আমি ছিলাম সাধারণ ঘরের সন্তান : আসিফ নজরুল

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আমি ছিলাম সাধারণ ঘরের সন্তান। আব্বা প্রথম শ্রেণীর সরকারী অফিসার ছিলেন। কিন্তু তার ছিল ছয় সন্তানসহ বিরাট সংসার। তিনি টাকা জমানোর চেষ্টাও করতেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ফলে বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা ছিল না তেমন।

তবু আমাদের পরিবারে কিছু বই ছিল। শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী আর নীহাররঞ্জনের উপন্যাস ছিল। আমার বোনেরা শরৎচন্দ্র পড়ে ফুপিয়ে কাঁদতো। শিশু বয়েসী আমি কৌতুহলী হয়ে তাদের দিকে তাকালে রেগে যেতো। কখনো আবার বিনা ঝামেলায় কান্নাকাটির সুযোগ পাওয়ার জন্য দেয়ালের দিক মুখ ঘুরিয়ে ফেলতো। খুব ছোট বয়েসে দু’একবার নাড়াচাড়া করেছিলাম বইগুলো। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা কিরীটি রায়কে ভাল লেগেছিল।

আমার আব্বার নিজের একটা প্রিয় বই ছিল, উইন্সটন চার্চিলের জীবনী। তিনি সেখান থেকে হঠাৎ উদ্দীপনামূলক কি সব বলতেন, তেমন একটা বুঝতাম না। আমার বড় ভাই প্রচন্ড পড়ুয়া তরুণ ছিলেন তখন। ডিক্সনারী মুখস্ত করতেন, তার স্কুলের লাইব্রেরী থেকে ইংরেজী বই এনে পড়তেন। এজন্য বেশ অহমিকাও ছিল তার। আমি সভয়ে দুরত্ব রাখতাম তার থেকে।

আমার ছিল খেলার নেশা। থাকতাম সাভার রেডিও কলোনীতে। সারাদিন বনে-বাদারে, পুকুরে মাঠে সময় কাটতো। খরগোসের পেছনে দৌড়াতাম, কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানাতাম, সুযোগ পেলেই ফুটবল খেলতাম। এমনকি ঝোপঝাড়ে আগুন লাগানো বা উইপোকার ঢিবি ভেঙ্গে দেয়ার মতো ভয়াবহ কাজও করতাম। বকা খেয়ে সেসব অবশ্য বন্ধ করতে হয় একসময়।

সন্ধ্যায় বাসায় এলে বসতে হতো স্কুলের নিরানন্দময় পড়া নিয়ে। আমাদের বাড়ীতে নিয়ম কানুন ছিল খুব কঠোর। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হতো, খুব সকালে উঠতে হতো। পরীক্ষায় ভালো করতে হতো। ছেলেরা পরীক্ষায় ভালো না করলে মার খেতো। বড় ভাই হঠাৎ পড়া ধরলে আমি মার খেতাম আরো তুচ্ছ কারণে। যেমন: চুজ-এর পাষ্ট পার্টিসিপল ‘চোজেন’ না বলে ‘চুজড্’ বলার জন্য বা আট নং বাহাত্তর না বলে বিরাশি বলে ফেলার জন্য। এরপরও স্কুলে বরাবর প্রথম হতাম। এজন্য কোনদিন বাহ্বা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

ছোট বেলার জীবন ছিল নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত। এই জীবনের পড়াশোনার বাইরের বইও যে পড়া যে দরকার এটা বলতো না কেউ। সাভারে এমন একটা জায়গায় থাকতাম লাইব্রেরী ছিল না কোন। ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম, সেখানে ক্লাসরুমই ছিল অল্প, সেখানেও ক্লাস করা যেতো না বেশী বৃষ্টি হলে। আমাদের সব বিনোদন ছিল অবাধ বিশাল সবুজ প্রান্তর আর বন জঙ্গলের জগতে।

