মাহে রামাদ্বানে রোজা পালনে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ।। ডা. আমিনুল ইসলাম

ধর্ম ও দর্শন সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য
শেয়ার করুন

ভূমিকা

মাহে রামাদ্বানের সিয়াম সাধনা ইসলামের একটি অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। পবিত্র রামাদ্বান মাসে প্রতিটি মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীকে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়। এ লেখায় আমরা কিভাবে সুস্থ থেকে সিয়াম সাধনা করতে পারি সে বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে কিছু পরামর্শ রাখছি।

রামাদ্বানে স্বাস্থ্য সচেতনতার গুরুত্ব

ইসলামের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। সেখানে আমাদের মূলত প্রয়োজন হচ্ছে আর্থিক সামর্থ্য। যাকাতের সাথে রামাদ্বানে রোজা পালনকে যদি আমরা তুলনা করি, দেখা যাবে এখানে ইবাদতের জন্য একটি মৌলিক প্রয়োজন হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। তার পাশাপাশি রামাদ্বানে আমাদের অনেক বাড়তি ইবাদত করতে হবে। যেমন- ব্যক্তিগতভাবে কুরআন খতম করা, লম্বা তারাবির নামাজ আদায় করা, সেহরীতে নির্দিষ্ট সময়ের আগে উঠা এবং সেজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তার সাথে আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় অনেক Controllable Diseases নিয়ে জীবনযাপন করি। যেমন- হাই ব্লাড পেশার, ডায়াবেটিস। রামাদ্বানে আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে এই কন্ট্রোলেবল ডিজিসগুলোকে নিয়ন্ত্রনে রেখে রোজা রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। অতএব আমাদেরকে অন্যান্য মাসের তুলনায় রামাদ্বান মাসে ইবাদত পালন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য আরোও বেশী স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া একান্ত জরুরী।

ব্যালেন্সড ডায়েট

আমরা জানি একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য “ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের” পক্ষ থেকে সারাদিনের একটা সুষম খাদ্যের ফর্মূলা আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রয়োজনীয় প্রফেশন অনুযায়ী আনুপাতিক হারে ফ্যাট, প্রটিন, কার্বহাইড্রেড, মিনারেলস, ওয়াটার এবং ফাইবার (শাক সবজি আর ফলমূল) রয়েছে। যা কিনা একজন পুরুষের জন্য দৈনিক প্রায় ২৫০০ ক্যালোরী এবং মহিলাদের জন্য ২০০০ ক্যালোরী শক্তি যোগান দিয়ে থাকে। রামাদ্বানের ব্যালেন্সড ডায়েটের মূলনীতি হচ্ছে আমরা ইফতার এবং সেহেরির সময়ের মাঝে ঐ পরিমাণ খাদ্যকেই গ্রহণ করবো।

আমরা সাধারণত খেজুর দিয়েই শুরু করি। এটি সুন্নাহ এবং এতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেড এবং অন্যান্য নিউট্রিন মিনারেলস রয়েছে। তারপরেই যে বিষয়ে নজর দেয়া দরকার, তা হচ্ছে আমাদের শরীরকে হাইড্রেড (Hydrate) করা অর্থাৎ দীর্ঘ সময় রোজা থাকার ফলে শরীরে যে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে সেটা যতো দ্রুত সম্ভব পূরণ করা। তার পাশাপাশি একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ইফতারটা যেন বড় ধরণের ভোজের ব্যবস্থা না হয়ে সুষম খাদ্যের আলোকে হয়ে থাকে।

সেহরির সময় একটা দিকে আমাদের খেয়াল রাখা দরকার যে, ব্যস্ততার কারণে কেউ কেউ সেহরি বাদ দিয়ে দেন অথবা সেহরিতে পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণ করেন না। এটা সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকেও ঠিক নয়। কারণ সারাদিনের রোজা পালনের জন্য এই সময়ে আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ। সেহরিতে আমাদের প্রয়োজনীয় পানীয় গ্রহণ করতে হবে। এর সাথে খাবারটা যেন হাইফাইবার যুক্ত হয়, যাতে করে এটা আমাদের আস্তে আস্তে এনার্জি রিলিজ করতে পারে এবং আমাদের শরীরে এটি দীর্ঘক্ষন স্থায়ী হয়।

আমাদের খাবারকে যদি স্বাভাবিকভাবে মূল্যায়ন করি, দেখা যাবে আমাদের খাবারে ফ্রুট এবং ভেজিটেবল কম থাকে, যা আমাদের বাড়ানো দরকার। অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যসম্মত এবং কুরআনে বর্ণিত একটা ফজিলতময় জিনিস, এর ব্যবহার আমাদের বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের প্রাপ্ত বয়স্কদের পানির বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। এই সময়ে লম্বা রোজা হওয়ার কারণে আমাদের ৮-১০ গ্লাস পরিমাণ Fluid (পানীয়) গ্রহণ করা উচিৎ। অনেকেই দেখা যায় তারাবির সময় পানির বোতল সাথে রাখেন, এটা খুব ভালো অভ্যাস।

পাশাপাশি আমাদের খাদ্যে যে খাবারগুলো কমানো দরকার, তা হচ্ছে- ফ্যাট জাতীয় খাদ্য, সুগার এবং বাড়তি সল্ট। আমরা ইফতারের সময় ভাজি করা জিনিস বেশী পরিমাণে খেয়ে থাকি। যেমন- পাকোড়া, সমুচা, পিয়াজু ইত্যাদি। তদপুরি আমাদের হাই সুগারযুক্ত ফুড থাকে অনেক বেশী, যেমন- জিলাপী, গোলাপজাম, রসগোল্লা, রসমালাই ইত্যাদি। অন্যদিকে Fibre আশ জাতীয় খাওয়া যদি যোগ করতে পারি এবং তার পাশাপাশি গ্রীল্ড খাওয়া যদি চালু করতে পারি তা অনেক স্বাস্থ্যসম্মত হবে। এ বিষয়ে কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের খাবারে ফ্রুট এবং ভেজিটেবল পরিমাণ বাড়াবো এবং ব্যালেন্সড ডায়েট যেন মেন্টেইন হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো। পানির পরিমাণও যেন আমরা ঠিক রাখি।

বিশ্রাম গ্রহণ ও ব্যায়াম

স্বাভাবিক সুস্থ জীবন যাপনের জন্য আমাদের ঘুম বা বিশ্রাম গ্রহণ অতীব জরুরী। তার পাশাপাশি ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর জীপনযাপন (healthy lifestyle) অন্যতম অংশ। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস বা এ জাতীয় রোগ আছে তাদের এটা চিকিৎসারই একটি অন্যতম দিক। অতএব রামাদ্বানের অন্যান্য ব্যস্ততার সাথে এই দুটি দিক আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এটার জন্য প্রয়োজন উত্তম সময় ব্যবস্থাপনা।

বিশেষ অবস্থায় রোজা

সমাজ জীবনে আমাদের অনেককেই কমবেশী রোগব্যাধি নিয়েই জীবন পরিচালনা করতে হয়। কিছু রোগ আছে যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন: হাই পেশার, ট্যাবলেট নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। এ জাতীয় রোগীদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিৎ ঔষধ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিভাবে রোজা রাখা যায়। এক্ষেত্রে রোজা শুরুর আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অথবা আপনাদের জিপি’র (General Physician) সাথে আলোচনা করেই পরিকল্পনা করা উচিৎ, বিশেষভাবে যারা একাধিক রোগে ভুগছেন।

হঠাৎ যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রেও চেষ্টা করা উচিৎ চিকিৎসার পাশাপাশি রোজা রাখা সম্ভব কি না সে ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া। যেমন: যদি কারো এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়েই পড়ে, তখন চিকিৎসকের কাছ থেকে ওয়ান টাইম ডেইলী এন্টিবায়োটিক আছে কি না সে অপশন খোঁজ নেয়া দরকার। তাহলে ইফতার ও সেহরির মাঝখানে আমরা দিনে একবার এমনকি দু’বারের যে সমস্ত এন্টিবায়োটিকগুলো নিতে হয় তা রোজা রেখেও নেওয়া সম্ভব হবে। অবশ্য মা বোনদের বিশেষ করে যারা প্রেগনেন্ট এবং দুগ্ধ প্রদানকারী তাদের অবস্থাটা ভিন্ন। তারা রোজা শুরুর আগেই তাদের স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। রোজা রাখবেন কি না এবং রাখলে কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। তাই অনুরোধ থাকবে আপনারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং জিপির সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে রামাদ্বানের ব্যাপারে পুরো পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।

এ ব্যাপারে মূলনীতি হচ্ছে আমরা চেষ্টা করবো, চিকিৎসা গ্রহণ করেই রোজা রাখতে। যদি কারো অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, চিকিৎসা গ্রহণ করতে গেলে রোজা সম্ভব না হয় তখন অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, জিপি এবং আপনার ইমামের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা জানি অসুস্থদের জন্য রোজা পরে রাখার বিধান রয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোজা

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা দরকার, আমরা রোজা রেখে থাকি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তাক্বওয়া হাসিলের উদ্দেশ্যে। তবে বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, রোজা রাখলে আমাদের শরীরে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশংকা নেই। এমনকি কিছু অতিরিক্ত ফায়দা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে যারা এগবেষণা শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম সাহেবের কথা। যার গবেষণা ১৯৫৯ সালে লন্ডনের ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোজাদারের উপরে এবং রোজা রাখেন না (অমুসলিম) এমন সমসংখ্যক লোকদের ব্লাড পেশার, বডি ওয়েট, টেম্পারেচার, হার্টরেট, বিএমআর, ওয়াটার ব্যালেন্স পরীক্ষা তুলনামূলকভাবে করে দেখিয়েছেন রোজাদারদের উপরে রোজা রাখার ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশী মুসলমান হিসেবে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম সাহেবের কাজটি আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়।

রামাদ্বানে আমরা স্বাস্থ্য বিষয়ক অনেক ফায়দা পেতে পারি। ওভিসিটি নিয়ন্ত্রণ বা শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর ব্যাপারে সম্প্রতি পাবলিক হেলথ অফ ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয়েছে যে, যুক্তরাজ্যে এডাল্ট ওভিসিটির সংখ্যা শতকরা ৩৫.১ ভাগ। সারাদিন রোজা রাখলে খাদ্য গ্রহণের উপর আমাদের যে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই শক্তিকে যদি আমরা ইফতার ও সেহরির মাঝখানের সময় ধরে রাখতে পারি অর্থাৎ আমাদের ডায়টেশিয়ানদের এডভাইসের আলোকে পরিমিত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারি। আর বছরের বাকি ১১ মাস যদি আমরা এই অভ্যাসকে ধরে রাখতে পারি তাহলে ওভিসিটি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রামাদ্বান এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত আমরা জানি মুসলিম সমাজে আইডিয়ালি ধুমপানের বদ অভ্যাস থাকার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে মুসলিম সমাজে ধুমপানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। রামাদ্বানে দিনের বেলায় ধুমপায়ী ভাইয়েরা যেভাবে ধূমপান থেকে বিরত থাকেন তা সারা রামাদ্বান মাস এবং পরবর্তী ১১ মাসেও ধরে রাখার জোর চেষ্টা করা উচিৎ। তাহলে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ ধুমপান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। এক্ষেত্রে NHS এর পক্ষ থেকে নিকোটিন প্যাচসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সহযোগিতা করা হচ্ছে। যাদের প্রয়োজন তারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা গ্রহণ করে রামাদ্বান-উত্তর ধূমপান মুক্ত একটি সমাজ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন।

উপসংহার

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এই দোয়া করছি, তিনি যেন আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রামাদ্বানের সর্বাত্মক ফায়দা হাসিল করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

প্রয়োজনীয় তথ্য: ১. চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রমাদান, লেখক: অধ্যাপক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম (রাহিঃ) ২. ইস্ট লন্ডন মসজিদসহ স্থানীয় মসজিদের ওয়েবসাইট ৩. NHS রমাদান পেইজ ৪. ডায়াবেটিস ইউকে ওয়েবসাইট ৫. ব্রিটিশ নিউটেশন ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট

* ডা. আমিনুল ইসলাম যুক্তরাজ্যের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *