নাসির মাহমুদ
ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট দৈনিক তেহরান টাইমস পত্রিকায় নতুন বিশ্বের প্রতি একটি বার্তা দিয়েছেন। এটি নেট দুনিয়ায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। অনেক গবেষক ও বিশ্লেষক এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
ওই বার্তায় মাসুদ পেজেশকিয়ান বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষ করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্ক, আফ্রিকা, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার সাথে সম্পর্ক বিষয়ে বার্তায় তিনি নিজ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।
মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন: ইরানের নতুন সরকার উত্তেজনা কমানোর যে-কোনো সৎ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাবে এবং সততার সাথে ওই প্রচেষ্টার জবাব দেবে।
পার্সটুডে জানায়, ‘নতুন বিশ্বের কাছে আমার বার্তা’ শিরোনামের নোটে তিনি গতানুগতিক ঐতিহ্যের উর্ধ্বে উঠে বৈশ্বিক পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেন। বিশ্বের দক্ষিণ ভূগোলে উদীয়মান আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও নেতাদের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করার ওপরও জোর দিয়েছেন পেজেশকিয়ান।
তেহরান টাইমস-কে দেওয়া মাসুদ পেজেশকিয়ানের নোট: নতুন বিশ্বের কাছে আমার বার্তা আঞ্চলিক যুদ্ধ ও অস্থিরতার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তার স্থিতিশীল পরিস্থিতি প্রদর্শন করেছে। কোনো কোনো দেশের ইরান বিশেষজ্ঞদের দাবির অসারতা প্রমাণ করেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচন পরিচালনার সুষ্ঠু পদ্ধতি, বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনেয়ীর বিচক্ষণতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইরানের জনগণ যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই সত্য প্রদর্শিত হয়েছে এই নির্বাচনে।
আমি ‘সংস্কার’, ‘জাতীয় ঐক্য শক্তিশালীকরণ’ এবং ‘বিশ্বের সাথে পারস্পরিক গঠনমূলক সহযোগিতা’র ওপর জোর দিয়ে নির্বাচনী কর্মসূচি নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। অবশেষে আমি আমার দেশবাসী, এমনকি যুব ও তরুণ সমাজের- যারা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অসন্তুষ্ট ছিল-তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে ভোট প্রদানে আকৃষ্ট করতে সফল হয়েছি। এই আস্থা আমার কাছে খুবই মূল্যবান। আমি নির্বাচনী প্রচারণার সময় আমার দেশের জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঐকমত্য সৃষ্টি করে সেইসব অঙ্গিকার পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন: প্রথমেই আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমার সরকার যে কোনো পরিস্থিতিতে ইরানের জাতীয় সম্মান ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা রক্ষাকে এজেন্ডার শীর্ষে রাখবে। ইরানের পররাষ্ট্র নীতি সম্মান, প্রজ্ঞা এবং সুবিধার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রেসিডেন্ট ও সরকারের উপর ন্যস্ত। আমি এই মহান লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সকল সাংবিধানিক ক্ষমতা কাজে লাগাতে চাই।
আমার সরকার ইরানের জাতীয় স্বার্থ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সকল দেশের সাথে একটি ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে আঞ্চলিক এবং বিশ্ব অঙ্গনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে চায়। এ বিষয়ে উত্তেজনা কমানোর আন্তরিক প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই এবং সততার সাথে আমরা সেই প্রচেষ্টার জবাব দেব।
আমার সরকারে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমরা একটি শক্তিশালী অঞ্চল গঠনের চেষ্টা করব। এমন সম্পর্ক নয় যেখানে একটি দেশ অন্যদের ওপর একক কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে চায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রতিবেশী ও ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর উচিত তাদের মূল্যবান সম্পদ নষ্ট করার মতো প্রতিযোগিতা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং একে অপরের ওপর অপ্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতা আরোপের দিকে ধাবিত না হওয়া। বরং তার পরিবর্তে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে প্রত্যেকের সম্পদ এ অঞ্চলের অগ্রগতি এবং উন্নয়নের জন্য, সবার সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করতে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে, যৌথ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে, অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং সংলাপ, বিশ্বাস স্থাপন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি আঞ্চলিক কাঠামো তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে আমরা তুরস্ক, সৌদি আরব, ওমান, ইরাক, বাহরাইন, কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত-সহ আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবো।
আমাদের অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, সন্ত্রাস ও চরমপন্থা, মাদক পাচার, পানি সংকট, শরণার্থী সংকট, পরিবেশ ধ্বংস এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের মতো নানা সংকটে জর্জরিত। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর আগামি গড়ে তুলতে এইসব কমন চ্যালেঞ্জগুলোকে একযোগে মোকাবেলা করার এখনই সময়। আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সহযোগিতাই হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষার আলোয় সমৃদ্ধ যেসব মুসলিম দেশের প্রচুর সম্পদ রয়েছে, রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য সেসব দেশকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। শক্তির যুক্তির পরিবর্তে যুক্তির শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। আমরা শান্তি প্রসার ঘটিয়ে, টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে, সংলাপ জোরদার করে এবং ইসলামোফোবিয়া মোকাবিলা করে পোস্ট-পোলার ওয়ার্ল্ড অর্ডারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে ইরান ভূমিকা রাখতে অবশ্যই প্রস্তুত রয়েছে।
১৯৭৯ সালে, ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ছিল উদীয়মান একটি নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা। তখনকার সরকার আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড এবং মানবাধিকারের মৌলিক নীতির ভিত্তিতে ইসরাইল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দুটি বর্ণবাদী সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আজ অবধি ইসরাইল একটি বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা হিসেবেই রয়ে গেছে। বরং তার দখলদারিত্ব, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত নির্মূল অভিযান, অবৈধ বসতি স্থাপন, পারমাণবিক অস্ত্র, ভূমির অবৈধ সংযুক্তি এবং তার প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের কালো রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘গণহত্যা’।
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমার সরকার প্রতিবেশী আরব দেশগুলোকে সহযোগিতার অনুরোধ করবে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সকল সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গাজার জনগণের ওপর গণহত্যা বন্ধ করতে এবং যুদ্ধবিরতির পরিধির বিস্তার রোধ করতে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেবে।
ফিলিস্তিনিদের চার প্রজন্মের জীবনকে ধ্বংস করেছে ইসরাইলি দখলদারিত্বের দীর্ঘসূত্রিতা। অতএব দীর্ঘ দখলের অবসান ঘটাতে আমাদেরকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম ও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি জোর দিয়ে বলছি, সরকারগুলোকে “১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন” এর ভিত্তিতে গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য থাকতে হবে। বিশেষ করে অপরাধীদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে প্রক্ষান্তরে গণহত্যাকে পুরস্কৃত করা যাবে না!
আজ মনে হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক তরুণই ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের সত্যতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। আমি এই সাহসী প্রজন্মকে বলতে চাই, ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমাদের নীতিগত অবস্থানের কারণে ইরানের বিরুদ্ধে ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগ শুধুমাত্র সম্পূর্ণ ভুলই নয়, বরং তা আমাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং মৌলিক মূল্যবোধেরও অবমাননার শামিল।
নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো ইহুদি-বিদ্বেষের এই অভিযোগগুলো ইসরাইলিদের অন্যান্য অভিযোগগুলোর মতোই ভিত্তিহীন। তোমরা যখন ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবাদ করেছো তখন তোমাদের ওপর যেরকম অভিযোগ চাপানো হয়েছিল এগুলোও সেরকম। কঠিন সময়ে চীন এবং রাশিয়া সবসময় আমাদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক ছিল। আমরা এই বন্ধুত্বকে ভীষণ মূল্য দিই।
ইরান ও চীনের ২৫ বছরের রোড ম্যাপ ছিল উভয় দেশের জন্য উপকারী। ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ তৈরির ক্ষেত্রে এই রোড-ম্যাপ পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশের প্রাক্কালে বেইজিংয়ের সাথে বৃহত্তর সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। ২০২৩ সালে চীন সরকার সৌদি আরবের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছে।
রাশিয়াও ইরানের একটি মূল্যবান কৌশলগত অংশীদার এবং প্রতিবেশী। আমার সরকার দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের জনগণের জন্য শান্তি কামনা করি এবং আমার সরকার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত থাকবে। আমার সরকার রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেবে বিশেষ করে ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এবং ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়নের মতো কাঠামোতে।
আমার সরকার গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নেতৃবৃন্দের সাথে, বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে, আমরা আমাদের সহযোগিতা ও সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করব। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে ইরানের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। আমার সরকার সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন, সংলাপ ও সহযোগিতা বজায় রাখতে এবং সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য পদক্ষেপ নেবে।
ইরান ও ইউরোপের মধ্যকার সম্পর্কে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে আমেরিকা JCPOA (জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন) বা পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাবার পর ইউরোপীয় দেশগুলি ইরানকে এগারোটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরমাণু চুক্তিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং ইরানের অর্থনীতির ওপর অবৈধ ও একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাবকে সংযত করতে ওই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
ওই প্রতিশ্রুতিতে কার্যকর ব্যাঙ্কিং লেনদেনের গ্যারান্টি, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কোম্পানিগুলির কার্যকর সুরক্ষা এবং ইরানে বিনিয়োগ প্রসারের কথা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলি ওইসব প্রতিশ্রুতি কেবল লঙ্ঘনই করে নি বরং তারা অযৌক্তিকভাবে আশা করে যে ইরান একতরফাভাবে পরমাণু সমঝোতার সমস্ত অঙ্গিকার পূরণ করবে।
এইসব বিচ্যুতি সত্ত্বেও সমতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার নীতির ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ককে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আমি ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে গঠনমূলক সংলাপ করতে প্রস্তুত।
ইউরোপীয় দেশগুলোর উপলব্ধি করা উচিত যে ইরানি জনগণ অত্যন্ত গর্বিত। তাদের অধিকার ও মর্যাদাকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। ইউরোপীয় শক্তিগুলো যখনই এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হবে এবং তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের মনগড়া ধারণা থেকে সরে আসবে, সেইসাথে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে এমন কৃত্রিম সংকটও কাটিয়ে উঠবে, তখন ইরান ও ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতার অনেক সুযোগ তৈরি হবে, সেইসব সুযোগ নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
সহযোগিতার সুযোগের মধ্যে রয়েছে: অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, জ্বালানি নিরাপত্তা, ট্রানজিট রুট, পরিবেশ, সেইসাথে সন্ত্রাসবাদ ও মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই, শরণার্থী সংকটসহ আরও বহু ক্ষেত্র।
আমেরিকাকেও বুঝতে হবে ইরান কখনো বলদর্পিতার জবাব দেয় নি এবং কখনোই দেবে না। আমরা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৫ সালে পরমাণু সমঝোতায় প্রবেশ করেছিলাম এবং আমরা সমস্ত প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণভাবে পূরণ করেছি।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ নীতি সংক্রান্ত বিরোধ এবং প্রতিশোধ চিন্তার কারণে ওই চুক্তি থেকে অবৈধভাবে বেরিয়ে গেছে। সমঝোতা থেকে একতরফাভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আমেরিকা ইরানের ওপর অবৈধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সময়টা ছিল করোনা মহামারীর কাল। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মাধ্যমে তারা ইরানের জনগণের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। জানমালের দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে তারা। শত শত বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইরান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে। সেইসাথে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে। একজন বিশ্বখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী নায়ক ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি। আইএসআইএস-এর মতো বর্বর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংঘাত থেকে এ অঞ্চলকে বাঁচাতে তিনি একজন সফল বীর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বিশ্ব আজ আমেরিকার ওই সিদ্ধান্তের ক্ষতিকর পরিণতি প্রত্যক্ষ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা শুধুমাত্র এ অঞ্চল ও বিশ্বের উত্তেজনা নিরসন ও নিয়ন্ত্রণের ঐতিহাসিক সুযোগই হাতছাড়া করে নি বরং অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি-এনপিটি’রও মারাত্মক ক্ষতি করেছে। কারণ তারা প্রমাণ করেছে এনপিটি চুক্তি মেনে চলার খরচ চুক্তি না মানার সম্ভাব্য সুবিধার চেয়ে বেশি হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার অনুমানের বিপরীতে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি সঙ্কট তৈরি করতে এনপিটি’র অপব্যবহার করেছে।
আমাদের জনগণের ওপর তারা ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে পরমাণু কর্মসূচিকে ব্যবহার করেছে। অপরদিকে একই সময়ে তারা সক্রিয়ভাবে এবং দ্বিধাহীনভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে গেছে। যেই ইসরাইল হলো একটি দখলদার, আগ্রাসী ও বর্ণবাদী সরকার। তারা এনপিটি চুক্তির সদস্যও নয় এবং সমস্ত তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত যে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
আমি আবারও গুরুত্বের সাথে বলতে চাই, ইরানের প্রতিরক্ষা নীতিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি নেই। আমি আমেরিকাকে তার অতীতের ভুল হিসেব-নিকেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নয়া নীতি গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর নীতি অতীতে যেমন সফল হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তাদের উচিত ইরানের বাস্তবতাকে স্বীকার করা এবং বিদ্যমান উত্তেজনা বৃদ্ধির নীতি পরিহার করা।
ইরানের জনগণ আমাকে একটি শক্তিশালী দায়িত্ব দিয়েছে। সেটা হলো আমি যেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা পালনের ওপর জোর দিই। যারা এই ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রচেষ্টায় যোগ দিতে ইচ্ছুক তাদের সবাইকে সহযোগিতা করার জন্য আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
* নাসির মাহমুদ কবি, গীতিকার ও রেডিও উপস্থাপক E-mail: nasir.radio@gmail.com