পুলিশের গুলিতে নিহত সাঈদের শেষ পোস্ট, ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা বেশি গর্বের

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই ২০২৪) বাংলাদেশ সময় বেলা ২ টার দিকে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আন্দোলকারী আবু সাঈদ। পরে সহপাঠীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

মৃত্যুর একদিন আগে ১৫ জুলাই আবু সাঈদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে চলমান আন্দোলনে শিক্ষকদের অংশ গ্রহণ না করা নিয়ে আক্ষেপ করে একটি পোস্ট দেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে।

১৯৬৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন সেই সময়কার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (তৎকালীন রিডার) সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। এই শিক্ষকও তার মৃত্যুর আগের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের এক সভায় বলেন- “আজ আমি আমার ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার আমার গায়ে লাগে।”

সেই শামসুজ্জোহার এই উক্তিটি ফেসবুকে পোস্ট করে নিজের মৃত্যুর আগের দিন আবু সাঈদ লিখেছেন- “স্যার! এই মুহুর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। এই প্রজন্মে যারা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেচেঁ আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাচুঁন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাড়াঁন। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেচেঁ থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।

অন্তত একজন ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।”

পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার পুরো ঘটনার একটি ভিডিও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। সেই ভিডিওতে দেখা গেছে- আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংর্ঘষ শুরু হওয়ার সময় সবার সামনে ছিলেন আবু সাঈদ। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে থাকলে আন্দোলনকারী অন্যরা পিছু হটে গেলেও হাতে একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে স্লোগান দিতে থাকেন আবু সাঈদ। এই সময় ঠিক সামনে থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে পুলিশ। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে পুলিশের সেই রাবার বুলেট ঠেকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় আবু সাঈদকে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে পুলিশের ছুড়তে থাকা রাবার বুলেটে কয়েকটি শরীরে লাগে তার।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, গুলি শরীরে লাগলে এক পর্যায়ে পিছু হঠেন আবু সাঈদ। ফুটপাতে বসে পড়েন। তখন পেছন থেক কয়েকজন আন্দোলনকারী দৌড়ে এসে তার হাত-পা ধরাধরি করে নিয়ে যায়।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে নিহত আবু সাঈদের বন্ধু অঞ্জন রায় বলেন, “শরীরে একের পর রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এ সময় সংঘর্ষ চলছিল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি হয়।”

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হৃদয় রঞ্জন রায় বলেন, “মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর শরীরের একাধিক স্থানে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু রাবার বুলেটের আঘাতে মারা গেছেন কি না, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।”

নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান বলেন, “বাবা মকবুল হোসেন শারীরিক অসুস্থতায় শয্যাশায়ী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আবু সাঈদ ছিল সবচেয়ে মেধাবী। তাই পরিবারের সবার উপার্জন দিয়ে তাকে এতদূর পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিন সে অনেক বড় হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে সে আশা ছিল।”

তিনি আরও বলেন,“আদরের ছোট ছেলের মৃত্যুর খবরে প্রায় পাগল হয়ে গেছেন মা মনোয়ারা বেগম। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।” – ভয়েস অব আমেরিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *