বিশ্ব মূকাভিনয় দিবস ২২ মার্চ। পার্থপ্রতিম মজুমদারের হাত ধরে বাংলাদেশে এ নান্দনিক শিল্পটির চর্চা শুরু হলেও শিল্পটিকে দেশে জনপ্রিয় করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন নিথর মাহবুব। মূকাভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয় হলেও শিল্পের একাধিক শাখায় দখল রয়েছে তার। তিনি পেশায় সাংবাদিক। মঞ্চ নাটক ও টিভি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেন, লেখালেখি করেন, আবৃত্তি, গানও করেন। দুরন্ত টিভির অনুষ্ঠান ‘দুরন্ত সময়’ এর সুবাদে ছোটদের মহলে ‘মূকাকু’ হিসেবেও তার পরিচিতি আছে।
বিশ্ব মূকাভিনয় দিবসে বাংলাদেশের মূকাভিনয় চর্চা ও তার বর্তমান ব্যস্ততাসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি ‘দৈনিক সময়’ এর সাথে।
🔳 মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কবে?
নিথর মাহবুব: ঢাকায় একটা নাটকের দলের সঙ্গে কাজ করছিলাম। ২০০৬ সালের দিকে দলের সঙ্গে নানা কারণে সম্পর্কটি ভালো যাচ্ছিল না। তাই দল ছেড়ে জোরেশোরে মূকাভিনয় নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন কাজটি ছিল খুব কঠিন। কেননা তখন বাংলাদেশ থেকে বলা চলে মূকাভিনয় চর্চা হারিয়ে গেছে। আমি যেচে গিয়ে পরিচিতজনদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় শুরু করি।

🔳 মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
নিথর মাহবুব: ছোট বেলা থেকেই শিল্পের নানা মাধ্যমে আমার বিচরণ ও দক্ষতা ছিল। মূকাভিনয়ের প্রতিও আকৃষ্ট হই বিটিভিতে পার্থপ্রতিম মজুমদারের মূকাভিনয় দেখে। স্কুলে ও গ্রামে বাৎসরিক অনুষ্ঠানে ‘যেমন খুশি তেমন সাজ’ ইভেন্টে নির্বাক এ অভিনয় করে একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছি। তবে হাতেকলমে শিল্পটির সম্পর্কে জানি একটি নাটকের কর্মশালা থেকে। সম্ভবত ১৯৯৯ সালে নরসিংদীতে আমাদের কয়েকজনের গড়া নাটকের দল ‘নাট্যশীলন’ কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে একটি ক্লাসে মূকাভিনয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি জাহিদ রিপনের কাছে। সেই থেকে শিল্পটির প্রতি ঝোঁক আরও বেড়ে যায়, তখন বাসায় নিয়মিত এর চর্চা করতাম। ছোটবেলা থেকেই ব্যায়াম ও অ্যাক্রোবেটিকের কিছু কাজ করতাম। তাই মাইমটা ভালো হচ্ছিল আমার। এরপর ২০০৬ সালে শিল্পকলা একাডেমির একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। আমাদের প্রবাসী মূকাভিনয় শিল্পী জিল্লুর রহমান জন ভাই তখন দেশে এসেছিলেন। তিনি সেই কর্মশালায় একদিন এলেন মাইমের ক্লাস নিতে। ক্লাসে সবার মধ্য থেকে তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ’। জন ভাইয়ের এ ভালোবাসা আমাকে মাইমে মগ্ন হতে অনেক বড় অনুপ্রেরণা যোগায়।
🔳 বিলুপ্ত হতে থাকা শিল্পটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জার্নিটা জানতে চাই….
নিথর মাহবুব: আমার মতো মানুষের জন্য এটা ছিল ভয়ানক কঠিন একটি কাজ। কেন না আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীতে কোন শিল্পের চর্চা নেই, মিডিয়াতে কেউ নেই, সাংবাদিকতাতেও নেই। ২০০৭ সালের দিকে আল নোমানের আমন্ত্রণে তার নাটুকে থিয়েটারের তমসা নাটকে অভিনয় করে বেশ আলোচিত হই আমরা। নোমানের সঙ্গে বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের পথিকৃৎ পার্থপ্রতিম মজুমদারের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। নোমানের সঙ্গে দাদার নিয়মিত যোগাযোগ হত। নোমান পার্থদার সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটায়। অনেক বছর পরে ২০০৮সালে পার্থ দা দেশে আসেন। দাদার সঙ্গে দেখা করি। সামনাসামনি দেখা হওয়ার পর থেকে দাদার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। দাদার সঙ্গে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে লান্স ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে পারফরমেন্সে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়। দাদার সঙ্গ পেয়ে আরও সমৃদ্ধ হই। দাদা চলে যাবার পর ২০০৮ সালেই নিজের দল ’মাইম আর্ট’ গঠন করলাম। ২০০৯ সালে পার্থ-দা ফ্রান্সের জাতীয় থিয়েটারের মোলিয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর আবার দেশে আসেন। পার্থদার সম্মানে জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে দেশি-বিদেশি গুণী শিল্পীদের অংশগ্রহণে তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমাকে মাইম করার জন্য সিলেক্ট করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে আমেরিকার একজন মাইম শিল্পী থাকবেন, নকিব খান, বাপ্পা মজুমদারের মতো বড় মাপের শিল্পীরা গান পরিবেশন করবেন। ৯০০আসনের মিলনায়তনটিতে দর্শক হিসেবে থাকবেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের অনেক বিখ্যাত মানুষ ও গুণী শিল্পীরা। জীবনে কোন দিন এত বড় মাপের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতাও নেই। এত বড় অনুষ্ঠানে গুণী শিল্পীদের মাঝে আমি কি করব কেমন করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবেচিন্তে একটি খণ্ড মূকাভিনয় দাঁড় করাই। আমার সেই মাইম দেখে হলভর্তি প্রায় ৯০০ দর্শক স্তব্ধ এবং মুগ্ধ হন। যার ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে আছে। এক্রোবেটিকের সঙ্গে মাইমকে যুক্ত করে একটা কাজ করি। যা দেখে আমেরিকান ওই শিল্পীও অবাক হন। হাত তালিতে আর হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠে মিলনায়তন। তার পরেও আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। রাতে ফোনে পার্থ-দা যখন মেসেজ পাঠিয়ে জানান, তিনি আমার মূকাভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তখন মনে হলো, আসলেই ভালো কিছু করতে পেরেছি।

🔳 বাংলাদেশে মূকাভিনয় এর বর্তমান অবস্থা কোথায় আছে?
নিথর মাহবুব: ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা চেষ্টা চলে সারা দেশে শিল্পটিকে ছড়িয়ে দিতে। দুরন্ত টিভি ও ব্র্যাক এর সুবাদে সারা দেশে ঘরে ঘরে মূকাভিনয়কে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন শিল্পটা চলে গেছে ধান্দাবাজদের কাছে। তারা সুবিধা ভোগ করছে নানা ভাবে। দেশে ভালো মানের পাঁচটা দল নেই, পাঁচটা মূকাভিনেতা নেই অথচ মূকাভিনয়ের ৫টা ফেডারেল বডি এখন হয়েছে। এরা নিজেরা ভাল কাজ জানে না, কিন্তু ফেডারেল বডির পদাধিকার বলে বিভিন্ন জায়গায় ভুল প্রশিক্ষণ দিয়ে চলছে। কেউ নেংটি পরে, কেউ খালি গায়ে, কেউ গামছা কাঁধে নিয়ে, কেউ মূকাভিনয়ে সঙ্গে ভয়েজ জুড়ে দিয়ে নানা ভাবে যে যার মতো আবোল-তাবোল ফরমেট তৈরি করছে মূকাভিনয়ের। ফলে নতুন প্রজন্মের মূকাভিনয় শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দর্শকদের এসব দেখে বিরক্ত হতে দেখি। অনেকে আমার কাছে অভিযোগ করে। ধান্দাবাজদের কারণে বড় মাপের শিল্পী বেরিয়ে আসতে পারছে না। এরা জোটবদ্ধ এবং অনেকে রাজনৈতিক কর্মী। এদের সঙ্গে পেরে উঠা মুশকিল। তাই আমি এসব নিয়ে কিছুই বলি না, নিজের কাজটা করে যাই। কর্মই মানুষকে বড় করে এটা বিশ্বাষ করি। যারা ভালো কাজ শিখতে চায় তারা আপন তাগিদেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, আমার কাজ দেখে শিখবে। এখন সবাই মূকাভিনয়ের জনপ্রিয়তার দাবিদার হতে চাচ্ছে।
🔳 বিষয়টি আরও খুলে বলুন….
নিথর মাহবুব: অনেক নিজের স্বার্থে ইতিহাস বিকৃত করছে, আমাকে, পার্থদাকে মূকাভিনয় থেকে মুছে দিতে চাইছে। কিছু মিডিয়া ও সাংবাদিক তাদের সহযোগিতাও করছে। মূকাভিনয়কে অনেকে বিদেশে যাওয়ার বাহন বানিয়ে ফেলেছে। যে কারণে এমন কঠিন একটি শিল্পে মাধ্যমে যে কেউ মুখে সাদা মেকাপ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। তারপর কয়েকটি পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে সেগুলো এবং ফেডারেল বডিকে কাজে লাগিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। গত কয় বছরে মূকাভিনয়কে কাজে লাগিয়ে আমার জানামতে আটজন প্রবাসী হয়েছে, তাদের নাম বলতে চাই না। সরকারি প্রতিষ্ঠান যাকে তাকে দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছে, কর্মশালা করাচ্ছে এগুলো নিয়ে মিডিয়া খবর প্রকাশ করে না। আজকে ২২ মাচ, বিশ্ব মূকাভিনয় দিবস নিয়ে নাকি শিল্পকলা কোন এক ফেডারেল বডির সঙ্গে প্রোগ্রাম করছে, অনেকে এ বিষয়ে ফোন করে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।
🔳 মানুষ আপনার ‘চরিত্র’কে কী হিসেবে নিচ্ছে?
নিথর মাহবুব: অনেকে মূকাভিনয়কে মনে করে কমেডি কিছু। কিন্তু মূকাভিনয় কমেডি না। এর মাধ্যমে অনেক সিরিয়াস গল্প বলা যায়, প্রতিবাদ করা যায়, সমাজের অসংগতি তুলে ধরা যায়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যায়। মূকাভিনয় করি বলে প্রথমদিকে অনেক নাটকের নির্মাতারা আমাকে কমেডি করার জন্য ডাকতেন, আমি না করে দিতাম। কারণ আমি কমেডিয়ান হতে চাইনি, অভিনেতা হতে চাইতাম। তবে আমার বেশিরভাগ মূকাভিনয় দেখে মানুষ প্রচুর হাসে। কিন্তু সেগুলোয় বার্তা থাকে, শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। গল্পের সিচুয়েশনই কমেডির জন্ম দেয়, গল্পের চরিত্রকে দর্শক হাসানোর চিন্তা করতে হয় না।

🔳 মাইম বা মিডিয়ায় কাজ করতে গিয়ে পরিবার থেকে কতটা সাপোর্ট পেয়েছেন?
নিথর মাহবুব: আমার শিল্পের ভ্রমণে আমার পরিবারের অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা, দিকনির্দেশনা কিছুই ছিল না। নিজের যখন যা মনে চাইতো, তা-ই করতাম। আমার ধারণা শিল্পের অঙ্গনের বেশিরভাগ মানুষ আমাকে চেনেন মাইম শিল্পী হিসেবে তার পরে সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু স্কুলজীবনে যে কারণে আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের বন্ধু-বান্ধব ও আশেপাশের মানুষের কাছে আমার ব্যাপক পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে, তা হলো ছবি আঁকার জন্য। আর সবাই আমাকে ডাকত কবি বলে। ইন্টারের পরে ছবি আঁকার ঝোঁক চলে যায়, পরে একাডেমিতে গান শিখেছি, আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করেছি, নাটকের দলে যুক্ত হয়েছি।
🔳 শিল্পের সঙ্গে পথচলা কবে থেকে?
নিথর মাহবুব: শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক আমার শিশুকাল থেকে। যখন আমার হাতে পাথরের স্লেট-পেন্সিল আসে; তখন থেকেই ছবি আঁকি। আর যখন থেকে মুখে কথা ফোটে; তখন থেকেই ছড়া মুখস্থ করে আশেপাশের মানুষদের নেচে নেচে অভিনয় করে সেই ছড়া শোনাতাম। বেড়াতে বা কোথাও গেলে সবাই আমাকে ছড়া শোনাতে বলতেন। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না, আসলে পড়তেই চাইতাম না। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম আমার নানা কর্মকাণ্ডে সবাই আমাকে অলরাউন্ডার এবং ট্যালেন্ট বলত এবং আশেপাশের গ্রামেও আমার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। আমার পরিবার ভাবত আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে, যে কারণে ম্যাথ নিয়ে পড়তে বাধ্য হই। আমি যা মন দিয়ে দেখতাম তাই শিখে ফেলতে পারতাম। এবং শেখার পরে তা অনেকের চেয়ে ভালো করতে পারতাম।
🔳 অভিনয়ের অনেক শাখায় আপনাকে দেখা যায়, তবে মাইমে বেশি সরব থাকনে। মাইমে আকৃষ্ট হওয়ার কারণ কি?
নিথর মাহবুব: কঠিন বলেই কেউ সহজে আমার জায়গাটা দখল করতে পারবে না। আর কিঠন কিছু আয়ত্তে আনতে পারলে সহজ কাজগুলো আরও সহজ হয়ে যায়। আসলে ছোট বেলা থেকেই গতানুগতিক কিছু আমার পছন্দ হতো না, সবাই যা করে তার বাইরে আলাদা কিছু আমার করা চাই, মানুষকে আমার কাজে আকৃষ্ট করা চাই। আর তাই আমি আকৃষ্ট মাইমে। তাছাড়া কথা ছাড়া, প্রপ্স ছাড়া কখনও কখনও মিউজিক ছাড়া শুধু অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তি দিয়ে মানুষকে বিষয় বুঝাতে সক্ষম হওয়া, মানুষের মগজে ইমেজ বা ঘটনার সৃষ্টি করতে পারার তৃপ্তিটা অনেক বেশি।
🔳 আমাদের দেশে মাইম শিল্প নিয়ে চর্চা করা কতটা কঠিন বলে আপনি মনে করেন?
নিথর মাহবুব: আমার দৃষ্টিতে দেশের কোনো মাধ্যমের শিল্পীদের ভবিষ্যতই ভালো না। সেখানে মূকাভিনয় শিল্পীদের পথটাতো আরও বেশি কঠিন। আমরা এখন কাদের শিল্পী বলছি; যারা প্রচুর টাকা রোজগার করছেন তাদেরকে। যাদের মুখের পরিচিতি বেশি আছে তাদের, যারা কোন কারণে ভাইরাল হচ্ছে তাদের। তাদের শিল্পের সব মাধ্যমে টেনে আনছে অর্থের লোভে। সারাদেশের শিল্পের চর্চা কমতে কমতে এখন এমন প্রজন্ম আমাদের তৈরি হয়েছে যারা পারফেক্ট বা নান্দনিক কিছুর চেয়ে বিকৃত কিছুতেই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। সেগুলোকে ভাইরাল করে দিচ্ছে। যে কারণে আগাছায় ঠাসা হয়ে গেছে শিল্পের অঙ্গন। এসব আগাছাদের দায়বদ্ধতা বলেও কিছু নেই। পরিচিতি কাজে লাগিয়ে টাকা উপার্জন তাদের মূল উদ্দেশ্য। এমন অবস্থায় ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের মতো এখন টিভি চ্যানেলের মালিক নিজেই শিল্পী হয়ে যাচ্ছে, কর্পোরেট কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনে মডেল বানাচ্ছে ঘরের লোকদের, প্রযোজক তার গালফ্রেন্ডকে নায়িকা বানাচ্ছে, পরিচালকরা নিজের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নাটক বানাচ্ছে, নিজেই নাটকের গল্প লিখে ফেলছে, টাকা দিয়ে অনেকে নায়ক হচ্ছে। বাজে ধরনের ধরনের গল্পও আছে। আগে শিল্পী তৈরি করতেন ওস্তাদরা এখন শিল্পী তৈরি করে রিয়েলিটি শো। কাজ করতে করতে কাজের গুণে সেলিব্রেটি হচ্ছে এমন শিল্পী এখন আর খুব একটা নেই। যারা দিনের পর দিন শিল্পের সাধনা করছেন, শিল্পের অঙ্গন থেকে তাদের আয়ের পথ এখন প্রায় বন্ধ। কেউ কোনোভাবে চেহারার পরিচিতি তৈরি করতে পারলে তা দিয়ে সে নাচ, গান, মডেলিং, অভিনয়, উপস্থাপনা, লেখালেখি ইত্যাদি সবই করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর এটা পারছেন আমাদের মিডিয়াগুলোর দুর্বলতার কারণে, সেসব জায়গায় মেধাবী মানুষের অভাব বলে। শিল্পীর পরিচিতি কাজে লাগিয়ে দর্শক ধরতে চাইছে মিডিয়াগুলো। আর তাদের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে চেহারার পরিচিতি বাড়িয়ে যে কেউ শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন। শিল্পী হওয়ার এ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে একটা শ্রেণী আবার চেহারার পরিচিতি তৈরি করার ব্যবসা জুড়ে দিয়েছে।

🔳 আপনার একটি মাইমের দল আছে, সেটির কার্যক্রম নিয়ে বলুন?
নিথর মাহবুব: আমার দলের নাম ‘মাইম আর্ট’। আমার দলটি সারা বছর কাজ করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, শো করছে। ট্যালেন্ট কয়েকজন মাইম শিল্পী আছে আমাদের দলে। তার মধ্যে টুটুল, ফয়সাল, রিপন, লেমন অন্যতম। ২০০৮ সাল থেকে প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত আমরা শিল্পকলা একাডেমিতে মাইমের চর্চা করি। শিখতে চাইলে যে কেউ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। চলতি মাসের ৭ তারিখে আমাদের শো ছিল পুরান ঢাকার জুরাইনে। সেদিন নতুন একটা খণ্ড মাইমের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন আমরা করেছি। নাম ‘যান্ত্রিক জীবনের জটিলতা’। বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি নতুন এই মাইটি করে। এছাড়াও অনেকগুলো প্রযোজনা আমাদের আছে।
🔳 মাইম নিয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
নিথর মাহবুব: মাইম শিল্পী হিসেবে অনেকে আমার নাম জানে কিন্তু চেহারা চিনে না, দেখা গেছে কোন অনুষ্ঠানে বা অচেনা জায়গায় আড্ডা চলছে একটা সময় কথায় কথায় কেউ আমার নামটা প্রকাশ করল। যারা চিনে না তার অবাক হয়ে যায়। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা যখন জানে আমি দুরন্ত টিভির ‘মূকাকু’ তারা অবাক হয়ে যায়।
🔳 অনেকসময় দেখা যায় কাজ করতে গেলে তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। এমন কোন অভিজ্ঞতা থাকলে তা শুনতে চাই।
নিথর মাহবুব: এমন অভিজ্ঞতা প্রায়ই হয়, যখন বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণে কোলাজ কোন অনুষ্ঠানে মাইম করতে যাই। মঞ্চের সামনে চার-পাঁচটা মনিটার স্পিকার থাকে। সেগুলোর কারণে নিচে কোন কাজ করতে গেলে দর্শক দেখতে পায় না। যেহেতু কথা নেই তাই দর্শক দেখতে না পেলে আমার বিষয় বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে। এটা আয়োজকদের বোঝানো যায়না। তাদের কাছে মাইমের গুরুত্ব বেশি থাকে না। তারা গানের নাচের অভিনয়ের শিল্পীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শো শেষে যখন দেখে দর্শক খুব পছন্দ করেছে। তখন এসে বলে ভাই বুঝতে পারিনি, মাইম দিয়ে দর্শকদের এভাবে মাতিয়ে তোলা যায়। আবার টিভি নাটকে কাজ করতে গেলেও তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেক হয়। যারা নতুন তারকা বা কলাকুশলী আমার চেহারা চিনে না তারা প্রথমে বেশি গুরুত্ব দিতে চায় না, পরে যখন আমার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয় বা পরিচয় কোনভাবে জানতে পারে তখন নিজে থেকে এসে পরিচয় হয়, আগে না চেনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে।

🔳 কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং? একক মাইম নাকি দলগত মাইম?
নিথর মাহবুব: দলীয়টা বেশি চ্যালেঞ্জিং কারণ এখানে সংলাপ নাই কেউ ভুল করলে সবাইকে ধরা খেতে হয়। একা হলে নাহয় আবার অন্য কোন কৌশলে সেটাকে কাভার করার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু দলীয়টার ক্ষেত্রে এমনটা সম্ভব না।
🔳 মঞ্চ অভিনয়ে নতুন যারা আসছে আপনার দৃষ্টিতে তারা মাইমের প্রতি কতটা আগ্রহী?
নিথর মাহবুব: অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করে, শিখতে চায়, ফোন নাম্বার নেয় কিন্তু পরে আর আসে না। আসলেও কদিন পরে হাল ছেড়ে দেয়। আসলে মাইম শিখতে হলে অনেক ধৈর্য্য ও সাধনার প্রয়োজন।
🔳 যদি বলি মঞ্চনাটক, টিভি নাটক, মডেলিং ও মাইম এর মধ্য হতে যে কোন একটাকে বেছে নেবেন। তাহলে কোনটা বেছে নেবেন?
নিথর মাহবুব: আমি কিছুই বাছতে চাই না, ভালো লাগে বা পারি বলেইতো অভিনয় করি। তবে দর্শক আমাকে যে ভাবে গ্রহণ করবে আমি তাই, দর্শক আমার যে কাজে বেশি তৃপ্তি পাবে সে কাজই বেশি করতে চাই।
🔳 সামনে কি কাজ আসছে?
নিথর মাহবুব: নতুন একটা ধারাবাহিক নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ মাসের ২৪ থেকে ২৭ তারিখের ভিতরে দুইদিন শুটিং আছে। এ মাসে ঈদের একটা নাটকের কাজও করবো। আলু সংরক্ষণের উপর একটি বিজ্ঞাপন টিভিতে প্রচারে আসবে শীঘ্রই। অনেকে আমার নতুন গানের অপেক্ষায় আছে। ঈদের জন্য একটা গান লিখে সুরও করে রেখেছি। এবার জীবনমুখী থেকে বের হয়ে একটা প্রেমের গান আনতে চাই।
🔳 আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নিথর মাহবুব: সারাজীবন একটাই পরিকল্পনা করে আসছি, সেটি হলো ভালো মানুষ হওয়া। সৎ থাকতে চাই, আজীবন শিল্পের সঙ্গে শিল্পের সাধনায় নিয়োজিত থাকতে চাই, দেশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে চাই। কর্মগুণে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে চাই, দেশে মূকাভিনয় শিল্পকে আরও জনপ্রিয় করতে চাই।