বাংলায় প্রবাদ আছে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি‘! হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাসে-লঞ্চে-ফুটপাতে সর্বত্রই এটা লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিতে এ ধরণের বাগধারা আর প্রবচনগুলো হাল আমলে বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। মতলব বিভ্রাটের কারণে ভাবসম্প্রসারণ সব সময় সহজ হয় না। ফলে কে মা আর কে মাসি হয়ত ঠাহর করা যায়না।
ভারতের কমলেশ চৌধুরী বলেছিলেন, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে ব্লাউজ কেনার ছক উল্টে ব্লাউজের সঙ্গে মানানসই শাড়ি কেনার দিকেও ঝুঁকেছে মহানগর। বৌমার ব্লাউজের পিছনে দুর্গার মুখ আঁকা। সেখানেই উমাকে বরণ করছেন শাশুড়ি। এখন চোখটা শাড়িতে নয়, ব্লাউজে চলে যায়! মায়ের চেয়ে মাসির কদর বেড়েছে!
’অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর‘ বলে আরেকটা কথা আছে। মাসিদের কান্নাকাটি দৃশ্যমান হলেও অধিক কাতরতায় মা যে পাথর বনে যান, সেটা হয়ত অনেক সময় বোঝা দায়। অধিক শোকে মানুষ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
মাসিদের দরদ যে নেই, তা হয়ত বলা যাবেনা। কিন্তু মায়ের জায়গাটা দখলে নিয়ে গেলে তখন মাসি হয়ে যায় মা। আর প্রকৃত মাকে মাসি বা দাসি বানিয়ে কুপোকাত যে করা হয়, তার খবর কেউ রাখেনা।
খেলার মাঠের ঘাসগুলো বড় হতে হতে আগাছার দখলে চলে যায় মাঠ। রিজেন্টের শাহেদ মার্কারা টিভি টকশোতে জাতিকে জ্ঞানগর্ভ নসিহত শুনায়। আর অধিপতিরা হয় প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দেশপ্রেমিক জনতা ও মুক্তচিন্তকদের বক্তব্য হয়ে যায় মামাবাড়ির আবদার। তখন মনে হয়, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
মা ও মাসি নিয়ে অনলাইনে একটি কবিতা দেখলাম। মাসি (বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি -অন্নদাশংকর রায়)। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল/ একটা সময় এমন কথাও বলতো লোকে।/ বন বাদাঁড় আর নদ পেরিয়ে, মাসির কোলে/ এসেছিলাম কাঁদতে আমি মায়ের শোকে।/ মাসিই কিনা কোল দিল না/ কাঁদার জন্য কাঁধ দিল না/ মাসির প্রিয় বুনো ফুল/ হঠাৎ হল চক্ষুশূল।/ সকাল সন্ধে মাসিই তাড়ায়, মাসিই বলে মর গে যা/ কোথায় যাবে অনাথ মেয়ে, কোন মুলুকে খুঁজবে মা?
খাটি কথা শুনতে অনেকেই নারাজ। রাষ্ট্র বা সমাজের যারা অধিপতি, প্রায়শ তারা চটে যান। দেশটাকে কত যত্নে তারা আগলে রেখেছেন! সেখানে জনগনের কোন মহতি প্রয়াসকে মাসিদের আনাগোনা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
আজকাল উন্নতির দৃশ্যগল্পে বাজার সয়লাব। বৃটিশ আমলের সাফল্য কাহিনীর মত। তারা আমাদের রেলগাড়ি চড়িয়েছে। টেলিগ্রাফের ব্যবস্থা করেছে। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে স্টিমারে যাতায়াত সুবিধা দিয়েছে। চা বাগান থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান শিল্প-কারখানা তৈরি করে দিয়েছে। তাহলে কেন বৃটিশ খেদাও আন্দোলন হল? আসলে, দাস বানিয়ে রেখেছে আর উজাড় করে নিয়ে গেছে কতকিছু, সেটাই ছিল মূল প্রতিপাদ্য।
পাকিস্তান আমলেও উন্নতির গান শুনেছে জনগন। আইয়ুব খানের দশকব্যাপী উন্নতির গানে কান ঝালাপালা হয়েছিল। এই গীত এক সময় রসাত্মবোধক রচনাতে সেকেল হয়ে ওঠে। মাসি আর মাসতুতো ভাইয়ের বেহালা বাজানোর মত মনে হয়েছে। ফলে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলার স্বাধীনতা।
‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ বুঝাতে সমকালে সাহিত্যিক মাসুম রেজা বেঙ্গক্তি করে লিখেছেন, মা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাড়া পাঠিয়ে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। … ভুলে যাওয়াতে মাই মাদার ইজ গ্রেট। দি মোস্ট ফরগেটফুল লেডি। … বিলম্ব হওয়ায় রিকশাওয়ালা মাকে নিয়ে মন্দছন্দ বলতে শুরু করলে আমার মায়ের পালিত সন্তান সালিক এসে তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে। এক বারের জন্য শুনতেও চায়নি রিকশাওয়ালার অভিযোগটা কী। মায়ের পালিত সন্তানের এই এক সমস্যা। মায়ের নামে কেউ কিছু বললেই হয়েছে। তার অবস্থা খুলনা-গোয়ালন্দ করে ফেলবে।
২০১১ সালের মার্চ মাসে ঢাকা সফরে গেলেন আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। চার দিনের সফরে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেখানে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সমঝোতা না হলে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। গ্রহণযোগ্য সমঝোতা হলে তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে।
২০১১ সালের ৪ এপ্রিল প্রভাষ আমিন নামে ড. ইউনূস বিদ্বেষী এক সাংবাদিক মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি শীরোনামে লিখেন, শচীন টেন্ডুলকার যখন বোঝেন তিনি আউট, তখন আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন না। নিজেই প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা ধরেন। এ জন্যই তিনি গ্রেট, সবাই তাকে রীতিমতো পূজা করে। আর রিকি পন্টিং আউট জেনেও বেনিফিট অব ডাউট পাওয়ার আশায় ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ জন্যই তিনি নিছক একজন ‘ভালো ব্যাটসম্যান’। নোবেল জিতে ড. ইউনূস নিজেকে ‘গ্রেট’দের পর্যায়ে তুলে নিয়েছেন। আমরা চাই তিনি সেখানেই থাকুন।
ড. ইউনূস বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কার নোবেল পেয়েছেন, তার চেয়েও বড় পুরস্কার সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড় নয়। হীরা ফেলে তিনি কেন কাচ তুলে নিতে চাইছেন, কেন নিজেকে বিতর্কিত করে নিজের অর্জনগুলো ভূলুণ্ঠিত করছেন। নিজেকে গ্রেটদের কাতার থেকে নামিয়ে আনছেন সাধারণের কাতারে?
প্রভাষ আমিনের এই লেখা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। অনেকে লিখেন, তুমি কোন শালারে… মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইন্দ্রনীল রায় একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। সার কথা ছিল মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের কলকাতা অফিস একটি বাংলা ছবি আটকে দেয়। কারণ স্তালিনের প্রতি অসম্মান সূচক মন্তব্য রয়েছে এই ছবিতে। এ নিয়ে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে গুঞ্জন! বাম আমল হলেও না-হয় কথা ছিল! কিন্তু পরিবর্তনের জমানায় খামোখা স্তালিনকে নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? এক দল ফুট কেটে বলছেন, এ যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
অন্য দলের বক্তব্য, স্তালিন তো উপলক্ষ মাত্র! আসল কারণটা ছিল সিঙ্গুরে টাটা-বিরোধী আন্দোলন ও ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্য। সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কাঙাল মালসাট’ ছবিটা নিয়ে অতএব জোর বিতর্ক।
২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ঈমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সহ কতিপয় আলেমদের অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, ধর্মীয় উগ্রতা কিংবা জঙ্গিবাদের কথা বলে সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা চলছে। সেখানে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার নামে উল্টো আরো সংঘাতময় পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশেও একই প্রয়াস চলছে। কথিত জঙ্গিবাদের নামে, আইএসের নামে খুন ও হামলা হচ্ছে। এসব নির্মূলে সহযোগিতা করতে মায়া কান্না করছে কেউ কেউ। যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে অনেকে জানতে চেয়েচিলেন, কে মা আর কে মাসি? তার উত্তর আর জানা যায়নি।
২০১৬ সালের ৩১ জুলাই আশরাফুল আলম খোকন নামের এক ‘নব্য দলবাজ’ সুন্দর বনে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষ দিতে গিয়ে তার ফেসবুক স্টেটাসে বলেন, যৌক্তিক কোনো যুক্তি না দিয়েই বলছেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। চিন্তা কইরেন না। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের ঝলকের অংশীদার আপনিও হবেন।
১৮ শতকে এই উপমহাদেশে যখন চা আসে তখনও এর বিরোধিতা করেছেন। মদ্যপ লোকগুলো বললো চা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এখন চা ছাড়া আপনাদের একদিনও চলে না। ১৯ শতকের মাঝামাঝি যখন ট্রেন চালু হয় তখনও এর বিরোধিতা করেছেন, বলেছেন কয়লা ইঞ্জিনের ধোয়ার কারণে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হবে। এমনকি কয়লা ইঞ্জিনের জাহাজ নদীতে শত শত বছর চলেছে। কিন্তু সাগর মহাসাগর গুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে। ওই ট্রেনে চড়ে আপনারা এখন বিশ্ব ভ্রমণ করেন।
যখন কলকাতায় সাবান চালু হয়, তখন ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। বলা হয়েছিল সাবানের ক্ষার পানি ধ্বংস করে দিবে। এখন আপনারা বাহারি রকমের সাবান ব্যবহার করেন। যখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ চলে তখন বলেছেন দুই কুকুরের লড়াই। এই দেশে বাস করেই এখন নিজেকে রাষ্ট্রের মালিক দাবি করেন। সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি থাকতে নেই। আপনারা যদি মনে করেন এই দেশের জন্য শেখ হাসিনার চেয়ে আপনাদের দরদ বেশি তখনই সন্দেহ হয়।
খোকনের ফেসবুকে শত শত লোক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, তুই কার খালুরে… মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি থাকতে নেই।
২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ বলে প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার বক্তব্য অপ্রত্যাশিত ও সংবিধান বিরোধী। আমরা রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সকল ভুল তথ্য প্রচার বন্ধ করে আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত মতামত বিবেচনার আহবান জানাই। বাংলাদেশের আপামর জনগণের দাবি মেনে নিয়ে সর্বোতভাবে সুন্দরবন ও দেশের সার্বিক পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি।
অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এই স্থাপনা বাংলাদেশকে ‘ফাঁকা পকেটে’ পরিণত করবে এবং তা থেকে মুক্তির ‘উপায় থাকবে না’ এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। বিশেষজ্ঞের মতামত তুলে ধরে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাবিত স্থান নিরাপদ রাখার বিষয় নিশ্চিত করতে বিশাল খরচ হবে। ফলে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম সহজ লভ্য রাখা সম্ভব হবে না। বঙ্গোপসাগর থেকে রামপাল প্রকল্প পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার নদীপথ ড্রেজিং করতে হবে। এতে করে ৩৪ মিলিয়ন ঘন মিটার নদীর তলা খনন হবে। আর ওই স্থানেই রয়েছে মাছ, কাঁকড়া ও ডলফিনের আবাসস্থল।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৫জন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ আলাদা ৫টি বিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন। এর ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন। এর মধ্যে ভারতীয় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ও জ্বালানী বিষয়ক পরামর্শক রঞ্জিত সাহু রামপাল প্রকল্পের বায়ু দূষণ ঝুঁকি নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়াটার কিপার অ্যালায়েন্সের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি দূষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডোনা লিসেনবি রামপালে পানি দূষণের সম্ভাব্যতা নিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেব নিয়েমেইয়ার রামপাল প্রকল্পের কয়লার ছাই নিয়ে মূল্যায়ন দিয়েছেন। সকল বিশেষজ্ঞের সর্বসম্মত মতামত হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করতে হবে, বলেন তিনি।
সুলতানা কামাল ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ বলে দেশের প্রকৃত মালিক জনগণের প্রতি মাসি বলে খেদোক্তি না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় সরকারের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কিছু পরামর্শসহ প্রধানমন্ত্রী বরাবর পত্র দেয় ইউরোপিয়ান ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ। চিঠিটিতে অ্যাকর্ড মজুরি বোর্ড গঠনসহ শ্রমিক অধিকার নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ ও অনুরোধ জানায়। আরএমজি টাইমস নামক পোর্টালে একজন লিখলেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর অ্যাকর্ড এর চিঠি, যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী!
এই লেখার প্রতিবাদে শ্রমিক জনতা প্লে কার্ড প্রদর্শন করেছিল, ‘জাতির জনকের পালক পুত্র বেড়ে গেছে। মায়ের চেয়ে যেন মাসির দরদ বেশী’!
২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষ করে দেশে ফিরেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপিএল নিয়ে। এমন সময় ক্রিকেটার তাসকিন তার বিয়ের ঘোষনা দেন। এই খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সবর হয়। তখন ক্রিকেটার আশরাফুল তার ফেইসবুকে লিখেন, সাধারণত যে কোন ব্যাপারে আমি প্রতিক্রিয়া কম দেখাই। তবে এবার আর কিছু না বলে থাকতে পারছিনা।
সাকিব, তামিম, মুশফিক, আমি, বা তাসকিন বিয়ে করার করার পর প্রতিবারেই আমাদের শুনতে হয় অমুক ক্রিকেটারের বৌ বুড়া, তমুক ক্রিকেটারের বৌ মোটা, অমুক ক্রিকেটারের বৌ নাক বোচা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাসকিনও রেহাই পেলোনা। তাসকিন কেন অল্প বয়সেই বিয়ে করল, তার বৌ কেন সুন্দরী না, দাঁত বের করে কেন হাসে এসব কমেন্ট আর স্ট্যাটাসে ফেসবুক ভরে গেছে। সাথে তাসকিন কে নিয়ে ১৮ + বাজে ট্রল ও দেখেছি অনেক।
আচ্ছা সংসারটা তাসকিন তার পছন্দ করা বৌয়ের সাথে করবে। সেখানে তার বৌ সুন্দরী না দাঁত বের করে হাসে এটা বলার আপনি কে? সংসার তাসকিন করবে, আপনি নন। তাসকিন যদি তার বৌয়ের সাথে সুখী থাকে তাহলে সেখানে নাক গলানোর আপনি কে? এই অধিকার কোথায় পেয়েছেন? মানছি আমরা পাবলিক ফিগার। কিন্তু তাই বলে আমরা আপনাদের আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দিয়ে দেইনি।
আমাদের পেশা ক্রিকেট খেলা। দর্শক হিসেবে আমাদের খেলা নিয়ে আপনি গঠনমূলক সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু আমি কি খাব, কোন ড্রেস পড়ব, কাকে বিয়ে করব এসব নিশ্চয়েই আপনি ঠিক করে দিতে পারেননা। কার বৌ মোটা, কার বৌ বুড়ি, কার বৌয়ের দাঁত উঁচু এসব নিচু মানের কমেন্ট আর স্ট্যাটাস দেয়ার আগে নিজেকে আয়নায় দেখেছেন তো?
তাসকিন কেন ২২ বছর বয়সে বিয়ে করল এটা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই অনেকের। সেকি কোন খারাপ কাজ করেছে? না করেনি। বরং ৭ বছরের প্রেমকে বিয়েতে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারকা হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু নাঈমার সাথে তাসকিনের রিলেশন। তারকা হওয়ার পরও যে সে মেয়েটিকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করেনি এজন্য তাসকিন বরং বাহবা পেতে পারে।
বলবেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি করা হয়ে গেছে? তাসকিনের বাবা মায়ের চেয়ে নিশ্চয়েই আপনারা আপন নন। তাদের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে এবং তারা মনে করেছেন এটাই ছেলের বিয়ের উপযুক্ত সময়। তাহলে সমস্যা কি? এটা নিয়ে যদি নেতিবাচক সমালোচনা করেন তাহলে বলতেই হচ্ছে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি‘।
২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপির অবস্থা এখন মুসলিম লীগের মতো। জবাবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপিকে নিয়ে তার এই মাথাব্যথা বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। এটা ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’র মতো।
২০১৯ সালের ৬ মে ভারতের আদলে বাংলাদেশেও স্মার্ট সিটি তৈরিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে ভারত। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস শেরেবাংলা নগরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কার্যালয়ে এক সৌজন্য সাক্ষাতে এ আগ্রহের কথা জানান। পরের দিন এবিনিউজ লিখেছিল, বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি গড়তে চায় ভারত, যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
পাঠক প্রতিক্রিয়ায় একজন লিখেন, জাতিসংঘ বলেছে, ‘বিশ্বের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধার অভাব সবচেয়ে বেশি ভারতে। ষাট কোটির বেশি ভারতীয় প্রতিদিন খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে’। আর তারা আমাদের স্মার্ট সিটি তৈরিতে বিনিয়োগ করবে। হা! হা!! হা!!!
২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ভারতে যুব মোর্চার নবান্ন অভিযানের দিনই বুকে ‘ম্যায় দলিত কি মা হু’ লেখা পোস্টার লাগিয়ে মিছিল করে মহিলা তৃণমূল কংগ্রেস। তা নিয়ে কটাক্ষ করেন বিজেপি সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরি। তার দাবি, পশ্চিমবঙ্গ বাদে দেশের অন্যত্র কী হচ্ছে সেই বিষয়ে বেশি নজরদারি চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল ৷ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে অকারণে মেরে ফেলা হলেও সেদিকে নজর না দিয়ে অন্য রাজ্যের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন এ যেন ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’।
করোনাভাইরাস তথা কোভিডের কারণে বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম ডেইলি ক্যাম্পাসে লিখেছেন, নিজের সন্তান মনে করে আমাদের অনেক আগলে রেখেছেন। আর আগলে রাখার দরকার নেই। সবার যা হবে আমাদেরও তাই হবে। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তত খুলে দেন। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হলে সেই মাসি রাক্ষস সমতুল্য হয়।
লেখক: সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।