১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ সভাপতি, পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক লিডার অফ দ্য হাউজ খান এ সবুরের সঙ্গে ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে কোনো একদিন আমাকে রাজবাড়িতে যেতে হয়েছিল। পাংশা আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থী এবিএম নূরুল ইসলামের পক্ষে সবুর খান বক্তৃতা দেবেন। নূরুল ইসলাম ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান রচনায় ভূমিকা রাখেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন।
ঢাকা থেকে আমি সবুর খানের সাথে একই গাড়িতে ছিলাম। আরিচা পর্যন্ত তিনি আমাকে তার বিগত দিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলে যান। মৃদুভাষী ছিলেন তিনি। আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম, তিনি তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারের ঢাকনা খুলে দিতেন। পদ্মা পার হওয়ার পর গোয়ালন্দে এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে দুপুরের খাবারের আয়োজন ছিল। রীতিমতো শাহী খানাপিনার ব্যবস্থা। এরপর রাজবাড়িতে এবিএম নূরুল ইসলামের বাড়িতে বিশ্রাম ও চা নাশতার পর ট্রেনে চেপে যাই পাংশা। সেই প্রথমবার আমার ব্রডগেজ লাইনে ট্রেনে ওঠার অভিজ্ঞতা।
সমাবেশে খুব বেশি জনসমাগম হয়নি। আমরা রাত কাটাই এডভোকেট এবিএম নূরুল ইসলামের রাজবাড়ির নির্মানাধীন বাড়ির দোতলায়। দিনব্যাপী ব্যস্ততায় আমি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের এক হালকা-পাতলা ছাত্র মফিজ ইমাম মিলনকে। পরদিন সকালে সবুর খান আমাকে তার সঙ্গে খুলনা যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ঢাকায় ফিরে যাওয়া জরুরী বলে আমি অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি এবিএম নূরুল ইসলামকে ডেকে বলেন আমার ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করতে। নূরুল ইসলাম জানান যে তিনি নিজেই ঢাকা ফিরবেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। মফিজ ইমাম নামের ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগেছিল। আমি তাকে বলি আমাদের সঙ্গে ঢাকায় যেতে। তিনি সম্মত হন। আরিচা ঘাট থেকে গাড়িতে আরেকজন যাত্রী উঠেন। শ্রমিক নেতা শাহ আবদুল হালিম। সারাটা পথ শাহ হালিমের কথার তোড়ে আর কারও মুখ খোলার উপায় ছিল না।
ঢাকায় পৌছে এবিএম নূরুল ইসলাম তার কলাবাগানের বাসায় নেমে যান, শাহ হালিমও তার সাথে নামেন। ড্রাইভার আমাকে ও মফিজ ইমামকে আমার আবাস সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে পৌছে দেয়। গোসল সেরে, খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা সন্ধ্যায় যাই ঢাকা স্টেডিয়ামে। সেখানে বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) এর টাট্টু শো হবে। শো উপভোগ করে আমরা স্টেডিয়ামের প্রিন্স রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি খেয়ে হলে ফিরে আসি। মফিজ ইমাম আমার সাথেই রাত্রি যাপন করেন। সকালে নাশতার পর তিনি যোগাযোগ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান।
কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। সকল নদী দিয়ে প্রচুর পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। কিন্তু মফিজ ইমাম একটা চিঠি লিখেননি। কখনো ঢাকায় এসে একটি ফোন করেননি; দেখা করা তো দূরের কথা। ফরিদপুরের অনেক জুনিয়র ছেলে, যারা সাংবাদিকতায় এসেছে, তাদের মুখে তার কথা শুনেছি। কারণ তিনি তাদের আইডল ছিলেন, সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে একজন ভালো সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন। আমি শুনে আনন্দিত হই, দু:খবোধ করি আমাকে তিনি বিস্মৃত হওয়ায়।
২০১০ সাল থেকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার পর ২০১৪ সালে এক বালিকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটে। এটিএন বাংলার সংবাদ বিভাগের একজন কর্মী। নাম সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম। বাড়ি ফরিদপুর। ‘ইমাম’ নামে আমার একটু খটকা লাগে। তার পিতার নাম জানতে চাই। মফিজ ইমাম মিলন। হে ওপরওয়ালা! যে ইমাম আমাকে ভুলে আছেন, তার কন্যা ‘ইমাম’ এর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে! কি বিচিত্র এই ক্ষুদ্র জগৎ! আমি তার পিতার টেলিফোন নম্বর চাই। সে বিস্ময় প্রকাশ করে, “আপনি কি আমার আব্বাকে চিনেন?” আমি তাকে বলি যে মফিজ ইমামের ঘরে তার জন্মের বহু আগে থেকে তার পিতার সঙ্গে আমার পরিচয়। সবিস্তারে তার পিতার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাতের বিবরণ বলার পর মিলন ভাইকে ফোন করি এবং কড়া ভাষায় গালি দেই।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম কিছুদিন পরই নিউইয়র্কে আমার গরিবালয়ে আতিথ্য গ্রহণ করে এবং কয়েক মাস কন্যাবৎ বসবাস করে। আমি তাকে “ছোট মা’ ডাকি। আমার কন্যা সাদিয়া আনোয়ার দীয়া ওরই সমবয়সী। একসাথে ঘোরাফেরা করে। আমার স্ত্রী ও সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম পান খায়। দিনভর পান খেয়ে মুখ লাল করে রাখে। একদিন মাহজাবীন ইমামের রান্না করা খাবার খেতে চাইলে সে একা রান্না করে। একটি আইটেম ছিল, রুই মাছ। কোনো একটি সব্জি দিয়ে সে চমৎকার মাছ রান্না করেছে। আরিচা ঘাটের ভাতের হোটেলগুলোতে সাজিয়ে রাখা মাছ মাংসের তরকারির মতো আকর্ষণীয় রং। আহা! কতই না স্বাদযুক্ত হবে! রাতে একসাথে খাই। আমার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় থাকে সবাই। ফ্রেশ হয়ে টেবিল ঘিরে বসেছি আমরা। প্রধান আইটেম রুই মাছের ঝোল।
পাতে নিয়ে দেখি, আমি যে টুকরাটি নিয়েছি, সেটির আঁশ ছাড়ানো হয়নি। ভুলবশত হতেই পারে। কিন্তু না, সব টুকরাই আঁশযুক্ত। খাওয়া সিকেয় উঠে। সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম রান্নায় অভ্যস্ত নয়। সে বিব্রত হয়। চরম বিব্রত। আমরা তাকে মার্জনা করি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাকে উত্যক্ত করতে ভুলে যাই না।
তার পিতা মফিজ ইমামের সঙ্গে বোঝাপড়ার বাকি ছিল। আমার ছোট মা যোগাযোগ করলে দিনতারিখ স্থির করি। ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুরের দাওয়াত ছিল তার সেগুনবাগিচার বাসায়। বাড়ির নিচে অপেক্ষার সময়ে ১১তলা থেকে আমাকে নিতে আসেন মফিজ ইমাম মিলন। ৪৬ বছর পর আমরা আলিঙ্গনবদ্ধ হই। তাকে বলি, ‘আপনাকে হত্যা করতে পারলে আমার ক্ষোভ প্রশমিত হতো।” তিনি হাসেন। আমরা ওপরে উঠি। দরজা খুলে দেয় সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম। আমি সকল ক্ষোভ ভুলে যাই। ৪৬ বছর পেছনে না ফেলে আমরা স্মৃতিচারণ করি। ইমাম ভাইয়ের কন্যা ছোট ইমাম অবাক হয়ে শোনে।
* আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট