বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা৷ এই আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সব ধরনের কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ তবে কোটা বাতিলের ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন৷ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন৷ চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ বছরের ৫ জুন রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট৷ এর মাধ্যমে ফের কোটা ফিরে আসার সুযোগ হয়৷
তবে হাইকোর্টের এই আদেশের পর থেকেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে ফের আন্দোলনে নামেন৷ শুরুতে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হলেও ৭ জুলাই থেকে আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করার এক দফা দাবি জানাচ্ছেন৷
দাবি আদায়ে সারাদেশে তারা বাংলা ব্লকেড নাম দিয়ে অবরোধ করছেন৷ কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা৷ খুব দ্রুত কোটা নিয়ে সমস্যা সমাধান হবে এমনটা আশা করা যাচ্ছে না৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো কোটা নিয়ে বারবার কেন তরুণরা আন্দোলন করছেন?
কীভাবেই বা কোটা প্রথা এলো?
আসলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত৷ বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই ব্যবস্থা শুরু হয়৷ তবে সেটা হয়েছিল নির্বাহী আদেশে৷
১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সরকারি একটা আদেশে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে ২০ শতাংশ মেধা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ১০ শতাংশ নির্যাতিত নারী কোটা চালুর বিধান করা হয়৷ বাকি ৪০ শতাংশ রাখা হয়েছিল জেলা কোটা৷ ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়৷ ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়৷ বাকি ৫৫ শতাংশ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়৷ পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ যোগ করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ৷ মানে হলো, প্রতি ১০০ পদে নিয়োগে ৫৬ জনকে নেওয়া হতো কোটা থেকে৷ ২০১৮ সাল পযর্ন্ত এভাবেই চলছিলো৷
ওই কোটা ব্যবস্থা অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসসি যদি ১০০ জন লোক নিয়োগ করে, তাহলে মাত্র ৪৫ জন নিয়োগ পাবেন মেধার ভিত্তিতে, ৩০ জন নিয়োগ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মধ্য থেকে, ১০ জন নারী কোটায়, ১০ জন জেলা কোটায় এবং পাঁচজন নিয়োগ পাবেন উপজাতি কোটায়৷ এই ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে সবসময় মেধার চেয়ে কোটায় বেশি নিয়োগ হয়েছে৷ ফলে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে৷
সহজ করে বললে, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়৷ কিন্তু অংশ নেন তিন থেকে চার লাখ পরীক্ষার্থী৷ কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি দুই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি না-ও পেতে পারেন৷ কারণ, ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে৷ কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না৷ আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন৷
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছিলেন৷ ৬১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে (তখনকার হিসাবে) নিয়োগ সংবিধান সম্মত নয়৷ সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে৷ ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না৷
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন৷ কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে৷ তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন৷ তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি, ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়৷ তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি৷ বরং ২০১৮ সাল পযর্ন্ত ৫৬ শতাংশ কোটা ছিলো যা নিয়ে ক্ষোভ বেড়েছে তারুণ্যের৷
শুধু বিসিএস নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়োগেও একই অবস্থা হয়৷ প্রার্থী না পাওয়ায় হাজারো পদ শূন্য ছিলো৷ একদিকে তরুণরা চাকুরি পাচ্ছেন না অন্যদিকে পদ শূন্য৷ এসব কারণেই কোটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে৷ এর মধ্যে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৩৪ তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের পর জানা যায় আগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে কোটার বন্টন হলেও ওই বিসিএসের প্রিলিমিনারিতেই কোটা বন্টন করা হয়৷ এর ফলে দেখা যায় মেধার জন্য এক রকম নম্বর আর কোটার জন্য অনেক কম নম্বর৷ বৈষম্যমূলক ওই ফলাফল বাতিলের দাবিতে তরুণরা রাজপথে নামে৷ কোটার বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলন করে৷ পরে পিএসসি নতুন করে সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করে৷ তখন থেকেই কোটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে তারুণ্যের৷
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে তরুণরা৷ পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দমন-পীড়নের মুখেও সারা দেশে এই আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে৷ এপ্রিলে মাসে ওই আন্দোলন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে৷ তখন ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, ‘যখন কেউই কোটা চায় না, তখন কোন কোটাই থাকবে না, কোটা পদ্ধতি বাতিল৷’
প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার ৭৫ দিন পর কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিলের সুপারিশ করার জন্য সচিব কমিটি গঠন করে সরকার৷ তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির সদস্য ছিলেন অর্থ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আক্তারি মমতাজ এবং লেজিসলেটিভ বিভাগের সিনিয়র সচিব শহিদুল হক৷
কমিটি সর্বসম্মতভাবে তিন দফা সুপারিশ করেছিল৷ প্রথমটি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ৷ দ্বিতীয়-বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং তৃতীয়-কোটা বাতিলের ফলে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রতিফলিত প্রভাব নির্দিষ্ট সময় অন্তর পর্যালোচনা করা৷ কমিটি ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকার প্রধানের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে৷ প্রতিবেদন পাওয়ার পর ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷
তবে পুরোপুরি কোটা বাতিল হলো সেটিও একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল৷ কারণ, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কখনো কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল চাননি, তারা চেয়েছিলেন কোটার সংস্কার৷ আন্দোলনকারীরা তখন বলেছিলেন, কোটা ৫৬ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক৷ এমনকি তারা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি ছিলেন৷ ওই সময়ে কোটা ২০ শতাংশ রাখা হলেও সমস্যা ছিলো না৷ তবে সরকার পুরোপুরি কোটা তুলে দেয় যেটি ছিলো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত৷ এর ফলে ফের এ নিয়ে সংকটের সুযোগ সৃষ্টি হয়, হয়েছেও তাই৷ – শরিফুল হাসান