হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী, সিলেট থেকে :
প্রায় দেড় মাস সময় ধরে কর্মবিরতী চলছে ন্যাশনাল টি কোম্পনীর (এনটিসির) ১৯টি চা বাগানে। ১৫ হাজার চা-শ্রমিক বেকার দিন কাটছে। তাদের পূষ্যরা-সহ অন্তত: ৫০ হাজার লোক অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। ঐসব বাগানে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও ১৩ মাসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের (পিএফ) চাঁদা তহবিলে জমা না দেওয়ার প্রতিবাদে গত ২০ অক্টোবর থেকে শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এতে বাগানে, ফ্যাক্টরীতে ও গুদামে বিপুল পরিমান ‘পাতি’ নষ্ট হচ্ছে।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, তহবিল না থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এতে ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকার। এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি চা-বাগানের ম্যানেজার সোমবার বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কারণে দেশের রপ্তানী যোগ্য চা-শিল্প এখন ধংশের মুখোমুখি।’ তিনি বলেন, ‘হাতে গুনা কয়েকটি বাগান ছাড়া শতাধিক চা-বাগান তহবিল সংকট। অনেকেই ব্যাংক ঝাণ শোধ করবেন দূরের কথা চা-শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ‘তলব’(মজুরী) দিতে পারছেননা। শ্রমিকদের তাগিদের ভয়ে অনেক বাগান কর্তৃপক্ষ এখন পালিয়ে থাকেন।’ ঐ কর্মকর্তা জানান,তাদের বাগানটি এখন ৭-৮ কোটি টাকা লোকসানে। বাগান বিক্রয় করতে ক্রেতা খুঁজছেন মালিক।’
সূত্র মতে, কিছু বাগান কোন রকমমে ঠিকে আছে চা-এর ‘ব্লান্ডিং’ এর মাধ্যমে প্যাকেট জাত করে, মোটা পুঁজি বিনিয়োগ করে ও সিন্ডিকেটের কারণে। বাগান সংস্লিষ্টরা বলেন, ব্যাংকর্ ঋণ না পাওয়া, ব্যাংকে ঝণে সুদের হার ৯ ভাগ থেকে সাড়ে ১৪ ভাগ বৃদ্ধি, বিদ্যুত সমস্যা, চোরাই পথে চা-এর আমদানী, সর্বোপরী ‘ক্রমাগত ব্রোকার্সদের সিন্টিকেটের কারণে দেশের চা-শিল্পটিকে ধংশের দ্বারপ্রান্তে।
‘চা-শিল্পের এমন সংকট জীবনে দেখিনি’
চা শ্রমিক ইউনিয়ন জানায়, এনটিসি‘র মালিকানাধীন চা বাগানের চা শ্রমিকদের মজুরি, রেশন, ন্যায্য পাওনা অপরিশোধিত। ফাঁড়ি বাগান-সহ মোট ১৯টি চা বাগানের স্থায়ী, অস্থায়ী ও পোষ্য শ্রমিক ১৫ সহস্রাধিক। সব মিলিয়ে ৫০ হাজারেরও বেশি লোক ভোগান্তিতে। বিদ্যমান সমস্যা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপপরিচালকের সঙ্গে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি, ইউনিয়ন নেতা ও চা শ্রমিকদের একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সমাধান হয়নি।
শ্রমিকরা জানান, শ্রমিকদের বাড়িঘর, আবাসনের ব্যবস্থা, পানি ও চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে চা-শিল্পে তিন যুগের বেশী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষিজাত রপ্তানীমুখি ও লাভজনক এই শিল্পটি দেশের পাট ও চামড়া শিল্পের মত ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা আছে।’ বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশনের নর্থ সিলেট ভ্যালীর চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ টি এসোসিয়েশন সিলেট ব্রাঞ্চের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নোমান হায়দার চৌধূরী বলেন, ‘চা-শিল্পের এমন সংকট জীবনে দেখিনি। উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি চা ২২৫-২৫০ টাকা। নিলাম বাজারে সেটি ১৬০ টাকা নির্ধারিত। এতে লাভ হবে কেমনে। ২০১৯ সালে একশত মিলিয়ন চা উতপাদন করে দেশে চা-শিল্পের ১৭০ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এই চা-শিল্পকে বাচাতে হলে ‘সর্বাগ্রে নিলামের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণপ্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে’, জানালেন চা-সংস্লিষ্টরা।
সিলেটের লাক্কাতুরা মাজলাইনের চা শ্রমিক স্বরসতী লোহার বলেন, ‘অনেক কষ্টে আছি। একদিন খাই একদিন না খেয়ে ঘুমাই। কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চাদের কয়দিন না খাওয়ায়ে রাখব।’ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালি কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, সরকার পদক্ষেপ নিলে এটার সমাধান করা সম্ভব।
চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধালণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, এই অবস্থায় শ্রমিক ও সরকার ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে।
চা-বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যানের ভাষ্য
এদিকে জলবায়ূর প্রভাব, বাজারে নিম্নমানের চা-সহ নানা সংকট চলছে চা-বাগানগুলেতে। বিশেষ করে চা-এর উতপাদন খরচের চেয়ে নিলাম মূল্য কম থাকায় দেশের চা-শিল্পে অশনি সংকেত চলছে। চলতি বছর দেশের ১৬৭টি চা বাগানে একশত ১০ মিলিয়ন কেজি চায়ের উতপাদন লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেনও। তিনি বলেছেন, ‘এবার উৎপাদন টার্গেটে যেতে পারব না। কোয়ালিটিতে উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলোকে যদি আমরা আমলে নেই, তাহলে হয়তো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। কিন্তু কোয়ালিটি বিবেচনায় সেটা সম্ভব হবে না। তবে অক্টোবর পর্যন্ত বেশির ভাগ চা বাগানে গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি উৎপাদন হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি মৌসুমে এবার আমাদের একটু ‘ডেফিসেন্সি’ যাবে।’
মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন গত ১০ নভেম্বর শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা বোর্ড প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের আয়োজনে কনফারেন্স রুমে অনুষ্টিত ‘টি টেস্টিং এন্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল’ প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। চা-এর মান উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। এনটিসির বাগানে উৎপাদন বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়-এনটিসি আলাদা মিটিং করে সবাই মিলেই চেষ্টা চলছে। তিনি চা-এর কোয়ালিটি ইমপ্রোভের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘কোয়ালিটি চা’র দাম পাওয়া যায়। বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব।’
১২ রকমের কোয়ালিটি চা প্রদর্শন
এদিন শ্রীমঙ্গলের কর্মশালায় ১২ রকমের কোয়ালিটি চা প্রদর্শন করা হয়। এগুলো হলো প্রিমিয়াম ব্লাক টি, অর্থডক্স টি, অলং টি, গ্রীন টি, হোয়াইট টি, ইম্পেরিয়াল জেসমিন টি, মাশালা টি, এলোভেরা এন্ড পাইনঅ্যাপল টি, মর্নিং টি, চিনা লিচি টি, তুলশি টি, চ্যামেলি টি। এতে দেশের ৯০টি চা বাগানের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও চা-রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশেকি মুদ্রা অর্জন সম্ভব
চা-একটি সংবেদনশীল কৃষি পণ্য। এর জন্য সুষম আবহাওয়া জরুরী। অনেকেই মনে করেন, দেশের রপ্তানীযোগ্য ঐতিহ্যবাহী এই কৃষিজাত শিল্পটিকে সঠিক পৃষ্টপোষকতা দিলে আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও চা-রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশেকি মুদ্রা অর্জন সম্ভব। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সৃজন হয় সিলেট বিমান বন্দর সড়কের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সালে। এখানে বাণিজ্যিক চা-চাষ শুরুর পর ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও পঞ্চগড়ে। সিলেটের তিন জেলায় ১৩৫টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২, হবিগঞ্জে ২৪ ও সিলেটে ১৯টি। পাহাড় টিলা বেষ্টিত এ মাঠির চা’র গুণগত মান উন্নত।
সারা দেশে লক্ষাধিক চা শ্রমিক কাজ করছেন। ২০২২ সালের শ্রমিকরা মজুরী বৃদ্ধি সহ বেশ কিছু দাবিতে দীর্ঘ অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সরকার চা-শ্রমিকদের মজুরী দৈনিক ১২০- ১৭০ টাকায় উন্নীত করে। এর সাথে প্রতি বছর মজুরীর ৫ ভাগ বৃদ্ধির জন্য ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু শ্রমিকরা বলেছেন, এতে তাদের পুষায়না।
সংকট উত্তরণে ১০ সুপারিশ
বিগত সকারের সময় চা শিল্পের সংকটময় পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ সম্বলিত আবেদন করেছিলেন বাগান মালিকরা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবরেও সেই সুপরিশগুলো তুলে ধরা হয়। সেগুলোর মধ্যে, চায়ের নিলাম মূল্য নিন্মতম ৩শ টাকা কেজি নির্ধারণ, ব্যাংক ঝাণের সুবিধা ও সুদহার হ্রাস ইত্যাদি।