ছাত্ররাজনীতি আর ক্ষমতার দাপট এক নয় ।। কামাল আহমেদ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবির মুখে ছাত্রলীগের ঘোষণা ছিল, ‘যেকোনো মূল্যে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি দেখতে চাই’। মানতেই হয়, আদালত আমাদের ‘যেকোনো মূল্য’ দেওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। ছাত্রলীগের মূল্য অর্থাৎ ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বিভিন্ন ধরনের মূল্য আদায়ের কথা স্মরণ করে দেখুন।

বলে নেওয়া ভালো, বর্তমানের ছাত্রলীগ আর স্বাধীনতাসংগ্রাম ও গণতন্ত্রের জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রলীগ এক নয়। গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের ভূমিকা একেবারে বদলে গেছে। সংগঠনটি এখন ক্ষমতা ও একচেটিয়া দাপট প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

ছাত্রলীগ করলে হলে থাকার ব্যবস্থা হয়, চাকরি মেলে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও নানা রকম সুযোগ তৈরি হয়। আর সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটোই ঘটে। এর ফলে ছাত্রলীগ নেতারা এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন যে প্রশাসনিক শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরাও তাদের তোয়াজ করে চলেন।

সব ধরনের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি, কেনাকাটায় এদের অদৃশ্য ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের কমিশন নিয়ে ফাঁস হওয়া টেলিফোনের আলাপের কথা তো বেশি দিন আগের কথা নয় (টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে রাব্বানীর ফোনালাপ ফাঁস, ইত্তেফাক, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। সেই আলাপের জেরে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে পদচ্যুত হয়েছিলেন।

দেশে এমন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যেখানে ছাত্রলীগের ক্ষমতার দাপট এবং বিচিত্র সব অপরাধমূলক কাজের নজির নেই। এগুলোর ক্ষেত্রে আরও দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এসব ঘটনায় কোথাও কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা আছে, নয়তো তারা একেবারেই নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগরের কমিশন বিষয়ক কেলেঙ্কারিতে যেমন তৎকালীন উপাচার্যের নাম ছিল, তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর হাতে নিহত ছাত্রলীগেরই আরেকজন নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডে একজন প্রক্টরের যুক্ততার অভিযোগ ছিল।

২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অকালে প্রাণ হারান টাঙ্গাইলের দিনমজুর বাবার সন্তান আবু বকর সিদ্দিক; পড়তেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। বিরোধের বিষয় ছিল হলের সিট দখল।

এর কয়েক বছর পর ছাত্রলীগের গেস্টরুম সংস্কৃতির শিকার হয়ে শীতের সময়ে রাতভর খোলা আকাশের নিচে থেকে নিউমোনিয়ায় মারা যান ফরিদপুরের অটোরিকশা চালক ইসহাক মোল্লার ছেলে হাফিজুর মোল্লা। মৃত্যুর মাত্র মাসখানেক আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে।

২০১৬ সালে প্রথম আলোতে সোহরাব হাসানের কলাম (হাফিজুর-আবু বকরদের জন্য দুফোঁটা অশ্রু) থেকেই জানা যায়, ছাত্রলীগের সহিংসতায় আরও যাঁদের প্রাণ গেছে, এ রকম কয়েকজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঈদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপস পাল এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমন চন্দ্র দাসের কথা। যেখানে কোনো রাজনীতির জন্য একজনের মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য বা সহনীয় নয়, সেখানে ছাত্রলীগের ক্ষমতার আধিপত্য ধরে রাখার লড়াইয়ে মৃত্যুর মিছিল কিন্তু থামেনি।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অনাচারে আরও যাঁরা নিহত হয়েছেন কিংবা পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে তাঁদের তালিকা করা হলে একটি নিবন্ধে তার স্থান সংকুলান হবে কি না সন্দেহ। তবে সবকিছুর মধ্যে যে নিষ্ঠুরতার ঘটনা সারা দেশকে আলোড়িত করেছিল, সেটি হচ্ছে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড।

শিবির সন্দেহে আবরারকে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে ভোররাতে তাঁকে ফেলে রাখা হয় শেরেবাংলা হলের প্রবেশমুখের বারান্দায়। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য প্রকাশই ছিল তাঁর অপরাধ।

গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে আরও যে প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। হাইকোর্টে ছাত্রলীগ নেতার রিট আবেদনের শুনানিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না কেন, তা মোটেও বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেবেন, এমন ভরসার কারণ কী? তা ছাড়া কেন বিশ্ববিদ্যালয় তার সিন্ডিকেটে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে আপিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি?

আবরার ফাহাদ হত্যার বিচার হয়েছে এবং ওই হল শাখা ছাত্রলীগের ২৫ জন দণ্ডিত হন। আবরার হত্যার কারণেই বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে।

আবরার হত্যাকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে ছাত্রলীগের দাপটের কাছে কর্তৃপক্ষ কতটা অসহায় ছিল এবং যে কারণে ছাত্রাবাসে নির্যাতনের ঘটনা তারা ঠেকাতে পারেনি। আবার সরকার বিরোধীদের মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টির একটি পছন্দনীয় কৌশল হচ্ছে তাদের শিবির অভিহিত করা। শিবিরের কার্যক্রমের রাজনৈতিক বিরোধিতা তখন শক্তি প্রয়োগে দমনের রূপ নেয়। অথচ শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

লক্ষণীয় হচ্ছে এবারেও ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে তাদের সংগঠন করার অধিকার দাবি করতে গিয়ে তারা দাবি করেছে শিবির এবং নিষিদ্ধঘোষিত হিযবুত তাহ্‌রীর নাকি বুয়েটে তৎপরতা চালাচ্ছে।

অভিযোগটি আওয়ামী লীগের নেতাদেরও পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয়, কেননা দলের একাধিক নেতা ও মন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বুয়েটকে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হতে দেওয়া হবে না। তাঁরা কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, সেই প্রশ্ন তাই মোটেও উপেক্ষণীয় নয়।

সরকার গত কয়েক বছর যেভাবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে ও হুমকি দূর করার দাবি করেছে, তাতে গত পাঁচ বছরে তো বুয়েটের কোনো ছাত্রছাত্রীর গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। পুলিশের গোয়েন্দা শাখাগুলোও তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে বসে নেই। তাদের মুখ থেকে বুয়েটে জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কার কথা শোনা যায়নি। তাহলে বুয়েটে ছাত্রলীগকে প্রবেশের যৌক্তিকতা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া তো এই প্রচারের কোনো কারণ দেখি না।

ছাত্রজীবনে ব্যক্তিগতভাবে আমি ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম বিধায় আমি ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নই। আমাদের সময়টা ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের সময় এবং তাই তাতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি এভাবে প্রকট ছিল না। কিন্তু বর্তমানের সমস্যা ছাত্ররাজনীতি নয়, ওই খোলসে ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের পক্ষে চর দখলের রাজনীতি ও দখলদারি বজায় রাখার জন্য সৃষ্ট ত্রাসের রাজত্বের অবসান।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের খোলাচিঠিতে তাই উচ্চারিত হয়েছে, ‘বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র‍্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন ও খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনার। ঘটেছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও।’

রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি এবং একদলীয় আধিপত্যের ইতি ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রসংগঠন এ রকম বেয়াড়া দুর্বৃত্তপনার আখড়ায় পরিণত হবে না। দুর্বৃত্তপনার নতুন নতুন যেসব নজির তৈরি হয়েছে, তা হতাশার ও লজ্জার। জাহাঙ্গীরনগরে ক্যাম্পাসে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা এ রকমই এক নজির।

চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, ময়মনসিংহের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক যৌন হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনাগুলোও একই রকম আধিপত্য ও দুর্বৃত্তপনার নজির। এ আধিপত্যের অবসান দরকার। এ কারণে বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের দাবিকে অবাস্তব কিংবা গণতন্ত্রবিরোধী বলা যাবে না। বুয়েটের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতিতে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধের কথা বলেনি।

গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে আরও যে প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। হাইকোর্টে ছাত্রলীগ নেতার রিট আবেদনের শুনানিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না কেন, তা মোটেও বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেবেন, এমন ভরসার কারণ কী?

তা ছাড়া কেন বিশ্ববিদ্যালয় তার সিন্ডিকেটে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে আপিলের সিদ্ধান্ত নেয়নি? আদালতের আদেশ নিশ্চয়ই চূড়ান্ত, কিন্তু আপিল সাপেক্ষ হলে কেন সেই সুযোগ নেওয়া হবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও ছাত্র-শিক্ষকদের জীবনের নিরাপত্তাবিধানে আচরণবিধি তৈরি ও কার্যকরের অধিকার কীভাবে গণতন্ত্র ও সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারে? সুপ্রিম কোর্টও তো আদালত প্রাঙ্গণে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। সব প্রতিষ্ঠানেই নিজস্ব শৃঙ্খলাবিধি থাকবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকারের প্রশ্নে আমাদের উচ্চ আদালত যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, আশা করি সরকারবিরোধীদের সভা-সমাবেশের অধিকার হরণের সব চেষ্টার বিরুদ্ধেও তাঁরা একই ভূমিকা নেবেন। দুঃখজনকভাবে এত দিন যা দেখা যায়নি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এটি খুবই জরুরি।

* কামাল আহমেদ সাংবাদিক-কলামিস্ট, সাবেক সম্পাদক বিবিসি বাংলা ও প্রথম আলোর সাবেক কনসাল্টিং এডিটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *