আসাদ বিন হাফিজ অন্ত্য-আশির একজন অন্তরালপ্রিয় কবি। সত্তর দশকের দৈনিক ও কালিক পট পরিবর্তমান মুহূর্তের উত্তপ্ত অস্থিরতার প্রভাবে সত্তরের কবিতাও হয়ে উঠেছে অস্থির, চঞ্চল। ফলে কবিতায় ছন্দোৎকর্ষ, সূক্ষ্ম সৌকুমার্য, ভাবৈশ্বর্য প্রভৃতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনচেতা মানুষের মতো সত্তরের কবিতাও যেন হয়ে উঠেছে ছন্দের লাগামহীন ঘোড়া। কবি তাঁর অন্তরের ক্ষোভ, ক্রোধ-ঘৃণাকে সময়ের অনিবার্য টানে তড়িঘড়ি করে কবিতার একটা জামা পরিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছেড়ে দিয়েছেন রাজপথে। জামাটা পুরোনো কিনা, জামার কলারটা ঠিক করা হলো কিনা, বোতামগুলো আটকানো হলো কিনা-সে সব লক্ষ্য করার সময় তখন ছিল না। ফলে কবিতাও হয়ে উঠেছে কখনো রাজপথের বক্তা, হয়ে উঠেছে মিছিলের শ্লোগানের মতো হস্তোদ্ধত সরব চিৎকার।
কিন্তু সত্তরের অন্তিমে এসে কবিতা তার পরিচ্ছদ-প্রসাধন-সচেতনা স্বাভাবিকভাবেই ফিরে পেলো। এই সচেতনতা আশির দশকের কবিদের করে তোলে নিরাবেগ, শান্ত-স্থির এবং স্বাতন্ত্র্য-অন্বেষী। আশির কবিগণ পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন কবিতার অন্তর-বাইরের স্বরূপের দিকে। এ দশকের কবিতা তাই নব সাজে সজ্জিত। কবিতার অন্তর্ভেদি দৃষ্টিবানরা লক্ষ্য করেছেন কবিরা প্রায়ই নতুন নতুন সজ্জা বিনির্মাণ প্রয়াসী হয়ে উঠছেন। যদিও তাদের এই পরীক্ষা প্রবণতার সাফল্য বা সার্থকতার ব্যাপারটি আপেক্ষিক।
উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ের কবিদের মধ্যে পারস্পারিক কাব্য ঈর্ষা- যা সর্বকালেই ছিল- ছিল বৈকি। কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে গোত্র বিভাজন সূচিত হয়ে গেল। ফলে কবিগণ হয়ে পড়লেন অতিমাত্রায় রাজনীতি প্রভাবিত। আশির কবিতায় এই রাজনীতির প্রভাব সহজলক্ষ্য। সমসাময়িক কবি আসাদ বিন হাফিজও আদর্শবাদী এবং রাজনীতি সচেতন। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি-বিশ্বাস, জীবন-দর্শন এবং আদর্শের ছাপ সুস্পষ্ট। আদর্শিক প্রেক্ষণ বিন্দুতেই তিনি দেশ-কাল-সমাজ ও জীবনকে অবলোকন করেছেন। তাঁর আদর্শ ইসলাম।
আধুনিক কবিতার ব্যাপারে পাঠক মহলে দুর্বোধ্যতার একটা অভিযোগ আধুনিকতার সূচনাপর্ব থেকেই ছিল, কম-বেশী এখনও আছে। এর কারণ পাঠকের অনগ্রসরতা বা যা-ই হোক না কেন, আসাদ বিন হাফিজের কবিতা সেই অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদিও কোলরিজ বলেছিলেন- কবিতা সাধারণভাবে বুঝতে হয়, তার সবটা বোঝা যায় না, বোঝা উচিতও নয়। কবিতা খানিকটা রহস্যময়, অনেকটা অনির্বচনীয়। কবিদের অনেকেই এই বক্তব্যের পক্ষপাতী হলেও আসাদ বিন হাফিজ অনেকটা মালার্মের পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন, কবিতা শব্দ দিয়ে লেখা হয়, ভাব দিয়ে নয়। যদিও ‘সুহাসিনী ভোরে’ শব্দের নুপুরধ্বনি তেমন বাজতে শোনা যায় না। আসাদ বিন হাফিজ প্রকাশের নিরাভরণ সহজতায় বিশ্বাসী। উদ্ধৃতি লক্ষ্যণীয়:
দয়া করে মোল্লাদের আর ক্ষ্যাপাবেন না
দেখতে ওরা বড় বেশী ভদ্র, শান্ত এবং নিরীহ
মূলতঃ ওরা খুব উদার এবং মহৎ
আপনারা ভাবেন দুর্বল। (অশনি সংকেত)
এক এতিম শিশু হয়ে উঠেছিলেন
মানবতার একমাত্র অভিভাবক
এক উম্মি মানুষ হয়ে উঠেছিলেন
মানবতার মহান শিক্ষক। (একজন মানুষের কথা)
পূর্বেই বলা হয়েছে, ‘কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’ আসাদ বিন হাফিজের কাব্য জগতে প্রবেশের প্রথম প্রয়াস। প্রথম প্রয়াসে স্বভাবতঃ যে সব ত্রুটি থাকতেই পারে আলোচ্য কবি সে থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। আমার চোখে ‘কি’ শব্দটি খুব যন্ত্রণা দেয়। দীর্ঘ-ঈকার দিয়ে ‘কী’ লিখলে স্বস্তি পেতাম। যাই হোক, একজন শিল্পী তাঁর জীবনাভিজ্ঞতা, চিন্তা-চেতনা, মনন-মনীষার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেন বিচিত্র উপায়ে, শিল্পের যে কোনো শাখাই তাঁর প্রকাশের বাহন হতে পারে। আর শিল্পের প্রতিটি শাখারই রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য, চারিত্র ও পরিবেশ। শিল্পী যে মাধ্যমটিকে গ্রহণ করবেন, সে মাধ্যমটির শিল্প কাঠামোর মনো-দৈহিক সচেতনতা শিল্পীর জন্যে অনিবার্য শর্ত। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কবিতা কখনো বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না, কবিতা কেবলি নববধুর মতো সুসজ্জিত ও অবগুণ্ঠিত থাকতে চায়। কবি আসাদ বিন হাফিজ শিল্প অসচেতন নন। তবে, বোধকরি কবিতার অন্তর বাহিরের চাহিদা সম্পর্কে তিনি যতোটা ভাবিত, ততোধিক ভাবিত বক্তব্য উপস্থাপনার ব্যাপারেও। কবিতায় তিনি তাঁর বক্তব্যকে গাদ্যিক সাবলীলতায় তুলে ধরার প্রয়াসী। অবশ্য কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও দুর্লঙ্ঘ্য নয়। মূলতঃ তাঁর ব্যতিক্রমী কবিতাগুলোই অপেক্ষাকৃত দ্যোতনাময় এবং সুখপাঠ্য। সনেট-৪, আমার ঈদ, দুই চোখ, সুনন্দা, মধ্যরাতের পৃথিবী,আঁৎকে উঠি, কথা কেন রাখে না মানুষ প্রভৃতি কবিতা চরিত্র এবং বৈষয়িক স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
আলোচ্য কাব্য গ্রন্থের কবিতায় বিষয়-বৈচিত্র্য রয়েছে। যুগার্থ এবং জীবনার্থ তাঁর কাব্যে উঠে এসেছে সাধারণভাবেই। তাঁর প্রেম এবং নারী ভাবনা অ-গতানুগতিক। প্রেম এবং নারীকে তিনি দেখেন আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘এই বসন্তে’ কবিতায়-
‘প্রেমের সঙ্গীত গেয়ে মৌমাছি আনবে প্রভাত
চঞ্চল ছন্দে মিলে প্রজাপতি হবে নিটোল কবিতা
কোকিলের কুহুতানে জেগে উঠবে সবুজ প্রান্তর।’
এভাবে ভাবতে ভাবতে সহসা যখন বলে ওঠেনঃ ‘ভাবি/ কি সাহস বুকে নিয়ে গুটিকয় যুবক / নির্ভয়ে অস্ত্র নেয় কাধে’। / অবিনাশী সত্যের জন্য / লালিত স্বপ্নের জন্য / প্রেমের সঙ্গীত দিয়ে ঢেকে দিতে চায় সব আণবিক ঝড়’ তখন তিনি হয়ে ওঠেন আদর্শ সচেতন আরেক প্রেমিক। তিনি আর ভাবতে পারেন না জোৎস্না নিয়ে, বসন্ত-কোকিল-প্রজাপতি আর ফুটন্ত গোলাপ নিয়ে। বরং তাদেরকে জানিয়ে দেন তাঁর পারগতার কথা- ‘গোলাম কি পেতে পারে প্রেমের বয়স’?
‘সুহাসিনী ভোরে’ গোটা ছয়েক সনেট রয়েছে। ‘সনেট’ শিরোনামে যে চারটি সনেট রয়েছে, সেগুলো তাঁর নারী ভাবনাজাত। তিনি নারীকে কল্পনা করেন ‘পুরুষের অধীন’, কল্পনা করেন সেবিকা হিসেবে। আর পুরুষকে বা স্বামীকে কল্পনা করেছেন ‘নিপূণ রাখাল’ হিসেবে। সনেট চারটির মধ্যে ‘সনেট-৪’ কবিতাটির বয়ন-কৌশল অপেক্ষাকৃত কাব্যিক, স্বভাবতই সুন্দর। এই সনেটটিকে অন্যান্য সনেটের মতো ৮/৬ মাত্রার চালে সজ্জিত করার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও মাঝে মধ্যে মাত্রা সংখ্যায় অমিল পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
‘ঝরনায় জল নেই শুকনো নিরস ৭/৫,
আধোমুখে বসে থাক একলা বিরস ৮/৫
কখনো ঝরলে পাতা বাতাসের তোড়ে ৭/৬,
পাষাণে হাতড়ে মর প্রতিদিন ভোরে ৭/৬,
অথচ থাকতো যদি ঝরনায় জল ৭/৫,
শুকনো প্রান্তর আর পাষাণ সকল ৭/৬ মাত্রায় রচিত।’
‘কী দুরন্ত ধাবমান গতি’ এবং ‘ঘুম-২’ কবিতায় পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসের যুক্তি নির্ভর বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। ইহজীবনের তুলনায় ‘আরেক জীবন’ তাঁর ভাবনায় সমুদ্রের মতো অসীম: জীবন তো এক বিন্দু জলকণা / বাষ্প মেঘ বৃষ্টির পথ পেরিয়ে / সমুদ্রে সমর্পিত হবার এক দুরন্ত ধাবমান গতি। (কী দুরন্ত ধাবমান গতি)
কবি আরেক জীবনকেই স্বাধীন মুক্ত-উদার এবং আপন ভুবন মনে করেন। পৃথিবীর জীবন তাঁর ‘বন্দী বিহঙ্গের’ মতো মনে হয়। মৃত্যুকে তিনি নিজস্ব ভুবনে যাবার ‘খেয়াপাড়ি’ ভেবে বলেন: তুমি ঘুমোও, আর / সে বিশ্বের মানুষেরা তোমারই মতন / মরণের খেয়া চড়ে পাড়ি দিয়ে ফিরে যায় নিজস্ব ভুবনে / মুক্তি পেলে উদার নীলিমায় যেভাবে ডানা মেলে বন্দী বিহঙ্গ। (ঘুম-২)
“শাহাদত’ ও ‘আমার ঈদ’ কবিতা দুটিতে ‘মাকে’ কবিতারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ‘আমার ঈদ’ কবিতাটি কিছুটা চিত্রধর্মী এবং গভীর ব্যঞ্জনাময়। ঈদের দিনে রান্নাঘরে বসে শহীদের মা উৎকর্ণ হয়ে আছেন, কখন তিনি তাঁর পুত্রের কণ্ঠধ্বনি শুনবেন: ‘মা, মা, আমি এসেছি। শহীদ জননীর এই সকরুণ নিরানন্দ ঈদোদযাপনের চিত্র কবিতাটিতে প্রতীকায়িত হয়েছে।
আসাদ বিন হাফিজের কবি প্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সমাজ সমালোচনা। এ গ্রন্থের অসংখ্য কবিতায় তাঁর সেই সমাজ সমালোচক দৃষ্টি কাজ করেছে। তন্মধ্যে ধারাপাত, সেলুকাস এই বাংলাদেশ, সমুদ্রমুখী, দ্রাবিড় কসাই, পাথর ভেনাস’ প্রভৃতি কবিতা উল্লেখযোগ্য। এইসব কবিতায় তিনি সমকালীন সমাজ কাঠামোর বিচিত্র অসঙ্গতি সাংবাদিকদের মতো তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এসব কবিতায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশক এমন কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা কবিতাকে তীর্যক করলেও কবিতার সাঙ্গীতিক মহিমাকে কিছুটা নিরস করে তুলেছে বৈকি। যেমন- ‘হারামী গিধর’, ‘লেনিনের মাই’ প্রভৃতি। ‘সুনন্দা’ কবিতাটি ক্ষুদ্র হলেও হৃদয়-সঞ্চারী আবেদনে মহিমান্বিত। একটা রোমান্টিক মুহূর্তকে স্বল্প কটি শব্দে রঙিন ক্যানভাসে রেখাচিত্রের মতো তুলে ধরেছেন কবি।
ফেরী ঘাটে রাত নামছে / পানিতে পূর্ণিমা / বাতাসে নিঃশ্বাসের শব্দ / তুমি কোথায় সুনন্দা, তুমি কোথায়?
‘দুই চোখ’ কবিতাটি কবির দূরদৃষ্টি এবং প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার দ্যোতক। রাতে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ দু’জনের প্রতিক্রিয়া বিপরীতধর্মী। কবিপত্নী কপালে ‘দুশ্চিন্তার ভাঁজ’ ফেলে ভাবছেন: ‘কাল যে অনেক কাজ, কাজের তোড়া / নিসর্গে বুঝাবে কে, কে থামাবে শ্রাবণের ধারা?’ আর কবি মগ্ন উল্লাসে বৃষ্টি দেখে ভাবছেন: ‘একটা পবিত্র সকাল / খরগোশের মতো দ্রুত অথচ শান্ত পায়ে / আসছে, আসছে….
কবির এই ভাবনা, এই আশাবাদ, এই প্রাগ্রসর চিন্তা যতোটা আশার, ততোটা হতাশার তাঁর এই নির্লিপ্ততার উক্তি- ‘কবিতা তো কল্পনার সামগ্রী- ওসব এখন থাক।’
কবি আসাদ বিন হাফিজ উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক নির্মাণে প্রথাসিদ্ধ, তবে বয়ন-কৌশলের ঋজুতার দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবীদার। তবু কবিতা যেখানে বৈজ্ঞানিক-সৃষ্টির মতো অপূর্ব বস্তু, সেখানে তাঁর এই প্রকাশের নিরাবরণ ঋজুতা কতোটা কাব্যিক, কতোটা শৈল্পিক ভেবে দেখার বিষয়।
এবারে গ্রন্থের নামকরণ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ‘কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’- ৮/৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত একটি কবিতা পংক্তির মতো মনে হয়। কিন্তু এটি কোন কবিতার লাইন নয়। কবি খরগোশের মতো দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসা সুবেহ সাদিককে অর্থাৎ তাঁর আদর্শের স্বপ্নরাজ্যকে খুব কাছেই দেখতে পাচ্ছেন-এ ব্যাপারে কবি দৃঢ় নিশ্চয়। তাঁর এই গভীর বোধ এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনিবার্য সুর ‘নামকরণে’ স্পষ্ট ধ্বনিত হয়। ফলে নামকরণটি শুধু চমকপ্রদই নয়, কবির জীবন দর্শন ও কাব্যকৃতির বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপকও। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নামকরণ যথার্থ মনে করি।
* নাসির মাহমুদ কবি, গীতিকার ও রেডিও উপস্থাপক E-mail: nasir.radio@gmail.com