চম। তারা সাত ভাই ও এক বোন।

ইউনিভার্সিটি অব নর্থ লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন সাদিক খান। ১৯৯৪ সালে একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই তার স্ত্রী সাদিয়া আহমদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে।

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *