মোহাম্মদ শিশির মনির। শিক্ষাজীবনে ছিলেন তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে শুরু করেন তার দৃপ্ত পথচলা। লিখেছেন ‘An Overview of 100 Sensational Murder Cases of Bangladesh’ শিরোনামের বইটি। বইয়ে রয়েছে ১০০ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিশ্লেষণ যেগুলো বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জটিল জটিল ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে সফল হয়েছেন শিশির মনির। ইতিমধ্যে ভারি করে ফেলেছেন নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিও। সে সবের মধ্য হতে ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখে যাচ্ছেন মামলা পরিচালনার নানান ঘটনা। এবারের পর্বে রয়েছে তেমনই একটি বিষয়।
মৃত্যুদণ্ড_রোহিঙ্গা খালেক_শিশু অপহরণ ও হত্যা_কক্সবাজার_স্বীকারোক্তি_খালাস_স্টে_বোনের সাক্ষাৎ
১। গতকালের পর্বে বলেছিলাম অসহায়-দরিদ্র মানুষদের আইনি সেবা প্রদানের কথা। এরই অংশ হিসেবে নবাব আলী ভাই এই মামলাটিও নির্ধারণ করেন। এদের কোন আইনজীবী ছিল না। জেল থেকে জেল আপিল দায়ের করেছিল। পেপারবুক সংগ্রহ করে আমরা পড়াশুনা শুরু করলাম। আমার জুনিয়র সাকিবকে রিসার্চের দায়িত্ব দিলাম। সে অনেক পড়ুয়া ও গভীর মনোযোগ দিয়ে রিসার্চ করতে পারে। ১০/১২দিন ধরে খোঁজাখুজি করল। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম সাকিব, ‘খবর কি?’ সে মুচকি হাসি দিত। আমি বুঝতে পারতাম এখনও কিছু পায়নি। এভাবে বেশ কিছুদিন গেল। মামলাটির সিরিয়াল আস্তে আস্তে আগাতে লাগল। আমারাও প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।
২। একদিন বিকালে কোর্ট থেকে চেম্বারে ফিরলাম। আসরের নামাজের পর সাকিব পেপারবুক নিয়ে রুমে আসল। আঁচ করলাম কিছু একটা পেয়েছে। সে বলল ভাই এটা ত খালাস হবে? আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম। ধুর, বল কী? সে বলল, দেখবেন আমি বলছি খালাস হবে। কেন বলছো এই কথা? উত্তরে বলল, দুইজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আছে। একজন আরেকজনকে দোষ দেয়ার চেষ্টা করেছে। কেউ নিজের দ্বায় স্বীকার করেনি। আমি বললাম শুধু এই জন্য খালাস পাবে? আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। বললাম আরও দেখ? ভালভাবে দেখ। সে বলল, জি।
৩। যতটুকু মনে পরে ২/৩ দিন পর বাদ মাগরিব আবার সে রুমে আসল। এবার অট্টহাসি হাসছে। তার হাসার ভঙ্গি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আমি আঁচ করলাম কিছু একটা পেয়েছে। রুমে ঢুকার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম সুখবর আছে? জবাবে বলল, আছে। নিজ থেকেই শুরু করল ভাই এটা কিভাবে হয়? স্কুল থেকে বাচ্চাকে নিয়ে গেছে অথচ স্কুলের দারোয়ান-শিক্ষক-সহপাঠি-অভিভাবক কেউই সাক্ষী নাই। এই মামলায় খালাস ছাড়া আর কি হবে? বললাম আরও দেখ। শুধু আবেগ দিয়ে ত আর খালাস হবে না। আইনি point বের কর। সে কিছুটা বিরক্ত হল। এইবার সে জিদ হিসাবে নিল। বলল, আমার সন্দেহ হয়। এই ধরনের ঘটনা হতে পারে না। কিছু একটা বের করবই। তার জেদ দেখে আমি মুচকি হাসলাম। এই ধরনের জেদবোধ আইন পেশায় খুবই জরুরী বিষয়। সঠিক আইন খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজন তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জেদি মনোভাব। অন্যথায় জটিল মামলায় হার অনিবার্য।
৪। এরই মধ্যে মামলাটি শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় আসল। প্রথমেই রাষ্ট্রপক্ষের পালা। নবাব আলী ভাই ও সাকিব বসে থাকত আর নোট নিত। আমি মাঝে মাঝে যেতাম। আদালত কী কী প্রশ্ন করতেন দিনশেষে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। এভাবে পেপারবুক পড়া শেষ হল। সাকিব বলল ভাই বিষয়টি বেশ জটিল। নবাব আলীকেও চিন্তিত দেখতাম। আমি সাহস দিতাম। যদি মিথ্যা ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কিছু না কিছু বের হবেই। এটাই মিথ্যার ধর্ম। মিথ্যা কথা বলে শেষ পর্যন্ত মিলানো যায় না।
৫। কোর্টের প্রশ্ন ও রাষ্ট্রপক্ষের আলোচনার সময় আমরা ইস্যু বুঝতে পারলাম। সেই আলোকে ৩/৪ দিন ধরে আমরা LCR (নিম্ন আদালতের রেকর্ড) দেখতে লাগলাম। প্রায় হাজার পৃষ্ঠা। ধুলায় ভরপুর। পাতাগুলো প্রায় ছেঁড়া ছেঁড়া অবস্থা। হাত দিয়ে ধরলেই যেন আরও ছিঁড়ে যাবে। তবুও মাস্ক পরে দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ করে একটি বিষয় চোখে পরল। পুলিশ খালেককে হাসাপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। এই মর্মে একটা মেডিকেল রিপোর্টও আছে। এটা কেন? কেন পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করবে? পুলিশ ফরওয়ার্ডিং কি বলে? কি হয়েছিল খালেকের? কি কারণে ভর্তি করা হল? বিস্তারিত তথ্য কোথায় পাব? পরিবারের কাউকে ত আমরা চিনি না? কোনদিন কাউকে দেখি নাই? আসামীও দেখি নাই? তার আত্মীয়-স্বজনদের দেখি নাই। বিষয়টি বেশ রহস্যজনক মনে হল। আরও খুঁজতে লাগলাম। এ যেন কেঁচো খুঁজতে সাপ বের হচ্ছে। পুলিশ ফরওয়ার্ডিং এ পাওয়া গেল মজার তথ্য। পুলিশ স্বীকার করছে গ্রেফতারের সময় ধস্তাধস্তিতে খালেক আহত হয়। সেজন্য তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে মেজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয় এবং খালেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। এই তথ্যটা পেয়ে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলাম। আরও খুঁজতে লাগলাম। আরও কিছু দরকার। আরও চাই। শুধু এতটুকু দিয়ে হবে না। আরও গভীর সাধনা প্রয়োজন। প্রয়োজন অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখা। আলোচনা করতে লাগলাম। চেম্বারের আরও কয়েকজন জুনিয়রকে কাজ দিলাম। বিশেষ করে মোনায়েমকে বললাম তুমিও দেখ।
৫। এইবার আমাদের পালা। তখনও আমরা clear case তৈরি করতে পারিনি। কোন ধরনের bundle ও প্রস্তুত করা হয়নি। আদালতের প্রশ্ন ও পরিবেশ দেখে পরবর্তী রিসার্চ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এইবার ঘটনাটি একটু করে বলছি। বুঝতে সুবিধা হবে। কক্সবাজারে একজন ধনি/প্রভাবশালী মানুষের সন্তানকে স্কুল থেকে অপহরণ করা হয়। শহর জুড়ে মাইকিং করেও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। কে বা কারা মোবাইলে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। বেশ টাকা পয়সা দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় শিশুটিকে মেরে ফেলে। পরদিন সমুদ্র সৈকতে লাশ পাওয়া যায়। পরিচ্ছন্নকর্মীরা সকালে ঝাড়ু দিতে গিয়ে লাশের সন্ধান পায়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে নিয়ে পোস্ট মর্টেম করা হয়। ভিতরে বালি ও পানি পাওয়া যায়। এই ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুর চাচাসহ অন্যান্যদের আসামি করে মামলা করা হয়। তাদের পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই ঘটনা ঘটেছে মর্মে এই মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ তদন্ত করে পরিবারের সবাইকে অব্যাহতি প্রদান করে। অপর তিনজনকে গ্রেফতার করে যাদের নাম এজাহারে ছিল না। একজন রোহিঙ্গা খালেক। সে রিক্সা চালাত। অপর দুইজন কক্সবাজারের গরীব মানুষ। একজন মোবাইল ফোন কলের ভাসমান দোকানদার। আরেকজন রিক্সাচালক। খালেকসহ দুইজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে। নিজেদের দোষ আংশিকভাবে স্বীকার করে। নিম্ন আদালত ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করে। যুক্তিতর্ক শেষে দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে ২০১৫ সালে। এই মামলা শুনানির জন্য ২০২১ সালে হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসে।
৬। আমি দাঁড়িয়েই বললাম, ‘My Lords! This is a clear case of acquittal. The prosecution couldn’t prove its case beyond reasonable doubt. They are the victims of the circumstances and their confessional statements have been obtained by coercion and torture. Further, in the body of their confession, one person accused another avoiding his guilt. This type of confession can not be taken into consideration by your Lordships.’
জজ সাহেবরা বললেন, কি বলেন আপনি, টাকার জন্য বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছেন। আবার বলছেন খালাসের মামলা? দেখান দেখি কেন খালাস পাবেন? কেন খালাস দিব? একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছেন? দুটি মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় আপনারা দুইজনই দোষী? এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবেন? আপনি বলছেন আপনাকে torture করছে? কে করছে? কখন করছে? দেখাতে পারবেন?
৭। আমি আদালতের প্রশ্নগুলো বুঝে গেলাম। ভাবলাম এই দুটি বিষয়ই এই মামলার মূল কথা। অন্যকোন সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। জুনিয়রদের নোট নিতে বললাম। আদালতকে বললাম ইনশাল্লাহ আমি আপনাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারব। এই কথা বলে স্বীকারোক্তিমূলক দুটি জবানবন্দী বার বার পড়ে শুনালাম। কিন্তু সন্তুষ্ট করতে পারলাম না। আজকের মত আদালত বিরতি হল। ঐদিন ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্র-শনিবার বন্ধ। কিছুটা সময় পেলাম। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করলাম। ৭টি নজির দিয়ে রিসার্চ bundle প্রস্তুত করল সাকিব। ৪ কপি তৈরি করল। রবিবার সকালের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হল।
৮। ১০টা ৫৫ মিনিটে আদালত উঠল। এক নম্বর আইটেম। আইটেম ডাকার সাথে সাথে আমি ডায়েসে গেলাম। সবাইকে Bundle এর কপি দিলাম। জজ সাহেবরা মুচকি হাসলেন। বললাম, ‘My Lords, I strongly and forcefully submit that these two confessions have been obtained by coercion and torture. Moreover, the concerned magistrate violated provision of law during recording confessional statements. Hence your Lordships, can not take these confessions into your consideration. Apart from these two confessions, there is no other evidence to sustain conviction and sentence and hence they are liable to be acquitted by this Hon’ble Court.’
জজ সাহেবরা অবাক হয়ে বললেন, আপনার argument এর সমর্থনে প্রমাণ দেখান। বললাম অবশ্যই দেখাব। আমার argument দুটি।
এক. নির্যাতন করে এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে; দুই. মেজিস্ট্রেট আইন ভঙ্গ করেছেন।
এক. নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়
My Lords. Kindly একটু রেকর্ডটা দেখেন। সবাই রেকর্ড হাতে নিল। দয়াকরে ৭৭ নং পৃষ্ঠা দেখেন। জজ সাহেব বললেন, কি দেখাবেন? দেখেন কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের একটি মেডিকেল সার্টিফিকেট। লেখা আছে Assault. জজ সাহেব বললেন, কে আপনাকে assault করল? বললাম এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য দয়াকরে ১০৮ পৃষ্ঠা দেখেন। গেলেন ১০৮ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেখানে দেখা গেল পুলিশ বলছে, গ্রেফতারের সময় ধস্তাধস্তিতে আহত হয় এবং তারাই হাসপাতালে ভর্তি করে। আরও দেখেন গ্রেফতারের সময় কতজন পুলিশ ছিল? ৮/১০ জুন পুলিশ অস্ত্র ও গাড়িসহ হাজির ছিল। একজন ব্যক্তি ৮/১০ জন অস্ত্রধারী পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি করেছে? অতঃপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়েছে!! এই ধস্তাধস্তিতে পুলিশের কেউ আহত হয় নাই!! এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা!! আমরা এটা বিশ্বাস করব? আপনারা করবেন? পিন পতন নীরবতা। কোন কথা নাই। জজ সাহেবরা মাথা নারালেন। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম।
খানিকপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এইবার বলেন, এই পুলিশ ফরওয়ার্ডিং আমরা দেখতে পারি কিনা? আইনের কোথায় আছে? কি বিধান আছে?’
বললাম অবশ্যই পারেন My Lords. It’s part of the case record. Then I read over section 3 of the evidence act and found a term ‘matters before it’ which indicates forwarding is a matter before you. Your Lordships can very much consider it.
