* প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি কামনা বাগান মালিকদের
হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী সিলেট থেকে:
ফেব্রয়ারীর শেষের বৃষ্টি চা-উৎপাদনের জন্য ‘আশির্বাদ’ মনে করে থাকেন বাগান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবার কাঙ্খিত সেই বৃষ্টি ঝড়েনি। রুক্ষ বাগানগুলোতে শেষতক মধ্য মার্চে অল্প বৃষ্টি ঝড়েছে। সব বাগান এই বৃষ্টি পায়নি। ফলে এবার মার্চের প্রথমে চিরাচরিত নিয়মে ‘চা-চয়ন’ (পাতি তোলা) উতসব সেভাবে হয়নি।
হাতেগুনা কিছু বাগানে তা হলেও, চা-শ্রমিকদের মধ্যে সেই উতসাহ ছিলনা। বেতন বোনাস, প্রবিডেন্ট ফান্ডের টাকা বকেয়া থাকায় তারা ‘ফাগুয়া’ উতসবও করতে পারেননি। সব মিলিয়ে সিলেটের হাতেগুনা বড় কিছু বাগান ছাড়া সব কটি বাগানে চলছে চরম আর্থিক সংকট।
‘বাগানে দুর্ভিক্ষ চলছে’ এমন মন্তব্য করে শ্রমিকরা বলেন, ‘অনাহারা অর্ধাহারে অন্তত: ৬-৮ মাস থেকে কষ্টের জীবন পার করছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাগান ব্যবস্থাপক বলেন,‘ বেতন নাই। বাগানে গ্যাস লাইন কেটে দিয়েছে। নিজেরও আর্থিক অবস্থা খারাপ। এরমধ্যে শ্রমিকদের চাপ। আর সহ্য হয়না তাই রমজানের আগে বাগান ত্যাগ করে পরিবার নিয়ে শহরে উঠেছি।’
এদিকে শ্রমিকরা তাদের বকেয়া-সহ ১১ দফা দাবিতে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিলে করেছে গত ২৫ মার্চ।
চরম এই সংকট লাঘবে সিলেট জেলার জেলা প্রশাসন, চা বাগানের নিন্ম আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ালেন মানবিক সহায়তা নিয়ে। জেলা প্রশাসকের একান্ত উদ্যোগে ১ হাজার ৪ শত জন চা-শ্রমিকদের মাঝে নগদ সাত লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদান ও ১৪ মেট্রিক টন চাল প্রদান করেন ঈদের আগে।
সিলেট সদর উপজেলাধীন বুরজান, কালাগুল, ছেড়াগাং ও খাদিম ফ্যাক্টরি চা বাগানে ১৫ সপ্তাহ ধরে বেতন ও রেশন বন্ধ থাকায় চা শ্রমিকরা অর্ধাহারে অনাহারে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারা তাদের দুর্দশার কথা সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে জানালে তিনি বুরজান চা-বাগানের ৩৪৬ জন, কালাগুল চা-বাগানের ৫৪২ জন, ছেড়াগাং চা বাগানের ৩১২জন এবং বুরজান অর্ন্তগত ২০০ জন-সহ মোট ১ হাজার ৪ শতজন চা-শ্রমিকের মাঝে ৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ ও ১০ কেজি করে চাল প্রদান করেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের অবস্থা খুবই মর্মান্তিক। তারা অসহায় অবস্থায়। শ্রমিকরা খেয়ে না খেয়ে আছেন।’ বাগান রক্ষার জন্য কিছু একটাতো করতে হবে।’
বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশনের নর্থ সিল্টে ভ্যালীর চেয়ারম্যান ও বাংলাদে টি এসোসিয়েশসনের সিলেট ব্রাঞ্জের ভাইস প্রেসিডেন্ট নোমান হায়দার চৌধূরী বলেন,‘দীর্ঘ জীবনে এমন খারাপ অবস্থা দেখিনি।’ বাগান সংশ্লিষ্টরা বলেন, রপ্তানীমুখি এই পণ্যকে রক্ষা করতে, ‘সর্বাগ্রে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে। বাগানগুলোকে কৃষি পণ্যে হিসাবে গণ্য করে ব্যাংক ঝণে সুদের হার ১৪ ভাগ থেকে নামিয়ে ৯ ভাগে আনতে হবে। চা-এর নিলাম মূল্য বৃদ্ধি, গ্যাস বিদ্যুত সহ কিছু সমস্যার আশু প্রয়োজন।’
বাগান মালিকরা এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা-সহ সরকারের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি কামনা করছেন।
সূত্র জানায়, শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট কম মূল্যে বাগান ক্রয় করে চোরাই ও নিম্নমানের চা কিনে প্যাকেটিং করে চড়া দামে বাজারজাত করতে চায়। এতে চা-গুনগত মান হারাবে। ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন সিলেটে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে চা-উৎপাদনে গুনগত মান বৃদ্ধির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে বলেন, তা না হলে বিদেশে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। তিনি সংকট উত্তোরনের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের কথা বলেছেন।
অন্যদিকে চায়ের নিলামে গড় দাম অস্বাভাবিক কমে আসে গত মৌসুমে (২০২৩-২৪) সালে। সে সময় নিলামে চায়ের কেজি প্রতি গড় দাম নেমে আসে ১৭১ টাকায়, যা আগের মৌসুমের তুলনায় কেজিতে ২৫ টাকা কম। উৎপাদন খরচের চেয়ে নিলামে চায়ের বিক্রয়মূল্য কমে যাওয়ায় লোকসান ঠেকাতে সরকারের একটি কমিটি চায়ের নিলামে ন্যূনতম দাম বা ফ্লোর প্রাইসের সুপারিশ করে। গত বছরের ২৯ এপ্রিল থেকে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়।
নিলামে চা বেচাকেনায় মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল ব্রোকার্সে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ন্যূনতম নিলাম মূল্য কার্যকর হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪১ টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ৪০টি নিলামের বেচাকেনার হিসাব দেখা যায়, এবার ৭ কোটি ৫৫ লাখ কেজি চা বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চায়ের গড় মূল্য ছিল ২০৬ টাকা ৪৬ পয়সা।
চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে আটটি নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর মধ্যে আগামী ২১ এপ্রিল সর্বশেষ নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। মৌসুমের শেষে চায়ের মান নিম্নমুখী থাকে। ফলে মৌসুম শেষে গড় দাম আরও কমতে পারে। চা-বাগান মালিকেরা বলছেন, ২০১৯-২০ মৌসুম থেকে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন খরচের চেয়ে চায়ের নিলাম মূল্য কমেছে। নোমান হায়দার চৌধূরী বলেন, চা এর নিলাম মূল্য প্রতি কোজি অন্তত: ৩০০ টাকা হওয়া প্রয়োজন।
চায়ের দরপতন ঠেকাতে চলতি মৌসুমের (২০২৪-২৫) নিলামে ফ্লোর প্রাইস বা ন্যূনতম নিলাম মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। তাতে গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে নিলামে চায়ের গড় মূল্য বেড়েছে।
তবে উৎপাদকেরা বলছেন, নিলামে দাম বাড়লেও চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে আরও বেশি। এতে এবারও অনেক বাগান মালিককে লোকসান গুনতে হবে।
চা-বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে চায়ের উৎপাদন খরচ ছিল ২২৬ টাকা। গত বছর চায়ের উৎপাদন খরচ কেজিতে ৯ টাকা বেশি হতে পারে বলে ধারণা করছেন বাগান মালিকেরা। তবে এখনো চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ চা সংসদ।
বাংলাদেশ চা সংসদের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ন্যূনতম নিলামমূল্য বেঁধে দেওয়ায় আমাদের আশা ছিল, নিলামে গড় দাম অনেক বাড়বে। তবে গড় দাম কিছুটা বাড়লেও তাতে উৎপাদন খরচ উঠে আসবে না বেশির ভাগ বাগানের। কারণ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ২০২৪ সালে চায়ের কেজিপ্রতি গড় উৎপাদন ব্যয় ২৩৫ টাকায় উন্নীত হতে পারে। অথচ এখন পর্যন্ত নিলামে গড় দাম পাওয়া গেছে ২০৬ টাকা। ভালো দাম পাচ্ছে কিছু বাগান।
চা এমন একটি পণ্য, যেটি নিলামে তুলে বিক্রি করতে হয় উৎপাদকদের। সাধারণত বাগানমালিকেরা বাগান থেকে পাতা তুলে চা তৈরির পর তা গুদামে পাঠান। ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে।
নমুনা অনুযায়ী চায়ের মান নির্ধারণ করে তারা। এরপর প্রতি সপ্তাহে নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে চা বিক্রি করা হয়। লট অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতারা কর পরিশোধ করে গুদাম থেকে চা তুলে নেন। এর বাইরে বাগান মালিকেরা চাইলে নিজস্ব বাগানের উৎপাদিত চায়ের ২৫ শতাংশ নির্ধারিত পরিমাণ কর দিয়ে প্যাকেটজাত করতে পারেন। চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। তবে সিংহভাগ চা বিক্রি হয় চট্টগ্রামের নিলাম কেন্দ্রে।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৩৯টি নিলাম পর্যন্ত শীর্ষ ৩০টি বাগানের চায়ের গড় দাম পাওয়া গেছে, সম্ভাব্য গড় উৎপাদন খরচের (২৩৫টাকা) চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে ১৩টি বাগানের চা। সর্বোচ্চ কেজিপ্রতি ২৮৪ টাকা দরে চা বিক্রি হয়েছে সিলেটের আমতলী বাগানের চা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হবিগঞ্জের মধুপুর বাগানের চা। প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২৮২ টাকা ৬০ পয়সা।
চা ব্যবসায়ীরা জানান, চায়ের লিকারের ওপর ভিত্তি করে ছয় ধাপে এবার ন্যূনতম মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়। বাগানমালিকেরা ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চায়ের নমুনা পাঠানোর পর তারা লিকার রেটিং করে।
সবচেয়ে সাধারণ মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি ১৬০ টাকা। এর চেয়ে ভালো মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য যথাক্রমে ২১০, ২২৭, ২৪৫ ও ২৭০ টাকা। সবচেয়ে ভালো মানের চায়ের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ৩০০ টাকা।
নিলামে সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক দরেই চা বিক্রি হয়।
চা ব্যবসায়ীদের সংগঠন টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শাহ মঈনুদ্দিন হাসান বলেন, চায়ের মানের ওপর নিলামে দাম ওঠানামা হয়। ভালো দাম পেতে হলে চায়ের মান বাড়ানোর বিকল্প নেই।
২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন:
চা শ্রমিক ইউনিয়ন জানায়, শ্রমিকদের বাড়িঘর, আবাসনের ব্যবস্থা, পানি ও চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা রয়েছে। ২০১৯ সালে একশত মিলিয়ন চা উতপাদন করে দেশে চা-শিল্পের ১৭০ বছরের ইতিহাস রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এই চা-শিল্পকে বাচাতে হলে ‘সর্বাগ্রে নিলামে সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণপ্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে’, বললেন চা-সংস্লিষ্টরা।
আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও চা-রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশেকি মুদ্রা অর্জন সম্ভব:
চা-একটি সংবেদনশীল কৃষি পণ্য। এর জন্য সুষম আবহাওয়া জরুরী। অনেকেই মনে করেন, দেশের রপ্তানীযোগ্য ঐতিহ্যবাহী এই কৃষিজাত শিল্পটিকে সঠিক পৃষ্টপোষকতা দিলে আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও চা-রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশেকি মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সৃজন হয় সিলেট বিমান বন্দর সড়কের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সালে। এখানে বাণিজ্যিক চা-চাষ শুরুর পর ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও পঞ্চগড়ে।
সিলেটের তিন জেলায় ১৩৫টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২, হবিগঞ্জে ২৪ ও সিলেটে ১৯টি। পাহাড় টিলা বেষ্টিত এ মাঠির চা-এর গুণগত মান উন্নত। সারা দেশে লক্ষাধিক চা শ্রমিক কাজ করছেন। ২০২২ সালের শ্রমিকরা মজুরী বৃদ্ধি-সহ বেশ কিছু দাবিতে দীর্ঘ অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সরকার চা-শ্রমিকদের মজুরী দৈনিক ১২০-১৭০ টাকায় উন্নীত করে। এর সাথে প্রতি বছর মজুরীর ৫ ভাগ বৃদ্ধির জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু শ্রমিকরা বলেছেন, এতে তাদের পুষায়না।
সংকট উত্তরণে ১০ সুপারিশ:
বিগত সরকারের সময় চা শিল্পের সংকটময় পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ সম্বলিত আবেদন করেছিলেন বাগান মালিকরা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরেও সেই সুপরিশগুলো তুলে ধরা হয়। সেগুলোর মধ্যে, চায়ের নিলাম মূল্য নিন্মতম ৩শ টাকা কেজি নির্ধারণ, ব্যাংক ঝাণের সুবিধা ও সুদহার হ্রাস ইত্যাদি।
