গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রূপ প্রত্যক্ষ করার পর অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে যেসব বিষয়ে সংস্কারের আলাপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যম হিসেবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যুত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।
এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসেবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না-ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হবে মুক্ত তালিকার ভিত্তিতে আর প্রকাশ না হলে শুধু দলের নাম ও প্রতীকের ভিত্তিতেই ভোট হবে এবং প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে ভাগে পড়া আসনগুলোতে দলীয় প্রধান বা দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।
কোনো কোনো দেশে এই দুইয়ের মিশ্রণেও প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের জাতীয় সংসদে নারী কোটায় যেসব সদস্য নির্বাচিত হন, তা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের এবং এক অর্থে বদ্ধ তালিকা থেকেই। ফলে ছোট দলের নেতাদের স্ত্রীদেরও এ কোটায় সংসদ সদস্য হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য সুযোগ তৈরি হয়, যা স্পষ্টতই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার চরম অপব্যবহার। মনোনয়নের ক্ষমতা নেত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকার মাজেজা আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করেছি।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে কোনো একক দলের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশে যেসব নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পেরেছেন, সেগুলোর কোনোটিতেই শতাংশের হিসাবে বড় দুই দলের প্রাপ্ত ভোটের ফারাক এত বেশি হয়নি যে কোনো একটি দলের এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সক্ষম হতো। ফলে কোনো দল এককভাবে যেমন সংবিধান সংশোধনে সক্ষম হতো না, তেমনি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারতেন না।
২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন কিংবা ২০২৪ সালের বয়কটপীড়িত একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের অভিজ্ঞতার পর ওই যুক্তি কি আর খাটে? প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠে যদি থাকতেই দেওয়া না হয়, তাহলে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে কোনো সমাধান নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের সংস্কার এবং সাংগঠনিক গণতন্ত্রায়ণ ছাড়া রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আশা দুরাশা ছাড়া কিছু নয়।
গণতন্ত্রের সফল নজির বা মডেল বলতে এখনো যে পার্লামেন্টকে মর্যাদা দেওয়া হয়, সেই ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থায় নির্বাচন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিজয় বা ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে দুটি দলের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, অর্থাৎ মূলত এটি একটি দ্বিদলীয় শাসনের চক্রেই আবর্তিত হচ্ছে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান পাওয়া দলগুলোর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের সঙ্গে জোট গঠনও প্রয়োজন হয়। আর সরকারের বাইরে থাকলেও ওই সব ছোট দলও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়।
পরিহাসের বিষয় হলো, যুক্তরাজ্য এখন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিরূপ ফল ভোগ করছে। যুক্তরাজ্য যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ছিল, তখন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত হতো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। ইউরোপীয় নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে, তা সদস্যদেশগুলো নিজেরাই ঠিক করতে পারত। সাইপ্রাসে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেলেই সে দেশের কোনো দল ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ পেত। যুক্তরাজ্য তা ছিল ৫ শতাংশ। এই স্বল্প ভোটের সীমার সুযোগে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উগ্র ডানপন্থী অভিবাসনবিরোধী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজের ইউকিপ। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বরাদ্দ ও নানা রকম সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে তাঁর উত্থান ঘটে। নাইজেল ফারাজ তাঁর দলের নাম বদলে নতুন রূপে এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টেরও সদস্য হয়েছেন।
আইই ইউনিভার্সিটির মাইকেল বেখার, ফ্রান্সের তলুজের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের আইরিন মেনেন্ডেজ গনজালেজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির ড্যানিয়েল স্টেগমুলার তাঁদের এক যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় নির্বাচনের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীদের ভোট বেড়েছে প্রায় ১২ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ (প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন অ্যান্ড রাইট-উইং পপুলিজম: এভিডেন্স ফ্রম ইলেকটোরাল সিস্টেম চেঞ্জ ইন ইউরোপ, ব্রিটিশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল সায়েন্স, ২০২৩) ।
প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেই আলোচনায় জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কিছু দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিল (আলোচনায় আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪)। এসব দলকে হয়তো জনতুষ্টিবাদী বলা যাবে না, কিন্তু তারা যে ডান ও বামের প্রান্তিক দল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এসব প্রান্তিক দলের জাতীয় ভিত্তিতে প্রাপ্ত ভোটের হার অধিকাংশেরই এক শতাংশেরও কম। সিপিবির সামান্য বেশি হলেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা অর্জনের জন্য ন্যূনতম দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তির শর্ত আরোপিত হলেও তাদের কোনো লাভ হবে কি না, সন্দেহ।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য জামায়াতের সোচ্চার হওয়ার কারণ খুব একটা ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। তারা এই ব্যবস্থায় যথেষ্ট লাভবান হতে পারে বলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি এবং তার সমমনা অন্য দলগুলোর কাছে কমবেশি ভোটের ব্যবধানে জামায়াতের প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। ঠিক একই কারণে বিএনপি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব সমর্থন করছে না।
এবারে আসি আরেকটি গবেষণার কথায়। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মাইকেল আলবার্টাস এবং ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ভিক্টর মেনাল্ডো ১৮৭৫ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে স্বৈরশাসকের বিচার হয়েছে কি না এবং হলে তা কীভাবে হয়েছে , আর না হলে কেন হয়নি, তা বিশ্লেষণ করেছেন। ১১৩টি রূপান্তর বা গণতন্ত্রে উত্তরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন তাঁরা, যার মধ্যে একই দেশে একাধিকবারের রূপান্তরের ঘটনাও আছে। বাংলাদেশের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদও তাঁদের বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
‘ডিলিং উইথ ডিক্টেটরস: নেগোশিয়েটেড ডেমোক্র্যাটাইজেশন অ্যান্ড দ্য ফেট অব আউটগোয়িং অটোক্র্যাটস’ শিরোনামের ২০১৪ সালের এই গবেষণাপত্রের বিভিন্ন সারকথার অন্যতম একটি হচ্ছে, যেসব স্বৈরশাসক কঠোর সাজার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, তাঁরা তাঁদের রচিত বা পরিবর্তিত সংবিধানের অধীনেই সুবিধা পেয়েছেন। আবার আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন ব্যবস্থাও তাঁদের জন্য সহায়ক হয়েছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পথ যে সুগম হবে, সে কথা সহজেই অনুমেয়। ভোটের শতাংশের হিসাবে আওয়ামী লীগ সংসদে যতটা আসন পেতে পারে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার তুলনায় যে সাফল্যের সম্ভাবনা নগণ্য হবে, তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট হলে উচ্চকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতে পারে।
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক-কলামিস্ট, সাবেক সম্পাদক বিবিসি বাংলা ও প্রথম আলোর সাবেক কনসাল্টিং এডিটর