সাঈদ চৌধুরী
বাংলাদেশ থেকে পলাতক শেখ হাসিনা ও তার সহচরদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের জন্য সহায়তার দাবিতে সোমবার (১২ আগস্ট ২০২৪) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন দ্য ইউকে লইয়ার্স অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশের (The UK Lawyers’ Alliance for Bangladesh-ULAB) নেতৃবৃন্দ।
গত ১৫ বছরের সকল গুম ও খুনের বিচারের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিটি গঠন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হাসিনার বিচার করা, ইউকেতে হাসিনা ও তার দোসরদের কোন প্রকার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান না করা, হাসিনা ও তার সহচরগণ হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে ইংল্যান্ডে যে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তা বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদের বিচারের আওতায় আনা ইত্যাদি দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে হস্তান্তর করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল হক আফেন্দী, ব্যারিস্টার মোঃ ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ সাইফ উদ্দিন খালেদ, ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ব্যারিস্টার মোহাম্মদ নুরুল গাফফার প্রমুখ।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সরকার কর্তৃক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের বিষয়ে আবেদন জানিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, আমরা যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবীরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে উদ্ভূত ঘটনা এবং ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার অপসারণের ঘটনা সম্পর্কে আপনি পুরোপুরি অবগত আছেন। আমরা গভীর উদ্বেগ ও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি, ক্ষমতাচ্যুত শাসকদের দ্বারা ছাত্রদের বিক্ষোভকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করার মর্মান্তিক ঘটনায় ৫শ’র বেশি ছাত্র ও যুবক এবং ৩২ জন কিশোরের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল ৪ বছর বয়সী শিশু।
প্রকৃতপক্ষে খুনি হাসিনার সরকার তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কারফিউ জারি করে গণহত্যাকে ঢেকে রাখার জন্য সমস্ত ইন্টারনেট এবং ব্রডব্যান্ড মোবাইল-সহ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন তরুণ বিক্ষোভকারীদের সরাসরি মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এই পরিকল্পিত হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘ-সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি আওয়ামী শাসন দ্বারা সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। উপরন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিচার বিভাগ ও পুলিশ-সহ বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে তাদের অধীনস্থ করার ব্যাপক প্রমাণ শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়। তার বোন শেখ রেহানার (টিউলিপ সিদ্দিকের মা) বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি শেখ হাসিনার দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে জড়িত।
বর্তমানে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের জনগণ আনন্দিত হয়েছে। তবে, হতাশাগ্রস্ত পলাতক শেখ হাসিনা গং ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়ানো-সহ নবগঠিত অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে সর্বাত্বক অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের নীতিগুলিকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য দ্য ইউকে লইয়ার্স অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ কাজ করছে। আমরা বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে ব্যথিত। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এবং দেশের জনগণকে সেবা করার জন্য সকল প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের জরুরি পদক্ষেপগুলির সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করতে চাই। মানবাধিকার দলিলের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশী রাষ্ট্র এবং এর নিরাপত্তা যন্ত্রের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাগুলির একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের দ্বারা সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই গণহত্যা এবং গোপন কবর দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে যা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করা উচিত।
হাসিনার শাসনের পতনের পর আবিষ্কৃত হয়েছে যে, শত শত বিরোধী সদস্যকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং গোপন অন্তরীণ কেন্দ্রে (কথিত ‘আয়নাঘর’) আটকে রাখা হয়েছিল, যেখানে অনেককে ১২ বছর পর্যন্ত গুম বা আটক রাখা হয়েছিল। হাসিনা তার শাসন পতন না হওয়া পর্যন্ত সেই আয়নাঘরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। এর সুস্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে যে নন-স্টেট অ্যাক্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর যুব-ছাত্র শাখা ছাত্রলীগ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যায় পুলিশের সাথে কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এবং তার দলের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের সরাসরি কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা ব্যক্তিরা এই সব অপরাধের সাথে জড়িত। তাই, শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রী এবং অন্যান্য অপরাধীদের কোনো রকম সুরক্ষা দেওয়া জনকল্যাণের জন্য সহায়ক হবে না। আমরা আপনার সরকারকে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন উন্নীত করতে এবং এর বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে পুনর্গঠনের জন্য যে কোনো গঠনমূলক উপায়ে নির্দেশনা প্রদান এবং সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করছি। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি সঙ্কটের সময়ে নীরব না থাকার জন্য এবং বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের জন্য আপনার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা চাই যাতে বাংলাদেশের সংঘাতে খুন ও গুমের বিচার হয়।