ইকবাল নয়, খণ্ডিত ভারত চেয়েছেন লালা লাজপত : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বিশিষ্ট ভারতীয় আইনবিদ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং বহু রাজনৈতিক ও আইনি গ্রন্থ প্রনেতা এ, জি নূরানি ভারত-বিভাগকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়কর দশটি ঘটনার অন্যতম বলে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, “ভারতের স্বাধীনতা অর্জন অপরিহার্য ছিল, কিন্তু ভারতকে বিভক্ত করা কোনোভাবেই অনিবার্য ছিল না। ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব হলে সেটিই হতে পারতো নানা জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্রে সমৃদ্ধ ভারতের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এজন্য প্রয়োজন ছিল উচ্চ মেধাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কত্বের, ভারতে যার অনুপস্থিতি ছিল প্রকট। এই ঘাটতির সঙ্গে অন্যান্য যে কারণগুলো যুক্ত হয়ে আমাদেরকে সেই কাঙ্খিত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেছে, সেসবের মধ্যে ছিল – ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ঔদ্ধত্য, বিভ্রান্তিকর হিসাবনিকাশ এবং শীর্ষ জাতীয় নেতৃত্বের সংকীর্ণ মনমানসিকতা।”

তিনি আরও বলেছেন, “মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের ওপর ভারতকে ভাঙার দায় বেশি চাপানো হয়, যেহেতু তারা পাকিস্তান দাবি করেছিল এবং দাবি পূরণের জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ হিন্দু নেতৃত্ব দেশ বিভাগের দায় এড়ানোর পরিস্থিতিতে ছিল না। বরং ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে ভারতকে অখণ্ড রাখার জন্য তাদের যে উদার ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল, তারা তা করার পরিবর্তে স্বাধীন ভারতের বাইরে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এজন্য কংগ্রেসের শীর্ষ মুসলিম নেতা এবং কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সরাসরি দায়ী করেছেন জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ও ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে।”

এ সম্পর্কে আমি আমার “মুসলিম লীগ নয়, ভারত ভেঙেছে কংগ্রেস” নিবন্ধে মাওলানা আজাদের আত্মজীবনী “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” থেকে প্রয়োজনীয় অংশের উদ্ধৃতি দিয়েছি। কংগ্রেস নেতৃত্ব, অর্থ্যাৎ জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেল মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনোভাবেই সমঝোতায় আসতে না পেরে তড়িঘড়ি ১৯৪৬ সালে ভারত বিভাগের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, ব্যাপারটি আদৌ তা ছিল না। এ ব্যাপারে এ.জি নূরানি তার নিবন্ধে আরও বলেছেন:, জিন্নাহ তাঁর ‘টু নেশন থিয়োরি’ বা দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ ঘোষণা করার ১৬ বছর আগে আধা-সামরিক উগ্র হিন্দু সংগঠন ‘আরএসএস’ এর প্রধান উপদেষ্টা বা পরামর্শদাতা, হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামে এক নিবন্ধে ‘টু নেশন থিয়োরি’র ধারণার প্রবর্তন করেন।”

সাভারকরের ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ প্রবর্তনের এক বছর পর ১৯২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘পাঞ্জাব সিংহ’ খ্যাত বিপ্লবী ও কংগ্রেস নেতা লালা লাজপত রায় ‘দ্য ট্রিবিউন’ সংবাপত্রে এক নিবন্ধে তাঁর ভারত বিভাগ পরিকল্পনার প্রস্তাবনা প্রকাশ করেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের “মুসলমানরা চারটি মুসলিম রাষ্ট্র পাবে: (১) পাঠান প্রদেশ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত; (২) পশ্চিম পাঞ্জাব; (৩) সিন্ধু এবং (৪) পূর্ব বাংলা। ভারতের অন্য কোনো অংশে যদি মুসলিম ঘনত্ব থাকে, যা একটি প্রদেশ গঠনের মতো যথেষ্ট বড় হয়, তাহলে তারাও অনুরূপভাবে একটি প্রদেশ গঠন করতে পারবে। কিন্তু এটা সুনির্দিষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, এটি কোনো অখণ্ড ভারত হবে না। এটি হবে ভারতকে সুনির্দিষ্টভাবে ‘একটি মুসলিম ভারত’ এবং ‘একটি অমুসলিম ভারতে’ বিভক্ত করা। পাঞ্জাব এবং বাংলাকে বিভক্ত করতে হবে।”

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ‘টু নেশন থিয়োরি’ যৌক্তিকতা লাভ করে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধে ভারতবাসীর সহযোগিতা কামনা করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকারী সকল পক্ষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যুদ্ধ শেষ হলেই তারা একটি সংবিধান প্রণয়নের কাঠামো তৈরি এবং সংবিধান প্রণয়ন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, অর্থ্যাৎ তারা ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করে তাদের প্রায় দুশো বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত থেকে বিদায় নেবে।

সমগ্র বিশ্ব ভারতের স্বাধীনতার যে সূর্যোদয় দেখার অপেক্ষা করছিল, তার পরিবর্তে তারা ১৯৪৭ সালের গ্রীস্মকালে প্রত্যক্ষ করলো মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্ধ নেতার কারণে ভারত ভাঙার পরিণতিতে ভারতবাসীর পারস্পরিক সংহার ও ধ্বংসের স্বাধীনতা।

বিপ্লবী উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ১৯৪৭ সালে ‘সুবহ-এ-আজাদি’ বা ‘স্বাধীনতার ভোর’ নামে কবিতায় মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ওপর আলোকপাত করেছেন এভাবে:

“ইয়ে দাগ দাগ উজালা, ইয়ে শব-গাজিদা সেহর,
ও ইন্তেজার থা জিস কা, ইয়ে ও সেহর তো নেহি,
কে ওহ সেহর তো নেহি, জি কি আরজু লেকর
চলে থে ইয়ার কি মিল জায়েগি কাহি না কাহি
ফলক কে দাশত মে তারোঁ কি আখিরি মনজিল।

(রক্তের মাখা এই ভোর, রাত কুরে কুরে খাওয়া ভোর,
আমরা যে ভোরের প্রতীক্ষা করেছি, এটা তো সেই ভোর নয়,
এটা সেই ভোর নয়, যে স্বাধীনতার আশায় উদ্বেল ছিলাম,
ভেবেছিলাম কোথাও না কোথাও তো বন্ধুর দেখা পাবো,
নিশ্চিত ছিলাম মরুভূমিতে কোথাও আকাশ আশ্রয় নিয়েছে
তারার জন্য একটি শেষ আশ্রয় আমরা খুঁজে বের করবো।)

পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবিও দেশ-ভাগ চাননি:

শীর্ষস্থানীয় কোনো মুসলিম নেতার ভারত ভাঙার উদ্দেশ্য না থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভারত বিভক্ত হয়েছে এবং ছিয়াত্তর বছর আগে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভুত দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সূচনাকাল থেকেই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে এবং দেশ দুটির নাগরিকরা এর চরম মূল্য দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিপুল রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা আনতে হয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু সাতচল্লিশ পূর্ব অখণ্ড ভারতের এই তিনটি ভূখণ্ডে অদ্যাবধি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করার কারণে স্কুলে পাঠক্রমের অংশ হিসেবে আমি পাকিস্তানের জাতীয় নেতা কায়দে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রমুখের জীবনী পাঠ করে বেড়ে উঠেছি।

তাদের কারও কারও জীবন, কর্ম ও মহত্ব কিশোর মনে প্রভাব বিস্তার করেছে, যার অন্যতম ছিলেন কবি ইকবাল। রাজনীতির বোধ গড়ে উঠার আগেই পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও বঞ্চনা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং প্রমাণিত হয়েছে যে, মুসলিম বিদ্বেষী কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা বিধায়ক সাভারকরের দেওয়া ‘টু নেশন থিয়োরি’ হোক অথবা পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ‘টু নেশন থিয়োরি’ হোক, দুটিই ছিল অন্ততপক্ষে ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে উদ্ভট ও অসার।

কিন্তু আসলে এর ভিত্তিতে যে অখণ্ড ভারত বিভাজিত হয়নি তা সাভারকরের দ্বিজাতিতত্বের অসারতা থেকে স্পষ্ট। কিন্তু তর্কের খাতিরেও যদি ধরে নেয়া হয় যে, জিন্নাহর দেয়া দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়ার ফলে প্রকৃত অর্থে কারও লাভ হয়নি। অথবা কোনো পক্ষের যদি লাভ হয়েও থাকে বা কোনোভাবে ‘টু নেশন থিয়োরি’র সুফল পেয়ে থাকে এবং তারা যদি তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বে আদৌ বিশ্বাস না করে, তাহলে তাদের উচিত এহেন কান্ডজ্ঞানহীন তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে এই তত্ত্বের আগের অবস্থা অর্থ্যাৎ সাতচল্লিশ-পূর্ব অখণ্ড ভারতে লীন হওয়া।

ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচিতে অবস্থিত ‘আরকেডিএফ ইউনিভার্সিটি’র পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ স্কলার ড. এস, কে আবদুল আমানুল্লাহ তাঁর এক গবেষণা নিবন্ধে কবি ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ওপর আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন, “কবি ইকবাল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে ভারতে মুসলমানদের দুরবস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার বিষয়গুলো অনুধাবন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বা অখণ্ড ভারতে অন্তর্ভূক্ত থেকেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। তিনি নি:সন্দেহে পাকিস্তান চেয়েছেন, কিন্তু ভারত ভাঙতে চাননি।

“পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা খ্যাত আল্লামা ইকবাল চেয়েছিলেন ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত্বশাসন। তিনি কখনও ভারতকে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে বিভক্ত করার পক্ষে ছিলেন না। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ কর্তৃক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের দুই বছর আগে ১৯৩৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করায় মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি গড়ার উন্মাদনা এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের ভয়াবহ পরিণতি তাকে দেখে যেতে হয়নি।

অবশ্য ইতিহাস সাক্ষী যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও ভারত বিভাগকে সাময়িক বন্দোবস্ত হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুসলিম লীগের সঙ্গে আপসের সম্ভাবনা নেই বিবেচনায় অথবা মুসলিম লীগকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের ওপর ভারত বিভাগ চাপিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাম নেহরু এবং কংগ্রেসে কট্টর মুসলিম বিরোধী নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সহযোগী হিসেবে তারা পেয়েছিলেন ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে এবং এজন্য তারা তাঁকে উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করে।”

ড. আবদুল আমানুল্লাহ আরও বলেছেন, “ইকবাল একজন কবি, দার্শনিক, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত্বশাসনের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। কিন্তু কেবল এই বিচারে ইকবালকে পাকিস্তানের প্রধান স্থপতি বিবেচনা করা যায় না। তাঁর মূল উদ্বেগের স্থান ছিল ব্রিটিশ শাসনে অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে চলে যাওয়া ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং তাদেরকে সে অবস্থা থেকে অতীতের গৌরবময় অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার উপায়। ইকবাল ভারতীয় ইউনিয়নের বাইরে মুসলমানদের পৃথক ভূভণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন বলে মুসলিম লীগ সবসময় ১৯৩০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে প্রদত্ত ড. ইকবালের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। কিন্তু এর পর তিনি আর কখনও ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার কথা উচ্চারণ করেননি। তিনি ১৯২০ এর দশক থেকেই ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের পৃথক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি তার কবিতা ও ধর্মীয় দার্শনিক হিসেবে নিজেকে উপমহাদেশে ইসলামী আধুনিকতার শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলেন এবং তার প্রভাব এখনো উপমহাদেশ জুড়ে অনুভূত হয়। তার কাজের ওপর গবেষণা পরিচালিত হয়।”

১৯৪৭ সালে ভারতকে ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন সাবভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভারত বিভাগের জন্য এখনো হিন্দুরা মুসলমানদের এবং মুসলমানরা হিন্দুদের দায়ী করে। কারা দেশ বিভাগের মূল স্থপতি, তাদের কখা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নি। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী উগ্র দলগুলো সব জেনেশুনে মুসলমানদের ওপর ভারত বিভাগের দায় চাপিয়ে এসেছে। ভারতে পৃথক পৃথক হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান রাষ্ট্রে বিভক্ত করার ইঙ্গিত দিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলেছেন হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। সাভারকরের মতে, ভারতে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনরা প্রকৃত অর্থে ভারতে জন্মগ্রহণকারী হিসেবে এক জাতি এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বহিরাগত ও ভিন্ন জাতি।

অতীতের বিষয়গুলো এখন আবার আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে। যারা পড়াশোনা করে জানার চেষ্টা নাও করতে পারতেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের সামনে এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করছে, যা তাদেরকে ক্রমবর্ধমানভাবে কৌতুহলি করে তুলছে ভারত ভাঙার প্রকৃত সত্য জানতে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দুটি মুখ্য প্রশ্ন : ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হলো কেন, এবং ভারত বিভাগ অনিবার্য ছিল কিনা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক প্রশ্ন এখন ইতিহাসবিদদের তাড়া করে ফিরছে।

ভারত বিভাগের কার্যকারণ নিয়ে অতীতে অনেক ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও গবেষণার ধাঁধাঁ এখনো সমাধানের বাইরে রয়ে গেছে। এমনকি একটি কারণ নিয়ে বিতর্কের অবসান হলেও দেখা যায়, দেশ বিভাগ নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, যা পূর্বে দেয়া ব্যাখ্যার চেয়ে জটিল। যেমন, কবি ইকবালের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা। তিনি পাকিস্তান ও ভারতে একজন মহান কবি হিসেবে সমাদৃত ও শ্রদ্ধাভাজন এবং ১৯০৪ সালে তাঁর লেখা “তারানা-ই-মিল্লি’র সংক্ষিপ্ত একটি অংশ এখনো ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশিত হয়ে আসছে:

“সারে জাহাঁ সে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা,
হাম বুলবুলে হ্যায় ইস কি ইয়ে গুলসিতা হামারা,
মাজহাব নেহি সিখাতা আপস মে বৈর রাখনা,
হিন্দি হ্যায় হাম, ওয়াতান হ্যায় হিন্দুস্তাঁ হামারা।”

(সমগ্র বিশ্বে আমাদের হিন্দুস্থান সেরা দেশ,
আমরা এর বুলবুলি, এটিই আমাদের বাগান।
ধর্ম আমাদের নিজেদের মধ্যে শত্রুতা শেখায় না,
আমরা হিন্দুস্তানি, আমাদের দেশ হিন্দুস্তান।)

১৯৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে আল্লামা ইকবাল ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমি পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে একটি রাষ্ট্রে মিলিতভাবে দেখতে চাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে অথবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছাড়া স্ব-শাসিত, একটি সংহত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠন আমার কাছে অন্তত উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চূড়ান্ত নিয়তি বলে মনে হয়।” জিন্নাহর কাছে মনে হয়েছিল যে, এটি মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শান্তিপূর্ণ ভারত নিশ্চিত করা একমাত্র উপায় হতে পারে।

আর যদি তা অসম্ভব হয়, তাহলে একমাত্র বিকল্প হবে গৃহযুদ্ধ, যা ইতোমধ্যে ভারতের বিভিন্ন অংশে ধূমায়িত হতে শুরু করেছিল। ইকবাল তখন বিপুলভাবে পাশ্চাত্য দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তাদের দর্শন আরো অধ্যয়নে তার যে উপলব্ধি ঘটে, তিনি তার বক্তব্যে অধিকতর সতর্ক হয়ে জনগণকে আহবান জানান, তারা যাতে পাশ্চাত্যের অগভীর চিন্তাধারায় বিভ্রান্ত না হন। কারণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম মানবতার সমস্যা সমাধানে নিদারুণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিল। তার নিজ ভূখণ্ডে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নি:সন্দেহে হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

সেজন্য তিনি মুসলিম জাতিসত্তার ব্যাখ্যায় না গিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর একটি ভৌগোলিক সীমারেখা বিবেচনা করেছিলেন ভারতীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে। তিনি “ভাষাগত ও অর্থনৈতিক সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকাসমূহ নিয়ে ফেডারেল ভারতের” ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

জওহরলাল নেহরুকে লেখা এক চিঠিতে ইকবাল বিষয়টি আরও পরিস্কার করেন: “জাতীয়তাবাদ কোনো নাগরিকের দেশের প্রতি ভালোবাসার বোধ এবং মুসলিম বিশ্বাসের অংশ হলো তার দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় যদি ভারতের আট কোটি সংখ্যালঘুকে ন্যূনতম নিরাপত্তার নিশ্চয়তার আশ্বাস না দিয়ে তাদের ধরনের জাতীয়তাবাদ তাহলে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান অসম্ভব ব্যাপার।”

তিনি ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দেন যে, মুসলমানরা যখন ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত অবস্থাতেও ছিল, তখন ভারতীয় মুসলমানরা নিজেদের ভারতীয় সত্তায় মিলিয়ে নিয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের হিন্দু প্রতিবেশিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু তারা কখনও আদর্শিক সমঝোতা করেনি। তিনি তার দীর্ঘ লালিত ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ও ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি দাবির মধ্যে সাংঘর্ষিক কিছু দেখেননি; বরং একটিকে আরেকটির পরিপূরক হিসেবে দেখেছেন।

ইকবালের মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা ভারত বিভক্তিকে আদর্শিকভাবে কিছুটা প্রভাবিত করলেও তাঁর ধারণা ভারতকে বিভক্তির দিকে নিয়ে যায়নি। বরং তার ধারণা কমবেশি স্যায়র সাইয়িদ আহমদ খানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ইকবাল ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন এবং কখনও ভারতীয় মুসলমানদের ভিন্ন একটি জাতি হিসেবে ঘোষণা করেননি, যা পরবর্তী সময়ে জিন্নাহ করেছিলেন, যে জাতির জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাকেও জিন্নাহ জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত করতে সফল হয়েছিলেন।

পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান ইতিহাসবিদ আয়েশা জালাল তার “দ্য সোল স্পোকসম্যান: জিন্নাহ, দ্য মুসলিম লীগ এন্ড দ্য ডেমান্ড ফর পাকিস্তান” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “১৯৪৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান একটি বাস্তব সিদ্ধান্তে পরিণত হতে পারেনি। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তান দাবিকে দরকষাকষির অবস্থান উপায় হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা অন্যান্য সম্ভাব্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রস্তাবগুলোকে তাদের বিবেচনা থেকে বাদ দেয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে আল্লামা ইকবালকে সম্ভাবনার একটি বড় পরিসরে ভূমিকা পালন করতে করতে দেখা যায়। আদর্শগতভাবে তিনি জাতি ও জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন। তার কাছে জাতীয়তাবাদ যদি ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ না হয়ে থাকে, তাহলে তা ইসলামের সর্বজনীন দিকগুলোর পরিপন্থী।

ইকবালের ভৌগোলিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। তিনি তার বর্ণিত অঞ্চলগুলোকে অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভূক্ত রাখতে চেয়েছিলেন এবং ফেডারেল আইনসভায় দেশের বাকি অংশের মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, এই অঞ্চলগুলোকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রদান করার অর্থে। এলাহাবাদের ভাষণে ইকবাল আরও বলেছিলেন, ‘আমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি করছি না। কোনো ভারতীয় মুসলমান বিবেক-বুদ্ধির ভান করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বাইরে একটি মুসলিম রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহের কথা ভাবে না।”

তিনি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও এই মর্মে পরামর্শ দিয়েছিলেন: “আমি মনে করি, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং বাংলার মুসলমানদের বর্তমানে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ হিসেবে অগ্রাহ্য করা উচিত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু প্রদেশের স্বার্থেই এটা গ্রহণ করাই উত্তম।” রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ইকবাল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের অধিকতর স্বায়ত্তশাসনসহ ক্ষমতার ফেডারেল বিভাজন বোঝাতে চেয়েছিলেন, কোনোভাবেই ভারত বিভক্ত করা নয়।

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *