ইসরায়েল ও হামাস গাজায় শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছেন, “ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে স্বাক্ষর করেছে। এর অর্থ হলো খুব শিগগিরই সব জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং ইসরায়েল নিজেদের সেনাদের নির্ধারিত একটি লাইনে সরিয়ে আনবে।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে “ইসরায়েলের জন্য একটি মহান দিন” বলে অভিহিত করেছেন। এই চুক্তি অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবার তার সরকারের একটি বৈঠক আহ্বান করেছেন।
হামাসও এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা নিশ্চিত করেছে। একইসাথে ট্রাম্প এবং এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তা পুরোপুরিভাবে মেনে চলতে ইসরায়েলকে বাধ্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
শান্তি চুক্তি সই হওয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে গাজাবাসীকে, ইসরায়েলেও অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযানে অন্তত ৬৭ হাজার ১৮৩ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২০ হাজার ১৭৯ জনই শিশু।
মধ্যপ্রাচ্য একত্রিত হয়েছে: ডোনাল্ড ট্রাম্প
গত সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইসরায়েল ও হামাস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, সব পক্ষের সাথে ন্যায্য আচরণ করা হবে এবং এটি একটি শক্তিশালী এবং চিরস্থায়ী শান্তির দিকে অগ্রসরের প্রথম পদক্ষেপ।
ইসরায়েলি সরকার এই চুক্তি অনুমোদন দিলে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। এরপর বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং গাজার বেশ কিছু জায়গা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শান্তির জন্য আলোচনা আরো জোরদার হয়েছে। কেবল হামাসকেই নয় তিনি ইসরায়েলকেও শান্তি চুক্তির জন্য চাপ দিয়েছেন।
দুই বছর পরে গাজা যুদ্ধ অবসানের এমন আশা থাকলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা এখনও বাকি রয়েছে। যেমন- গাজা কে পরিচালনা করবে এবং হামাসের ভবিষ্যৎ কী হবে সে পরিকল্পনা এখনো করা হয়নি।
এদিকে, ফক্স নিউজের শন হ্যানিটিকে ট্রাম্প বলেছেন, “এখন মানুষের যত্ন নেওয়া হবে। এটা একটা ভিন্ন পৃথিবী হতে চলেছে। আমি মনে করি, সত্যিই মধ্যপ্রাচ্য একত্রিত বা সংঘবদ্ধ হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি গাজা অনেক নিরাপদ জায়গা হতে চলেছে এবং এটা এমন একটা জায়গা হতে চলেছে যেখানে পুনর্গঠন হবে। একইসাথে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোও এই পুনর্গঠনে সাহায্য করবে। কারণ তাদের কাছে প্রচুর সম্পদ রয়েছে এবং এটা যে ঘটছে তারা তা দেখতে চায়।”
ট্রাম্প বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে, আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী।” এছাড়া শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের পরে গাজা পুনর্নির্মাণ করার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। ফক্স নিউজে শন হ্যানিটির সাথে ফোনে কথা বলার সময় ট্রাম্প জানিয়েছেন, শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ের পরে যা আসে তা হলো, ” আপনি দেখতে পাবেন মানুষ একসাথে থাকবে এবং গাজা পুনর্নির্মাণ করা হবে।”
শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে আইডিএফ
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এক বিবৃতিতে এই শান্তি চুক্তি সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “পুরো জাতি জিম্মিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে এবং আনন্দিত।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ কাৎজ জিম্মিদের মুক্তিকে একটি ‘আশীর্বাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সেনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, “তারা তাদের সাহস, দৃঢ়তা এবং অসীম ত্যাগের মাধ্যমে এই মহান মুহূর্তে আমাদের নিয়ে এসেছেন।” কাৎজ পোস্টের শেষে বলেছেন, “পুরো জাতি অপেক্ষা করছে এবং উত্তেজিত।”
এদিকে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এক বিবৃতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “জিম্মিদের ফিরে আসার জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত। যেই চুক্তি রাতভর স্বাক্ষরিত হয়েছিল।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক মিডিয়া পোস্টে আইডিএফ জানিয়েছে, “সারা রাতভর অনুষ্ঠিত একটি পরিস্থিতিগত মূল্যায়নের সময়, চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ, সম্মুখ সারি এবং পিছনে থাকা উভয় বাহিনীকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রস্তুত এবং যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।”
“দায়িত্বশীলভাবে সেনাদের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে, রাজনৈতিক নির্দেশ এবং চুক্তির ধাপ অনুযায়ী বাহিনী মোতায়েন করা হবে। একইসাথে, চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার জন্য অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেটি কিনা সংবেদনশীলতা এবং পেশাদারিত্বের সাথে পরিচালিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
এই পোস্টে আরো বলা হয়েছে, “আইডিএফ যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন এবং সকল ফ্রন্টে ইসরায়েল রাষ্ট্রের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য কাজ চালিয়ে যাবে।”
গাজাবাসীর আনন্দ উৎসব উদযাপন
বেশ কিছু ভিডিওতে গাজাবাসীকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি খবরে উদযাপন করতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির চুক্তির সংবাদ উদযাপনের বিভিন্ন ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সাঈদ মোহাম্মদ ইনস্টাগ্রামে রাতের একটি ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করেছেন।
এতে দেখা গেছে, প্রধান শহর দেইর আল বালাহতে আল-আকসা হাসপাতালের বাইরে পুরুষ ও মহিলাদের ব্যাপক সমাগম দেখা গেছে। সঙ্গীতের তালে তালে নেচে নেচে শিস এবং হাততালি দিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। একইসাথে ‘আল্লাহু আকবর’ রব তুলতেও দেখা গেছে। আরেকজন সাংবাদিক মোহাম্মদ আল-হাদ্দাদ-এর আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গাজার অন্য আরেকটি স্থানের রাস্তায় তরুণদের একটি ছোট দলকে নাচতে দেখা যাচ্ছে।
শান্তি চুক্তির জন্য শুভেচ্ছা বিশ্ব নেতাদের
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্তেনিও গুতেরেস সব পক্ষকে এই চুক্তির সব শর্ত মেনে চলতে আহ্বান জানিয়েছেন। গুতেরেস বলেন, “এই দুর্ভোগের অবসান হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার এই শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে দুই পক্ষের একমত হওয়ার খবরে এক বিবৃতিতে, “এটি একটি গভীর স্বস্তিকর মুহূর্ত” বলে উল্লেখ করেছেন। এতে আরও বলেছেন, “গাজার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সংবাদকে আমি স্বাগত জানাই।”
“সারা বিশ্বের জন্য এটি গভীর স্বস্তির মুহূর্ত। বিশেষ করে জিম্মি, তাদের পরিবার এবং গাজার বেসামরিক জনগণের জন্য। যারা গত দুই বছর ধরে অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করছেন,” বলেন স্টারমার।
এদিকে, অস্ট্রেলিয়া প্রথম পর্যায়ের এই গাজা শান্তি পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে, সকল পক্ষকে চুক্তির শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত, জিম্মি এবং বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির পর, চুক্তিটি শান্তির দিকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। আমরা সকল পক্ষকে পরিকল্পনার শর্ত মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।”
তিনি ট্রাম্পের “কূটনৈতিক প্রচেষ্টা” এবং সমঝোতা আলোচনায় মিশর, কাতার এবং তুরস্কের ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান। ভবিষ্যতে গাজায় হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না, শান্তি পরিকল্পনার এমন প্রতিশ্রুতিকেও সমর্থন করেছে অস্ট্রেলিয়া। তিনি বলেন, এটি “গাজায় পুনরুদ্ধার, দীর্ঘমেয়াদী শান্তি নিশ্চিত করা এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি খুব দীর্ঘ পথ হবে।” বিবিসি