মাঝে স্কুলের বড় ছুটিতে ঢাকার আজিমপুরে যখন যেতাম ছোটমামার বাসায়, সেখানে কিছু বই পড়া হতো। মামা অগ্রণী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন, আমার মামাতো ভাইদের বেশ বড়লোকী ভাব ছিল। পড়তো তখনকার সবচেয়ে নামকরা স্কুল গভার্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলে (যেটাকে ছোটবেলায় আমি লেবেটরি স্কুল বলে জানতাম)। মামার বাসায় হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের গল্প ও আরব্য রজনীর রূপকথা পড়েছি। পড়তে ভাল লাগতো, কিন্তু খেলাধুলা করতে ভালো লাগতো তারচেয়ে অনেক বেশী।

২.
যখন আমার ৯ বছর বয়েস, ঢাকায় বদলী হয়ে আসে আব্বা ১৯৭৫ সালে। আমরা এসে উঠলাম উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আম্মার বাসায়। সেটা ছিল লালবাগ শাহী মসজিদের কাছে পোস্তা নামক এক ঘিঞ্জি এলাকায় (ওয়াটার ওয়ার্কস রোড)। আমার বড় ভাই ভর্তি হলো নটর ডেম কলেজে, আমি আর ছোট ভাই ওয়েষ্ট এ্যন্ড স্কুলে। আমার বড় দু’বোন ভর্তি হলো আনোয়ারা বেগম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে (লিলি নামের আমার সবচেয়ে ছোট যে বোনটা ছিল, সে ১১ বছর বয়েসে মারা যায় ১৯৮৪ সালে)।

নটর ডেম কলেজে ইংরেজী ডিবেট আর উপস্থিত বক্তৃতায় বড় ভাই পুরস্কার পেতো। ছাত্রও ছিল খুব ভালো। কাজেই ছোট ভাইবোনদের ওপর একধরনের কর্তৃত্ব ছিল তার। সেটা দেখানোর জন্য তার কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হতো আমাকে। অল্পদিনের মধ্যে তার বিশেষ নজর পড়লো আমার দিকে। হঠাৎ ডেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার যে লাইব্রেরী, সেটাই ছিল তখন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী। সেখানে যেতে অনেক দূর হেঁটে প্রথমে পলাশী মোড় পর্যন্ত যেতাম। তারপর ডানে ঘুরে আকাশছোঁয়া গাছের সারির ছায়ার নীচ দিয়ে হাঁটতাম। হাঁটতে হাঁটতে রোগাপটকা আমার পা ব্যথা হয়ে যেতো। এখন যে উদয়ন স্কুল আছে সেখানে তখন ছোট দুটো লাল বাংলো আর সামনে খোলা জায়গা ছিল। তার মাঝখান দিয়ে বের হয়ে আসতাম অদ্ভুত সুন্দর টিএসসি ভবনের পাশের রাস্তায়। সামান্য এগোলে লাইব্রেরী। নীচতলাটা শিশু-কিশোরদের বই দিয়ে আলাদা করা। ভাই আমাকে সেখানে ঢুকিয়ে চলে যেতেন উপরতলায়।

ছোটদের সেকশনে সারি সারি বইয়ের তাক; সেগুলো চুইয়ে পড়া বইয়ের রাজ্য। প্রথম দিকে আমি স্তদ্ধ হয়ে ভাবতাম: সত্যি এগুলো পড়তে পারবো বিনা পয়সায়, পড়লে কোনটা পড়বো, কেউ না আবার কিছু বলে আমাকে! পড়তে পড়তে কখনো ক্ষিধা লাগতো খুব, পানি পিপাসাও লাগতো। লাইব্রেরীর নিরব নিস্তদ্ধ বিশাল রুম থেকে ছুটে বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেও হতো মাঝে মাঝে। কিন্তু একা বাসা ফেরার সাহস হতো না, তাছাড়া বড় ভাইকে যমের মতো ভয় করতাম। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়ে আমার বই পড়া শুরু হলো। একসময়ে খুব উপভোগ করা শুরু করলাম। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই। কোন একটা বই হয়তো অর্ধেক পড়েছি, বড় ভাই এসে নির্দেশ দিতো বাসায় যাওয়ার জন্য। পরে এসে কখনো কখনো সেই বই লাইব্রেরীতে আর খুঁজে পেতাম না। এসব নিয়ে মন খারাপ হতো।

ছোটবেলায় খুব সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বই পড়তাম─মনে আছে। সত্যজিতের প্রফেসর শংকু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা আর নায়ায়ণের টেনিদা ছিল আমার প্রিয় চরিত্র। এরমধ্যে ঘনাদা বলতো বানিয়ে অসম্ভব সব গল্প। কিন্তু তার মধ্যে ভূগোল আর ইতিহাসের বহু বিষয় থাকতো─মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। টেনিদা ছিল হিরো ধরনের চরিত্র, যে কোন বিপদে আপদে বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসতো সে। প্রফেসর শংকু ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ধরনের। এসব ভাল লাগতো।

ভালো লাগতো সত্যজিতের ফেলুদার গল্প। বাংলাদেশের লেখকদের বই সম্ভবত কম ছিল লাইব্রেরীতে, খুব একটা ভালোও লাগতো না (সেই স্মৃতি থেকে এখনো মনে হয় বাংলাদেশের শিশু আর কিশোরদের জন্য মানসম্পন্ন বই খুব বেশী হয়তো লেখা হয়না)। তবে এরমধ্যে দিলুর গল্প (রাহাত খান), নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় (শাহরিয়ার কবীর), কপোট্রনিক সুখ দু:খ (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) পড়ে ভালো লেগেছিল। যখন আমি যুবক হয়ে গেছি, তখন শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা হুমায়ুন আহমেদের কিছু বই পড়েছি, পড়েছি তার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো। বলা বাহুল্য, এগুলো পড়ে আর সবার মতো আমিও মুগ্ধ হয়েছি।

অল্প বয়েসে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে কিছু অনুবাদের বইও পড়েছিলাম। এরমধ্যে কিছু অনুবাদগ্রন্থ পড়েছিলাম যা আজো আমাকে স্মৃতিতাড়িত করে। একটা রবার্ট লুই ষ্টিভেনশনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’। কিশোর বয়েসী নায়কের গুপ্তধন খোঁজার এই দু:সাহসিক গল্প বহুবার পড়েছি ছোটবেলায়। পড়েছি ভিক্টর হুগোর ‘লে মিজেগ্যাবল’। শ্রেণী সংগ্রাম, ভুল বিচার ব্যবস্থা, শোষণ-দারিদ্র কিছু বুঝতাম না তখন। কিন্তু বইটা পড়ে প্রচন্ড মন খারাপ হতো, মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনা নিয়ে ছোট বয়েসেই ভাবতে বাধ্য হতাম। শেষ উপন্যাসটা নিয়ে প্রায় বছর দশেক আগে একটা মিউজিক্যাল মুভি দেখেছিলাম। কয়েকটা অস্কার পেয়েছিল ছবিটা, কিন্ত বইয়ের তুলনায় সিনেমাটা তেমন ভালো হয়নি বলে মনে হয়েছে।

লিখতে লিখতেই মনে হলো জোনাথন সুইফট-এর ‘গালিভার ট্রাভেলস্’ এর প্রথম পর্ব পড়েছিলাম ছোটবেলায়। লিলিপুটদের দেশে গালিভারকে প্রথম দেখে আনন্দে ‘হেকিনা দেগাল’ হাঁক ছাড়া হয়েছিল। আর তারদিকে তীর মারার সময় নির্দেশ এসেছিল ‘তোলগো ফানাক’। এসব হাঁকডাক এখনো মনে আছে কিছু;─ অনেক বড় হয়ে পড়েছিলাম গালিভার সিরিজের বাকী দুটো বই। এগুলো যে শুধু চিত্তবিনোদনের জন্য না, বরং সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ফুটিয়ে তোলার তা উপলদ্ধি করেছিলাম আরো পরে।

৩.
একটু যখন বড় হলাম, ভালো ছাত্র হিসেবে এলাকায় আমার নাম হলো মোটামুটি। ফলে বন্ধুদের সার্কেলটা কিছুটা বড় হলো। পোস্তা ছাড়িয়ে লালবাগ ও খাজে দেওয়ানের কিছু ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হলো। এদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম (হানিফ) ছিল নেতা ধরনের। প্রচুর বই কিনতো সে, প্রধানত সেবা সিরিজের, এসব বই অকাতরে বিলাতো বন্ধুদের মধ্যে (এই সুযোগে বলে রাখি এখনো সে আমার সেরা বন্ধু। এখনো তার বাসায় নিয়মিত যাই বিশ্বখ্যাত সব মুভি দেখতে, শেষ দেখলাম ‘কিলারর্স অব দ্যা ফ্লাওয়ার মুন’)।

হানিফের কাছ থেকে পাওয়া বইয়ের সুবাদে ভয়াবহ প্রেমে পড়লাম কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা সিরিজের এডভেঞ্চারমুলক কাহিনীগুলোর। এগুলো আমাকে এতোই তাড়িত করতো যে মনে নিজেকে ‘কুয়াশা’ ভাবাটা বিরাট বিনোদনের বিষয় হয়ে ওঠে। কুয়াশা সিরিজের শহীদ, কামাল, লীনা, ডি কষ্টা- এসব চরিত্রের কথা এখনো মনে আছে।

এরমধ্যে সম্ভবত বড় বোনের পড়ার বইয়ের মধ্যে শ্রীকান্তের গল্প পেলাম। সেখানে অন্যায় অনাচারে কষ্ট পাওয়া শ্রীকান্তকে বুকের ভেতর অনুভব করলাম, অপাড় স্নেহশীলা অন্নদা দিদিকে ভালোবাসলাম, দু:সাহসী ইন্দ্র আমার চিরকালের হিরো হয়ে গেলেন, আত্মম্ভরী ও স্বার্থপর নতুন দা’র দুর্ভোগে অচেনা এক শান্তি পেলাম বুকে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘শিউলী মালা’ আর বুদ্ধদেব বসুর নাম ভুলে যাওয়া একটা গল্প (যেখানে তিন বন্ধু একটা মেয়েকে ভালোবাসে, মেয়েটার বিয়ে হয় অন্য কারো সাথে, তারপরও তাকে খুশী করার জন্য তারা মুখিয়ে থাকে) পড়ে ভালোবাসার অনুভূতিতে স্তদ্ধ হয়ে গেলাম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প পড়ে শহরে ফটিকের বন্দী জীবনের বেদনায় ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। মনে হতো আমিই যেন এক ফটিক, সাভারের গ্রামীণ পরিবেশ থেকে যাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে শহরের নিষ্প্রাণ দালানে।

বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস পড়ে আরো তীব্রভাবে সেরকম অনূভূতি হলো। আমার সাভার জীবনের শৈশবের কথা মনে পড়ে অচেনা বিষন্নতায় মন আর্দ্র হয়ে গেল (তরুণ বয়েসে এটা আবারো পড়া শেষ করা মাত্র আমি সাভারে ছুটে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সেই সাভারের বনবাদারের অনেককিছু নেই আর!)।

ছোটবেলাতে পড়েছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির আমার ছেলেবেলা। অদ্ভূত আর অচেনা একদেশের গল্প; কিন্তু সেখানকার ছোটবেলার দু:খ, বঞ্চনা, আনন্দ-বেদনা খুব আপন মনে হলো কেন যেন। বড় হয়ে এই সিরিজের বাকী দুটো বই (পৃথিবীর পাঠশালা, পৃথিবীর পথে) পড়েও খুব ভালো লেগেছিল। আর্ণেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান এ্যন্ড দ্যা সি-ও পড়েছিলাম তখন। কিন্তু মনে হয়না তখন বুঝতে পেরেছিলাম, তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে অদম্য বুড়ো সান্টিয়াগোর জীবন সংগ্রামের মাহাত্ন্য! এরকম কিছু বই পড়তাম, ঘোরগ্রস্থ হয়ে থাকতাম, কিন্তু এর কারণ কি তা বুঝতে পারতাম না।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম এডগার এ্যলেন পো’র ভৌতিক গল্পগুলোও। ‘মাংকিস্ প’সহ কিছু কিছু গল্প এখনো মনে আছে। সম্ভবতঃ তখন কলেজের কোনো পাঠ্য বইতে ছিল গল্পটা। তার গল্প পড়ে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, এমনকি একা থাকলে দিনের বেলাতেও ভয় পেতাম, তবু নেশার মতো লাগতো গল্পগুলো পড়লে (প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি কবিতাপ্রেমী মানুষ না, তবু কলেজে উঠে এলেন পো’র একটা কবিতা ‘দ্যা র‌্যাভেন’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম ও তা খাতায় লিখে রেখেছিলাম)। পড়েছিলাম জুল ভার্নের লোমহর্ষক সব এডভেঞ্চারের কাহিনী। এভাবে আমার সামনে দিনে এক অবিশ্বাস্য, বিচিত্র ও অসীম জগত খুলে দিতে শুরু করলো নানা ধরনের বই।

৪.
বই যখন পড়া শুরু করলাম দেখলাম এর উৎসের কোন শেষ নেই। বন্ধু আর পরিবারের সদস্যরা তো আছেন, ওয়েষ্ট এ্যন্ড স্কুলের লাইব্রেরী থেকেও বই আনতাম। লালবাগে অল্প টাকার ধারে বই আনার জন্য একটা সমিতি ধরনের কিছু ছিল। হানিফ সেখান থেকে বই আনলে আমাদের পড়তে দিতো। অল্প বয়স থেকে টিউশনি করতাম। টিউশনির ছাত্র-ছাত্রীর বাসায় গল্প-উপন্যাসের বই পেলে নিয়ে এসে পড়তাম।

এতো বই পড়তাম, কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে ছোটবেলায় কবিতার কোন বই পড়েছি বলে মনে পড়ে না। পড়ার বইতে জসীমউদ্দিন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালো লাগতো। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর জন কীটসের দুএকটা কবিতা ভালো লাগতো। সুকুমার রায়ের ছড়া ভালো লাগতো। কিন্ত গোটা একটা কবিতা বা ছড়ার বই পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। এমনকি বড় হয়েও জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, হুমায়ূন আজাদ ও ইমতিয়াজ মাহমুদের মতো জনাকয়েক কবির বই পড়েছি।

নিজের টাকায় আমি ঠিক কবে বই কিনেছি মনে নেই। ম্যাট্রিকে ষ্ট্যান্ড (মেধা তালিকায় স্থান অর্জন) করার পর একসাথে অনেক টাকা স্কলারশীপ পেয়েছিলাম। নিউমার্কেট থেকে কিছু বই কিনেছিলাম। অধিকাংশ সেবা প্রকাশনীর। এরমধ্যে প্যাপিলনের কথা এখনো ভুলিনি, বড় হয়ে প্যাপিলন ছায়াছবিটা দেখেছি সমান আগ্রহ নিয়ে। এখানে বলে রাখি: জেলজীবনভিত্তিক সিনেমা আমার খুব পছন্দের, এরমধ্যে সেরা হচ্ছে বহু পুরস্কৃত ‘শশাংকস্ রিডেমশন’ নামের ছায়াছবিটি।

আমাদের ছোটবেলায় কম্পুটার ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, এমনকি ফোনও ছিল না (অল্প কিছু ল্যান্ড ফোন বাদে)। টেলিভিশন ছিল পাড়া-মহল্লার দুএকটা বাড়ীতে, সেখানেও বিটিভি ছাড়া কিছু দেখার উপায় ছিল না। কাজেই চেনা পৃথিবীর বাইরের জগতটা দেখার একমাত্র উপায় ছিল বই আর পত্রিকা পড়া।

ছোটবেলায় আমার ভ্রমণকাহিনী আর ইতিহাস খুব ভালো লাগতো। পত্রিকার পাতায় যতোটুকু পাওয়া যেতো পড়তাম। খুব জানতে ইচ্ছে করতো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা আর দ্বীপদেশের গল্প। এখনো সময় পেলে যুদ্ধের ছবি দেখি (‘সেভিংস প্রাইভেট রায়ান’, ‘ডানকার্ক’, ‘হ্যাকসো রীজ্’, ‘নাইটন সেভেনটিন’― আমার প্রিয় কিছু ছবির নাম)। দ্বীপ দেশের উপর ইউটিউবে নানা ভিডিও দেখি। সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আমার ছাত্রদের তাহিতি, পিট কেয়ার্নস বা গেলাপেগাস আর্কিওপলিস-এর গল্প বলি। দ্বীপ দেশের গল্প নিয়ে শিশু-কিশোর উপযোগী একটা বই লেখারও ইচ্ছে আছে আমার।

এখন আমি নিজে বই লিখি। গল্প-উপন্যাস-গবেষণা যাই লিখি আনন্দ পাই। যখনি সময় পাই পড়ি। ধর্মের বই, দর্শনের বই, রাজনীতির বই, ইতিহাস-অর্থনীতি, খেলার রিপোর্ট যখন সময় পাই পড়ি। গাড়ীর ভেতর পড়ি, টয়লেটে বসে পড়ি, ঘুমানোর আগে পড়ি। বই কেনার সামর্থ হওয়ার পর যেটা ইচ্ছে হয় কিনি। আমার বাসা থৈ থৈ করতে থাকে নানরঙ্গের, নানা সাইজের নানা বয়েসী বইয়ে। মনে হয়, কত বই পড়া হয়নি, কত বই পড়েছি অনেক দেরীতে!

গত কয়েকমাসে আহমেদ ছফার ‘অলাতচক্র’, পাওলো কোয়েলহোর ‘আল কেমিষ্ট’, লেজলি হ্যাজলেনটনের ‘দ্যা ফার্ষ্ট মুসলিম’ পড়েছি। এগুলো অনেক আগে পড়া উচিত ছিল। এখন পড়ছি আনু মুহাম্মদের ‘চীন, পরাশক্তির বিবর্তন’ নামক গ্রন্থ। বই পড়ার সময় পাইনা বেশী। আফসোস হয় সময় যখন ছিল, তখন কেন পড়িনি।

৫.
আমরা একটা ক্ষুদ্র জীবন যাপন করি। মহাকালের হিসেবে কয়েকটা মিলিসেকেন্ড বড়জোর বেঁচে থাকি। মহাজগতের হিসেবে বড়জোড় একটা বালুকণার ওপর জীবন যাপন করি। অথচ বই আমাদেরকে সময় আর স্থানের এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়। হুমায়ূন আহমেদের একটা বৈজ্ঞানিক কল্পনাকাহিনী আমাদেরকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে নিয়ে যায়। শওকত আলীর একটা উপন্যাস আমাদেরকে আটশত বছরের আগের সেনযুগে নিয়ে যায়। ইয়োভাল নোআ হারিরি আমাদেরকে নিয়ে যান ১৪ লক্ষ বছর আগে।

বই ছাড়া কার সাধ্য আছে আমাদেরকে এই বিশাল জীবনে ভ্রমণ করানোর! কিংবা নিজের জীবনের পাশাপাশি আরো বহু জীবন যাপনের সুযোগ দেয়ার! আরো বহু মানুষ, সময়, সংকট, স্বপ্ন ও সভ্যতাকে জানানোর!

(আমার এই লেখাটি ‘স্কুলদিনের বই পড়া’ নামক গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়, প্রতীক থেকে। এতে দেশের আরো ১৪ জন লেখকের লেখা রয়েছে।)

* আসিফ নজরুল লেখক-ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *