সিলেটে আতঙ্কের বড় কারণ ‘ডাউকী ফল্ট’

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

* সিলেটে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে

হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী সিলেট থেকে:

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষঞ্জরা। তারা বলেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এটি সিলেট ‘ডাউকী ফল্টে’র অন্তর্ভূক্ত। এই ডাউকি ফল্ট-ই সিলেট্সীর জন্য আতঙ্কের বড় কারণ। অথচ এই নগরী বেড়ে চলছে অপরিকল্পিত ভাবে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান শনিবার বলেন, সিলেট নগরী অনেক ঝুকিতে। তাই বেশী প্রয়োজন জনসচেতনতা। তিনি বলেন,ঈদের পর পর সিসিকের উদ্যোগে বিল্ডিং‘র পরিকল্পনাকারী, ঠিকাদার-সহ সংস্লিষ্টদের নিয়ে একটি বড় ধরণের কর্মশালার আয়োজন করবেন এবং করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেয়া হবে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলেটে ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার ‘চ্যুতির লাইনগুলো সক্রিয়’ আছে।

গত ৫ মার্চ ঢাকা থেকে উত্তর পূর্ব দিকে ৪৪৯ কি.মিটার দূরে রিক্টার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেট কেপে উঠে। তার আগে ২৬ ফেব্রুয়ারী বুধবার দিবাগত রাত ২টা ৫৫মিনিটে সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩।

গভীর রাতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় অনেকেই টের পাননি। তবে সিলেটবাসী কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভূমিক¤প অনুভূত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৪৬ কিলোমিটার দূরে। সিলেট থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মো. সজিব হোসেন বলেন, গত এক বছরে সিলেটে শতাধিক ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলে বেশীর ভাগ সিলেটে এবং ঢাকার আগারগাও থেকে ৫শত কি.মিটারের মধ্যে। ভূমিকম্পের বেশীর ভাগের উত্তপত্তি আসাম,মায়ানমার ও নেপাল। একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় বিশেষঞ্জরা সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে থাকেন।

গত ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে সিলেট বিভাগ জুড়ে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয় তা রিখটার স্কেলে ৫দশমিক ৫মাত্রার ছিল। এটির উৎপত্তিস্থল ছিলো সিলেটের কানাইঘাট ও ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট বা ডাউকি চ্যুতি‘তে।

সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন শ কিলোমিটার বিস্তৃত। গত ২০২২-২৩ সালে দুবছরে সিলেটে অন্তত: ১৬বার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তার পরও আরো বেশ কটি ভূমিকম্প হয়েছে সিলেটে। তার অনেকগুলো রেকর্ডেও আসেনি।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০ বছরের ভূমিকম্প পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘঠিত হয় ঐ সময়।

১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্টে ৮দশমিক ৭মাত্রার ভূমিকম্পটি সিলেটকে তছনছ করে দেয়। বয়ষ্করা বলেন, ‘সেটি যেন ছিল এক প্রলয়।’ বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-এর উপরে গেলে তাকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প বলা হয়। এর নিচে হলে তাকে মৃদু কম্পন হিসেবে গণ্য করা হয়।

এদিকে সিলেটে নির্মিত অপরিকল্পিত ভবনগুলোও পরীক্ষা করা হচ্ছে না। যে কোন সময় বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ২০২১ সালে নগরের বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করানো হয়।

সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলমের অভিমত, সিলেটের ভবনগুলো অপরিকল্পিত। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়। ফলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।

অন্যদিকে ২০২১-২২ সালে কয়েক দফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় সিসিক উদ্যোগ নিলেও তা পুরো বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো সরকারী বেসরকারী ভবন জরাজীর্ণ।

প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ভবনগুলো পরীক্ষা করাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সিসিকের এইখাতে তহবিল নেই।

প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটে ৫২ হাজার ১৭৬টি ভবন ভেঙে পড়বে। আর এসব ভবনের ধ্বংসাবশেষ বা অবকাঠামো অপসারণের কোন যন্ত্রপাতিও নেই।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভূমিকম্পের পর নগরের সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন না ভেঙেও ‘রেক্টোফিটিং’ করা যেতে পারে। ঐ সময়ে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। এর মধ্যে অনেকেই তাদের ভবনের নক্সা প্রদর্শন করেননি। ফলে সেই কার্যক্রম আর আগায়নি।

তখনই নগরের সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানসন ও রাজা ম্যানসন নামের ৭টি বিপণিবিতানকে ১০দিন বন্ধ রাখা হয়।

প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছিলাম। পরে এগুলো সংস্কারের জন্যও বলেছিলাম। কিন্তু মালিক পক্ষ গ্রাহ্য করেননি। ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করেন। ২০১৬ সালেও একই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় মালিক পক্ষের অসহযোগিতার কারণে।

* হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী সিনিয়র সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *