এক সপ্তাহ পরেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানল, বরং বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকায় আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালাচ্ছেন আক্রান্ত এলাকার বাসিন্দারা। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চুরি ও লুটপাটে।
দাবানলে পুড়তে থাকা এলাকায় চুরি ও লুটপাট চালানোর ঘটনায় নতুন করে আরও দশজনকে আটক হয়েছে। এর মধ্যে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুই লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি অঙ্কের মালামাল লুটের অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি নাথান হোচম্যান।
এ নিয়ে গত কয়েক দিনে লুটপাটের অভিযোগে অন্তত ৩৯ জনকে আটক করলো যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের কয়েক বছরের কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন এলাকা থেকে লুটপাট ও চুরির আরও অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আরও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। “ইতোমধ্যেই যারা দাবানলের আগুনে সবকিছু হারিয়েছে, তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আর ক্ষতি করবেন না,” পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে।
আক্রান্ত এলাকায় থেকে জনসাধারণকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আগেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে, যা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কেউ কারফিউ ভাঙলে তাকে এক হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
লুটপাট করতে ছদ্মবেশ ধারণ
লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল আক্রান্ত এলাকায় লুটপাট চালাতে অনেকে ছদ্মবেশের আশ্রয় নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ।
লুটপাট করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যারা আটক হয়েছেন, তাদের মধ্যে কমপক্ষে দু’জন ব্যক্তি দমকল কর্মী সেজে লুট করতে গিয়েছিলেন বলে জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় সবাই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
এদিকে, চুরি ও লুটপাট ঠেকাতে আক্রান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শেরিফ রবার্ট লুনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, তিনি ন্যাশনাল গার্ডের আরও সদস্য চেয়েছেন। চারশো জন এর মধ্যেই কাজ করছে।
ক্যালিফোর্নিয়া গভর্নর গেভিন নিউসন এর আগে এক হাজার অতিরিক্ত ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। “মালিবু এলাকায় আমি একজনকে দেখলাম একেবারে দমকল কর্মীর মতো। তিনি বসেছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তিনি ঠিক আছেন কি না। বুঝতেই পারিনি যে তাকে হ্যান্ডকাফ পরাতে হবে,” সাংবাদিকদের বলেন শেরিফ লুনা।
“আমরা তাকে পুলিশে দিয়েছি। কারণ তিনি দমকল কর্মীর মতো পোশাক পরে ছিলেন, যদিও তিনি বাহিনীর কর্মী নন। তিনি একটি বাড়িতে লুটপাট করছিলেন। এমন পরিস্থিতি আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে,” বলেন বলছিলেন শেরিফ লুনা
ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এখন ১৪ হাজার দমকল কর্মী কাজ করছে। তাদের সহায়তা করছে ৮৪টি এয়ারক্রাফট ও ১৩৫৪টি ফায়ার ইঞ্জিন। এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ এখনো বাধ্যতামূলকভাবে অন্যত্র অবস্থান করছেন আরও ৮৭ হাজারের ওপর সরে যাওয়ার সতর্কতা আছে।
বাড়ছে বাতাসের গতি
চলমান দাবানলের মধ্যেই লস অ্যাঞ্জেলেসে বাতাসের গতি বাড়তে শুরু করেছে। এতে নতুন নতুন এলাকায় দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে যে, বুধবার পর্যন্ত বাতাসের গতি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯৬ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির মেয়র কারেন বাস।
এদিকে, প্যালিসেইডস, ইটন, কেনেথ, লিডিয়া, হার্স্ট এবং আর্চারের অনেক এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। এর মধ্যে প্যালিসেইডসে সর্বোচ্চ প্রায় ২৩ হাজার ৭১৩ একর জায়গাজুড়ে দাবানলের আগুন ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দাবানলের আগুনে প্যালিসেইডসের কমপক্ষে তিনশ’ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, ইটনে পুড়েছে ১৪ হাজার ১১৭ একরের মতো এলাকা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে আশেপাশের অঙ্গরাজ্যগুলোর দমকল বাহিনীর কর্মীরা। লস অ্যাঞ্জেলেস দাবানলে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
নিহতদের মধ্যে ১৬ জনের মৃতদেহ ইটন এলাকায় এবং অন্য আটজনের মরদেহ পালিসেইডস এলাকায় পাওয়া গেছে। ওই দুই এলাকায় আরও কমপক্ষে ২৩ জন ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বাইডেন যা বলছেন
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। “ক্যালিফোর্নিয়াকে সাহায্য করার জন্য যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেগুলোর সবকিছু করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,” বলেছেন মি. বাইডেন।
এছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা, খাবার ও পানি বিতরণ করা, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে অর্থ সহায়তা প্রদান করাসহ আরও অনেক বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
“চরম এই দুর্যোগের মধ্যে একে অপরের পাশে থাকার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাই,” বলেন মি. বাইডেন।
তিনি আরও বলেন, “আমি আপনাদের এটাও জানাতে চাই যে, লস অ্যাঞ্জেলেসে আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়।”
ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির প্রশাসক ডিয়ানে ক্রিসওয়েল বলেছেন যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। “আমি জানি অনেকেই নিজ এলাকায় ফিরতে চাইছেন ও ঘরবাড়ির অবস্থা দেখতে চাইছেন। তবে বাতাস আরও বাড়লে আপনি জানেন না যে কোন পথে তাদের সরে যেতে হবে,” বলছিলেন তিনি।
লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশের প্রধান জিম ম্যাকডনেল জানিয়েছেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্বল্প পরিসরে কিছু ব্যক্তিকে তাদের ঘরবাড়িতে যেতে দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা দাবানল জোনগুলোর কাছে ড্রোন না ওড়াতে বারবার মানুষকে সতর্ক করেছে।
এর মধ্যে একটি ড্রোনের সাথে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিমানের সংঘর্ষ হয়েছে, যার ছবি প্রকাশ করেছে এফবিআই। বিবিসি