তবুও বললেন, ‘একটা সিদ্ধান্ত দেখান। বললাম কালকে দিব। যথারীতি পরের দিন দেখালাম। জজ সাহেবরা হাসলেন।
দুই. মেজিস্ট্রেট আইন ভঙ্গ করেছেন
দুটি বিষয় দেখাব। স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার সময় ও মেজিস্ট্রেটের নাম দেখেন। একই ব্যক্তি একই সময়ে দুইজনের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করছেন। এটি কীভাবে সম্ভব? এইজন্য দুটি জবানবন্দি হুবহু মিলে গেছে। বিচারক কিভাবে এই কাজ করেন? তাকে show cause করা উচিত। তিনি Criminal Rules and Orders violate করেছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল দেখেন, হাতের লেখা কাটাকাটি আছে।
তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কি না? এই প্রশ্নের জবাবে প্রথমে লিখেছেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর কেটে লিখেছেন, ‘না’। কে কাটল এটি? কেন কাটল? কার হাতের initial? এটা ত Fraud. বলতে বলতে পরিস্থিতি বেশ শুনশান হয়ে গেল। বিচার বিভাগীয় fraud has been practiced upon me. আমি রিক্সা চালক। আমার ক্ষেত্রে এটি করা যায়। ধনির দুলাল হলে কোনভাবেই সম্ভব হত না My Lord. বিচারের ভার আপনাদের উপর রইল। উপরে আল্লাহ আর জামিনে আপনারা। আমি মনে করি এই মামলায় কিছুই নাই। বেকসুর খালাসই একমাত্র পথ।
৯। রাষ্ট্রপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলেন, জিএজি সাহেব কিছু বলবেন? তেমন কিছু বলতে পারলেন না। কিছুটা নীরব থাকলেন। তিনি অত্যন্ত ভদ্রলোক। অযথা কথা বলা পছন্দ করেন না। তাই নীরব থাকলেন। এক সপ্তাহ পর রায়ের তারিখ দিলেন।
১০। রায়ের দিন খুব চিন্তা হচ্ছিল। কি হবে? এত বড় একটা ঘটনা। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। পরিবেশ কি বলে? খালাস পাব কি না? ইত্যাদি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্চিল বার বার। সকালে সবাই গিয়ে বসলাম।
১০ টা ৫৫ মিনিট এর দিকে জজ সাহেবরা আসলেন। সবাই নীরব। আইটেম ডাকা হল। বড় জজ সাহেব পড়ে শুনালেন, ‘We have perused all the evidences and documents relating thereto. The judgment of the trial court is set aside. All the convict-appellants are acquitted from the charge. They should be set at liberty if not wanted in any other case.’
রায় শুনে খুশিতে চোখ ছল ছল করে উঠল। আমি উঠে গিয়ে Much Obliged বললাম। বড় জজ সাহেব বললেন, ‘ভাল argument করেছেন। Convincing argument.’
১১। এই খালেক কে? কি তার পরিচয়? কে তার আত্মীয়? কেনই বা আসামী কিছুই আমরা জানতাম না। মামলার রেকর্ডের বাইরে কোন তথ্য আমাদের জানা ছিল না। এই রায়ের খবর পত্রিকায় আসার অনেকদিন পর জেল থেকে একজন কল করল। বলল, ‘স্যার আমি জেল থেকে বলছি। আমি কক্সবাজারের খালেক। আপনি আমার বাবার কাজ করেছেন। আমার চামড়া বিক্রি করেও এই ঋণ শোধ করতে পারব না। আমি বের হয়েই আপনার সাথে দেখা করব স্যার। আমিও আবেগ প্রবণ হয়ে গেলাম। বেশি কথা বলতে পারলাম না। শুধু তার কথা শুনলাম।
১২। রায়ের ৪৩ দিন পর হঠাৎ একটা নোটিশ পেলাম। সরকার পক্ষ চেম্বার জজের আদালতে আপিল দায়ের করেছে। হাইকোর্টের আদেশ স্টে চেয়েছে। শুনে মনটা বেশ খারাপ হল। তবুও খবর রাখলাম। শুনানির দিন মাননীয় চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করলেন। খালেক আর বের হতে পারল না। সে এখনও মৃত্যুর সেলে আছে। ইনশাল্লাহ আপিল বিভাগে আরেকটা fight দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। আইনজীবী হিসেবে অর্ধেক রাস্তায় ছেড়ে দেয়া যায় না। শেষ দেখতে হয়।
১২। গত বছরের শেষের দিকে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একজন নারী ফোন করে পরিচয় দিলেন তিনি খালেকের বোন। আমার সাথে দেখা করতে চান। হোটেলে আসতে বললাম। দই ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। বললাম, আপনার ভাই ত এখনও মুক্তি পায় নাই। সুপ্রীম কোর্ট স্টে করে দিয়েছে। অনেক সময় লাগবে। বলল, ‘স্যার আপনি আমাদের জন্য এত কিছু করেছেন! বাকিটাও করবেন স্যার। প্রথমে শুনে আমরা বিশ্বাস করেত পারি নাই। জীবনে কোনদিন কেউ কাউকে দেখি নাই। আপনিও দেখেন নাই আমাদের। আমরাও দেখি নাই আপনাদের।
আমরা নির্যাতিত স্যার। আমাদের বাড়ি ঘর সব ভেঙ্গে দিয়েছে। এই মামলার পর সব দখল করে নিয়েছে। আমাদের সাহায্য করেন স্যার।’
বললাম আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাব। দোয়া করবেন। এই কথা বলে বিদায় নিলাম। খেয়াল করলাম যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ খালেকের বোন অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল।