অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরার বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সমাজ জীবনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। মাদ্রাসায় ন্যায়নিষ্ঠ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করার পাশাপাশি তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাখাতে সংকট কাটিয়ে উঠতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের দিকে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ মনোযোগী।

বুধবার (১৯ মার্চ) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘মাদরাসা শিক্ষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ নিয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ নানাভাবে শিক্ষা খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। নানাভাবে শিক্ষাখাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তারা। ভয়াবহ সংকটে শিক্ষাখাত ও শিক্ষাব্যবস্থা এখন খাদের কিনারায়। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারে মনোযোগী হবে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের চাহিদানুযায়ী কিভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ঢেলে সাজানো যায়, তার জন্য রাষ্ট্র কী করতে পারে, এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কি, এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
ড. সি আর আবরার বলেন, অতীতে পোশাকের কারণে অনেককে জঙ্গি সাজানো হয়েছিল। যারা এ কাজে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যেকোনো পেশায়ই খারাপ লোক থাকতে পারে। তাই বলে সবাইকে খারাপ বলা যাবে না। মাদরাসায় কোনো অপরাধ হলে সেগুলো তদন্ত করে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সকল সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিই সংবেদনশীল হতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের। এছাড়াও দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, মাদরাসার অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সভায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারের প্রথম সেশনে ‘মাদরাসা শিক্ষার অতীত ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। সেখানে তিনি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, অতীত এবং নানা ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করেন।
এই সেশনে ‘মাদরাসা শিক্ষার সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক।
ড. যুবাইর বলেন, ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মোট ৫টি স্তর রয়েছে। ক্লাস সাইজের ব্যাপারে মাদরাসাগুলোর অভিজ্ঞতা বৈচিত্রময়, কোথাও শিক্ষার্থী সংকট, কোথাও শিক্ষার্থীর আধিক্য।
ফাজিল ও কামিল শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ হলো-ভর্তি জটিলতায় বিলম্ব হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অন্যত্র সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সেশনজট ও দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের সময়ে চার বছরে মধ্যে ফাজিল ও কামিল পাশ করে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে যেতো।
তিনি বলেন, সহশিক্ষা মাদরাসার পরিবেশের জন্য মানানসই বা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমার ছাত্রজীবনে মাদরাসায় সহশিক্ষা ছিল না। বালিকা বা মহিলা মাদরাসা ব্যতীত অন্য মাদরাসাগুলোতে ইবতেদায়ীর ওপরের স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল না।
উপজেলা বা গ্রামের মাদরাসাগুলোতে ছেলের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি, বিশেষত ওপরের স্তরগুলোতে। কারণ ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শহরে চলে যায়। অনেক অভিভাবক মেয়েদেরকে দূরে পাঠাতে চায় না। ফলে তারা মফস্বল শহরে রয়ে যায়। তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য পৃথক মাদরাসা স্থাপন বা পৃথক সেকশন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। কোন মাদরাসায় মেয়ে শিক্ষার্থী অধিক হলে সেটি মহিলা মাদরাসা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ছেলেদের জন্য পৃথক মাদরাসা বা সেকশন চালু করতে হবে।
অধ্যাপক যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক আরও বলেন, মাদরাসায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে শিক্ষার্থী উপস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজন। আর আলিম শ্রেণি থেকে ক্লাসে শিক্ষার্থী উপস্থিতি হ্রাস পেতে থাকে। তবে ফাজিল ও কামিলে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার মাত্র ২৫ শতাংশ হতে পারে বলে মাদরাসার অধ্যক্ষগণ জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উচ্চশিক্ষায় প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী মাদরাসার পাশাপাশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়ে থাকে।
সেমিনারের দ্বিতীয় সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. এবিএম সিদ্দিকুর রহমান নিজামী ‘মাদরাসা শিক্ষাধারার উন্নয়ন-ভাবনা: করনীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাদেশের চারটি ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয় তুলে ধরেন। প্রবন্ধে তিনি মাদরাসা শিক্ষাধারার উন্নয়নে করণীয় ও সুপারশিমালার পাশাপাশাপি ইবতেদায়ি মাদরাসা, মাধ্যমিক শিক্ষা (দাখিল ও আলিম), উচ্চ শিক্ষা (ফাজিল ও কামিল), মূল বই থেকে পাঠদান, গাইড বই পরিহার করা, শিক্ষকদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও আরবি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে জোর প্রদান করেন।
এই সেশনে আরও বক্তব্য রাখেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসন ও কারিকুলাম ঠিক করতে হবে। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে জোর দিয়ে তিনি বলেন, আরবি ভাষা শিখতে হবে সহজভাবে, ঠিক মাতৃভাষার মতো করে। এই ক্ষেত্রে ডাইরেক্ট মেথড অনুসরণ করে।
সেমিনারের সর্বশেষ সেশনে ‘কওমী মাদরাসা : সার্বিক চিত্র ও করনীয়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাওলানা লিয়াকত আলী। প্রবন্ধে তিনি কওমী মাদরাসার নানা প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক অবস্থান, কওমী মাদরাসার মূলনীতি ও আদর্শ, বিদ্যমান চিত্র, সংহতি ও তদারকি, কর্মক্ষেত্রের প্রসারতা, পরিস্থিতি পরিবর্তনে করনীয় কি সে সকল বিষয় তুলে ধরেন।
সেমিনারের সর্বশেষ সেশনে কওমী মাদরাসার উন্নয়নে করনীয় কি তা নিয়ে গবেষণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্মসচিব ড. গোলাম আজম। ড. আজমের পিএইচডি গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে কওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে।

প্রয়োজেন কওমী মাদরাসার শিক্ষরা চাইলে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে সকল প্রকারের ইনফ্রাস্ট্রাকচার দিয়ে সহায়তা করা হবে বলেও আশ্বাস প্রদান করেন তিনি। মাওলানা ড. মো: আবু ই্উসুফের সভাপতিত্বে এই সেশনে আরও বক্তব্য রাখেন মাওলানা জুবায়ের আহমেদ, মাওলানা মাহাম্মদ আব্বাস উদ্দিন।
সেমিনারের শেষাংশে মাস্টার অব সেরিমনি হিসেবে পুরো সেমিনারের সকল বিষয়ে আলোকপাত করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ভুঁঞা। পুরো সেমিনারে উঠে আসে আলিয়া মাদরাসা ও কওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক। আলোচনায় উঠে আসে নানা দিকনির্দশামূলক তথ্য, উপাত্ত, পরামর্শ, সমস্যা, সমাধানে করনীয় কি সে সকল বিষয়। বক্তারা বলেন, শুধুমাত্র সভা-সেমিনারে আলাপ-আলোচনা করলেই হবেনা। সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রুত সময়েল মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে হবে। এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও প্রশাসন কার কি দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব কিভাবে পালন করলে মাদরাসা শিক্ষার উন্নতি ঘটবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।