ব্রিটেনের রাজনীতিতে গাজার উত্তাপ

মতামত সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সারওয়ার-ই আলম

ভদ্রমহিলার কাণ্ডটা দেখুন। সম্ভাব্য সব রকমের শক্তি প্রয়োগ করে যেই না ব্যর্থ হলেন পুলিশকে কাজে লাগিয়ে প্রো-প্যালেস্টিনিয়ানদের রোডমার্চ বন্ধ করতে, সেই পুলিশের গায়ে লেবেল লাগিয়ে দিলেন প্যালেস্টিনিয়ানদের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্বের।

তাঁর কথাগুলো কী ভয়ংকর দেখুন না। তিনি টাইমসে লিখেছেন, ’ আনফরচুনেইটলি দেয়ার ইজ এ পারসেপশন দ্যাট সিনিয়র পুলিশ অফিসারস প্লে ফেবারিটস হোয়েন ইট কামস টু প্রটেস্টারস’।

কী জঘন্য মন্তব্য ভাবা যায়! শুধু কী তাই! তিনি দাবী করেছেন, ফার রাইট প্রটেস্টারস অয়ার ট্রিটেড মোর হার্সলি দ্যান প্রো-প্যালেস্টিনিয়ান সাপোর্টার্স। — এতো রীতিমত পুলিশকে চরম ডানপন্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার সামিল। একজন হোম সেক্রেটারী কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে তাঁর অধীনস্থ বাহিনীকে এভাবে একটি চরমপন্থী সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন সেটাই ভাববার বিষয়।

প্রো-প্যালেস্টিনিয়ানদের প্রতি তাঁর ক্ষোভটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। এর আগেও তিনি তাদের রোডমার্চকে আখ্যায়িত করেছেন হেইট মার্চ হিসেবে। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে ছলে-বলে-কৌশলে এই রোডমার্চটা বন্ধ করতে তিনি কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

প্রশ্ন হলো— তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, না কি তাকে ব্যবহার করছে নেপথ্যের কোনো একটি শক্তিশালী গ্রুপ যারা কখনোই চায় না স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টিনিয়ানদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হোক; তারা চায় আমেরিকা ও ব্রিটেনের মত শক্তিশালী প্রভুরাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে গাজাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে দিতে।

তবে আশার ব্যাপার হলো নাম্বার টেন ডাউনিং স্ট্রিটের প্রিয়ভাজন এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হোম সেক্রেটারী সুয়েলা ব্রেভারম্যানের সামনে দাঁড়িয়ে বিরাট সাহসের পরিচয় দিয়েছেন লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যার মার্ক রাওলে। স্বীকার করতেই হবে যে শক্ত মেরুদণ্ড আছে তাঁর। একদমই মাথা নত করার লোক নন তিনি। হোম সেক্রেটারীর অন্যায় আবদারকে রীতিমত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘দেয়ার অয়ার ইনসাফিসিয়েণ্ট গ্রাউণ্ডস টু ব্যান এ প্রো-প্যালেস্টিনিয়ান মার্চ অন আর্মিস্টিস ডে’।
সাব্বাশ বাপের বেটা! হ্যাটস অফ!

অপরদিকে স্যার কিয়ার স্টারমারের অবস্থাটা দেখুন না! একটি অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকার করার সাহসটা পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না এই ভদ্রলোক; অথচ তিনি লেবার লিডার। একসময় মনে করা হতো লেবার হলো বঞ্চিত, নিপীড়িত, মেহনতি, শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন। এই সংগঠনটি শ্রমিক শ্রেণীর কথা বলে। মানবতার কথা বলে। অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে যায়।

কিন্তু কোথায় আজ সে লেবার পার্টি? গাজাবাসীকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে মৃত্যুফাঁদে আটকে ফেলার জন্য যেইনা নেতানিয়াহু সরকার বিদ্যুৎ, পানি, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, এই লেবার লিডার তৎক্ষনাৎ তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইসরায়েল হ্যাজ দ্য রাইট টু উইথহোল্ড পাওয়ার অ্যান্ড ওয়াটার ফ্রম গাজা’।

কী অবিশ্বাস্য এই ভাষণ কল্পনা করা যায়! কোথায় তিনি প্রতিবাদ করবেন ইসরায়েলি নির্মম-নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের, সেখানে তিনি তাদের পক্ষে রীতিমত সাফাই গেয়ে চলেছেন । অথচ ভদ্রলোক একজন ব্যারিস্টার। আইন নিয়েই তাঁর যত কারবার। পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডের মত বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দক্ষতা অর্জন করেছেন আইন শাস্ত্রে। প্রশ্ন জাগে- যেই আইন শাস্ত্র একটা চরম মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রতিবাদ করতে শেখায় না, কী লাভ সে আইন শাস্ত্র পড়ে।

তবে হ্যাঁ রাজনীতিটা এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। কিছু মানবিক রাজনীতিবিদও আছেন যাদের বিবেক কাজ করে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা আপোষহীন। এই যেমন ব্রাডফোর্ড ইস্টের এমপি ইমরান হোসেনকে দেখুন। মানবতার এক অকুতোভয় সৈনিক! লেবার পার্টি গাজায় যুদ্ধ বিরতির দাবী প্রত্যাখ্যান করার প্রতিবাদে শ্যাডো মিনিস্টার হিসেবে পদত্যাগ করেছেন তিনি। যুদ্ধ বিরতির দাবীতে সোচ্চার লেবার পার্টির আরো ৬৫ জন এমপি। প্রভাবশালী দৈনিক ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট বৃহস্পতিবার ৯ই নভেম্বর তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘কিয়ার স্টারমার হ্যাজ বিন ওয়ার্নড দ্যাট দ্য রেসিগনেশন অব এ ফ্রণ্টবেন্চার ওভার দ্য পার্টিস রিফিউসাল টু ব্যাক এ সিসফায়ার ইন গাজা ওণ্ট বি দ্য লাস্ট’।

অর্থাৎ পতন আরো আসছে। আরো ভয়ংকর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছেন স্যার কিয়ার স্টারমার। ইতোমধ্যে প্রায় পঞ্চাশজন লেবার কাউন্সিলর পদত্যাগ করেছেন দল থেকে শুধুমাত্র দলটি গাজায় যুদ্ধ বিরতির দাবী প্রত্যাখ্যান করার কারণে। পদত্যাগের এই যাত্রা আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার পথে। সাধারণ সদস্যরাও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন লেবার লিডার কিয়ার স্টারমার কর্তৃক যুদ্ধ বিরতির দাবী প্রত্যাখ্যান করার প্রতিবাদে। অনেকেই ভাবছেন দলত্যাগ করবেন। যুগের পর যুগ ধরে যারা ক্লান্তিহীনভাবে লেবারের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন তারা লেবারের এই রূপ দেখে চরমভাবে ক্ষুব্ধ, আশাহত। যেন কিছুতেই মেলাতে পারছেন না- এ কোন লেবার পার্টি!

দলটি আসলে কার প্রতিনিধিত্ব করছে? কোথায় মানবতা? কোথায় মানবাধিকারের পক্ষে সংগ্রাম? লেবার লিডার স্যার কিয়ার স্টারমার যত দ্রুত তাঁদের কথা শুনবেন ততই মঙ্গল। তা না হলে শুধু তাকেই নয়, আগামী নির্বাচনে দলটিকে চরম মূল্য দিতে হবে একটি চরম রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। গাজার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে ব্রিটেনের রাজনীতিতে। ততদিনে বড্ড বেশী দেরী হয়ে যাবে। তাই লেবার লিডারের জন্য এই মুহূর্তে, সময়ের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবী সমর্থন করা এবং গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা রোধে সোচ্চার হওয়া।

১১ই নভেম্বর শনিবার লাখো জনতার পদভারে প্রকম্পিত হোক লন্ডনের রাজপথ। লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হোক— ‘স্টপ দ্য জেনোসাইড ইন গাজা! সিসফায়ার ইন গাজা নাউ’!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *