রঙিন ঈদ-উল-ফিতর এবং কাফন ও খয়রাত : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাদা রঙের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত সাদা পায়জামা ও সাদা পাঞ্জাবি পরেছি। স্কুলের শেষ দিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত আমি গান্ধী টুপি পরেছি, যা এখনও ভারতে কংগ্রেস নেতারা পরে থাকেন। বাংলাদেশে টুপি পরলেই ধারণা করা হয়, বুঝি বা হুজুর, মাদ্রাসার তালিব অর্থ্যাৎ ছাত্র।

কিন্তু আমি কখনও মাদ্রাসার ধারে কাছে ঘেঁষিনি। ইসলাম সম্পর্কে সামান্য যা জানি, তা নিজের একান্ত চেষ্টায়। আমি বরং চার বছর বাইবেল স্টাডিজ পড়েছি। হিন্দু ধর্মের অধিকাংশ পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করেছি। বৌদ্ধদের ত্রিপিটক পড়েছি। অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলো সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করেছি। খুব ইচ্ছা ছিল, কম্পারেটিভ রিলিজিয়াস স্টাডিজ এ কোনো আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি গ্রহণের। অনেক চেষ্টা করেও কোনো স্কলারশিপ ম্যানেজ করতে না পারায় এই অপূর্ণ ইচ্ছাটিও আমার সাথে কবরস্থ হবে।

আমাদের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের বড় অংশ কেটেছে জুমা ও ঈদে সাদা রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরে জামাতে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে। সাদা কাপড়ের মানের পার্থক্য ছাড়া এর ব্যতিক্রম ছিল না বললেই চলে। তবে যারা পায়জামা পরতে অনভ্যস্ত, শ্রমজীবী, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যেত যে তারা লুঙ্গি পরে জামা হিসেবে সাদা শার্ট বা পাঞ্জাবি পরিধান করতো। আমার ক্ষেত্রে বিশ্বদ্যিালয়ের শেষ দিকে ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম ঘটেছিল রাজশাহী সিল্কের কয়েকটি পাঞ্জাবি ব্যবহার করার মধ্যে, যেগুলো সাধারণ সাদা পাঞ্জাবির চেয়ে বেশ ব্যয়বহুল ছিল। ছাত্রাবস্থায় ফুলাইম জব করতাম বলে অধিক ব্যয়ে সমস্যা হয়নি।

তবুও যেকোনো রঙের তুলনায় সাদা রং আমার খুব প্রিয়। এর বড় কারণ, কবরস্থ হওয়া ভাগ্যে থাকলে শেষ পর্যন্ত সাদা কাফন ধারণ করেই কবরবাসী হতে হবে। মৃত মানুষের ভাগ্যেও যে সবসময় সাদা কাফন জোটে এমন নয়। আমার জন্মের আগে আমার দাদা হজ্বে গিয়ে তার সাথে নিয়ে যাওয়া কাফনের শ্বেতবস্ত্র আবে-জমজম বা পবিত্র জমজমের পানিতে ধুঁয়ে এনেছিলেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগে অর্থ্যাৎ তার নবতিপর বয়সে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় সেই কাফন তার নসীব হয়নি। পবিত্র পানি-বিধৌত তার সাধের কাফন পরে কবরবাসী হন আমার দাদী।

কিন্তু আমি আমার মৃত্যুর আগেই কাফন পরিধান করার সুযোগ পাই ১৯৯০ সালের ১৫ অক্টোবর। পবিত্র কা’বা ঘর তাওয়াফ করার উদ্দেশ্যে আমি সেদিন জেদ্দা সিটির হাায়াত রিজেন্সি হোটেল কক্ষে দুই খণ্ড সফেদ বস্ত্রে নিজেকে আচ্ছাদিত করি। এটির নাম ‘কাফন’ নয়, ‘ইহরাম’। কাফন না হলেও ‘ইহরাম’ ও কাফনের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে আমার সেদিনও মনে হয়নি, এখনও মনে হয় না। ‘ইহরাম’ কোনো পোশাক নয়। শুধু শরীর ঢেকে রাখার আচ্ছাদন। ‘ইহরাম’ বাঁধার একটি আধ্যাত্মিক মর্ম রয়েছে। নিজেকে পৃথিবীর মায়া-মমতা, লোভ-লালসা থেকে বিমুক্ত করা। মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে পরিপূর্ণ সমর্পণ করা। নতুন রূপে আবির্ভূত হওয়ার আশায় মৃতদের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

‘ইহরাম’ পরিধান হজ অথবা উমরাহ যাত্রীদের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করে। ইহরামের কারণে কা’বা তাওয়াফ করার সময় কে ক্ষমতাধর, কে বেশুমার সম্পদের মালিক এবং সামাজিক মর্যাদায় কে ওপরে বা নিচে, তা বোঝা যায় না। ‘ইহরাম’ এর সরলতা ও অভিন্নতার কাছে উঁচু নিচু, ধনী গরীব সব সমান। ইহরামকে যদি অঘোষিতভাবে ‘কাফন’ বলা হয়, তাহলে খুব ভুল হবে না।

আমার এই বোধ খান খান হয়ে যায়, যখন থেকে দেখছি যে, বাংলাদেশে এবং বিদেশে যেখানে বাংলাদেশিরা বসবাস করেন সর্বত্র তারা ঈদের জামাতে নানা রঙের পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি পরে শামিল হন। অনেক পরিবারে শিশু থেকে শুরু করে সকল পুরুষ সদস্য একই রঙের, একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরেন ঈদ উপলক্ষে। তাদের পরিবারের নারীরাও তাদের পুরুষ সদস্যদের পাঞ্জাবির রঙের সাথে মিলিয়ে শাড়ি, সালওয়ার কামিজ ও ওড়না ব্যবহার করেন। সফেদ রঙের পাঞ্জাবি আর পাওয়াই যায় না।

সত্তরের দশক পর্যন্ত দেখেছি ঈদগাহ জুড়ে কি চোখ জুড়ানো শুভ্রতা। দেখেই ভালো লাগত। মন ভরে যেত পবিত্রতার বোধে। এখন ঈদের জামাত রঙে রঙে ভরা, মাঝে মাঝে অন্ধকার আকাশে নি:সঙ্গ তারার মতো সাদা রং চোখে পড়ে। অনেকে বলেন, এই যে পরিবার জুড়ে একই রঙের বস্ত্র, বিয়েতে পাত্র ও পাত্রী পক্ষের সকলের একই রঙের বস্ত্র ধারণ, এটা দেশের ও মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রমাণ। হয়তো তাই।

কিন্তু এ যুক্তিতে আমার মন সায় দেয় না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই যদি সবকিছু নিরূপণ করতো, তাহলে কা’বা তাওয়াফে ‘ইহরাম’ এর রং বহু আগে পাল্টে যেত। ক্ষমতাধর ও বিত্তশালীরা বহুমূল্য রঙিন বস্ত্র ব্যবহার করতেন তাদের মৃত স্বজনদের কাফনে। তা হয়নি। হয়তো হবেও না।

আমার ‘খয়রাত’ ভাগ্য বেশ ভালো। গত এক দশকে ঈদ অন্তত চল্লিশটি পাঞ্জাবি ‘খয়রাত’ হিসেবে পেয়েছি (অনুরূপ সংখ্যক শার্টও পেয়েছি, ট্রাউজার পেয়েছি কম)। যারা আমাকে ভালোবেসে অথবা বৃদ্ধ মুরুব্বিকে খয়রাত করলে সওয়াব পাওয়া যাবে ভেবে (অথবা এই ব্যাটা আর ক’দিন বাঁচবে ভেবে) ‘খয়রাত’ করেছেন, আমি তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তাদের জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করি (যদিও আমার দোয়ায় কাজ হয়েছে, এমন দেখিনি)। হে আল্লাহ, তাদের মনের সকল আশা পূরণ করুন; তাদের জাহেরি ও বাতেনি সকল গুনাহ মাফ করুন’ ও দীর্ঘ কর্মময় জীবন দান করুন এবং অবশেষে ক্লেশহীন মৃত্যু দান করুন; তাদের কবরকে জান্নাতের ফুলবাগান করে দিন; তাদের জন্য পুলসিরাত কুশাদা (প্রশস্ত) করে দিন; এবং জান্নাতে তাদের শরাবন তহুরা পরিবেশনের ব্যবস্থা করুন; পুরুষদের জন্য আপনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭০/৭২ হুর এবং নারীদের জন্য ‘গিলমান’ এর সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও তাদের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী ‘গিলমান’ সরবরাহ করুন। হে পরওয়ারদিগার, জাদরেল জাদরেল হুজুররা যেসব দোয়া করেন, তার সীমা পরিসীমা নেই এবং সবগুলো আমার মুখস্তও নেই। তবে আমাকে ভালোবাসার দানে যারা ধন্য করেছেন, সেইসব নরনারীর জন্য আমি আমার খাস দিলে যে দোয়া করলাম, তা কবুল করুন।

পাদটীকা: পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর এবারও আমি তিনটি পাঞ্জাবি ও একটি শার্ট ‘খয়রাত’ পেয়েছি। শাটর্টাই কেবল সাদা। কারা খয়রাত করেছেন, তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। এর আগেও আমি আমার বিভিন্ন লেখায় ‘খয়রাত’ শব্দটি প্রয়োগ করেছি। কেউ কেউ এতে ক্ষোভ প্রকাশ ও আপত্তি করেছেন। কিন্তু ‘খয়রাত’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘খায়ের’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘ভালো’ ‘কল্যাণ’, ‘দান’। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিকভাবে ‘খয়রাত’ বলতে মনে করা হয় ‘ভিক্ষা’ যা দরিদ্র মানুষকে দেওয়া হয়। ‘সাদাকাহ’ বা ‘সদকা’কেও ভিক্ষা বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ‘খয়রাত’ ও ‘সাদাকাহ’ তা নয়। আল্লাহ আমার বন্ধু-বান্ধবী ও আপনজনদের খয়রাতের হাতকে আরও উদার করুন। আমিন!

* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *