আক্ষেপ প্রকাশ করলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতার মেয়ে বিন্দি

ফিচার বিনোদন সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ফয়সাল আমিন কাজি (ফাহিম ফয়সাল): দেশের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’র নির্মাতা আজিজুর রহমান গত ১৪ মার্চ, সোমবার কানাডার একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোকগমন করেছেন। এরপর গত ২১ মার্চ, বৃহস্পতিবার জানাজা শেষে মরহুমকে দাফন করা হয় জন্মস্থান বগুড়ার গ্রামের বাড়ী শান্তাহারে পারিবারিক কবরস্থানে। মুত্যুকালে আজিজুর রহমানের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

কিংবদন্তী এ চলচ্চিত্র নির্মাতার রুহের মাগফেরাত কামনায় ১২ এপ্রিল, মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় বিএফডিসির জহির রায়হান অডিটোরিয়ামে এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি আয়োজিত এ স্মরণ সভায় উপস্থিত থেকে নির্মাতা আজিজুর রহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন- চিত্রনায়ক আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, ওমর সানী, চিত্রনায়িকা সুজাতা, রোজিনা, অঞ্জনা, চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, আব্দুল লতিফ বাচ্চু, কাজী হায়াত, মনতাজুর রহমান আকবর, শাহিন সুমন, নির্মাতা আজিজুর রহমানের মেয়ে বিন্দি রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান।
স্মরণ সভায় লিখিত বক্তব্যে তার মেয়ে বিন্দি রহমান বলেন, আমার বাবা জনাব আজিজুর রহমান একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন, যিনি অনেক পরিশ্রম করে এই পর্যায় পৌঁছেছিলেন। বাবা ছিলেন কাজ পাগল একজন মানুষ। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তাকে দেখেছি কাজের মাঝে ডুবে থাকতে। তিনি কখনো টাকার জন্য কাজ করতেন না। উনি বলতেন “আমি টাকার পেছনে ছুটবোনা, এতো ভালো কাজ করবো যে , টাকা আমার পেছনে ছুটবে”। আসলেই তাই, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবিগুলো তিনি বনিয়েছেন। তার প্রতিটা ছবি ছিল ব্ক্তব্যধর্মী। এভাবেই তিনি এই জগতে হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তী।

চলচ্চিত্র জগতে যারা কাজ করেন, তাদের অনেক শ্রম এবং সময় দিতে হয়। বাবা বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার সারা জীবন চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয় করেছেন। ব্যতিক্রমধর্মী গল্প, নিরলস পরিশ্রম আর নতুন প্রযুক্তির উপর গবেষণা তার ছবিগুলোকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো তাইতো আলোচনায় আছে যুগের পর যুগ।

বিন্দি রহমান আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ব্যাক্তিগত জিবনে আমার বাবার কোন আক্ষেপ ছিলনা। উনি নিজ হাতে উনার পরিপূর্ণতার কথা লিখা রেখে গেছেন। কিন্তু সন্তান হিসেবে আমাদের আক্ষেপ রয়েছে। ৫২টি চলচ্চিত্রর নির্মাতা তিনি। যিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, একজন অংকন শিল্পী, প্রযোজক, কাহিনিকার, পোস্টার মেকার, সেট ডিজাইনার, টাইটেল মেকার, মেকাপ আর্টিস্ট। তিনি একজন ভর্সেটাইল পর্সোনালিটির মানুষ হয়েও একবারও জাতীয় কোন পুরস্কার পেলেন না। পেলেন না একটি আজীবন রাষ্ট্রীয় সম্মানও। এর দায়ভার কি রাষ্ট্র নিতে পারবে?

বিন্দি রহমান বলেন, উনি চলচ্চিত্রকে এতোই ভালোবাসতেন যে জীবনের শেষ দিনগুলোতে চলচ্চিত্রের মানুষদের কল্যাণের জন্য কিছু কথা নিজ হাতে লিখে রেখে গেছেন এবং পরিকল্পনা করেছিলেন একটি ছাত্রবৃত্তির ব্যবস্থা করার। সবার সহযোগিতা পেলে উনার সন্তান হিসাবে আমরা উনার স্বপ্নের এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে চাই।ছুটির ঘণ্টাঃ
১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ নির্মাণ করে খ্যাতি পেয়েছেন আজিজুর রহমান; লম্বা ছুটি ঘোষণার পর একটি স্কুলের টয়লেটে এক ছাত্রের আটকে পড়ে মৃত্যুর সেই চলচ্চিত্রায়ন কাঁদিয়েছিল বহু মানুষকে। ছুটির ঘণ্টা ছাড়াও আজিজুর রহমান নির্মাণ করেছেন সর্বমোট ৫২টি ছবি। রয়েছে ‘অশিক্ষিত’, ‘মাটির ঘর’ এর মতো চলচ্চিত্র।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল ছুটির ঘণ্টাঃ
সত্তরের দশকের শেষভাগে নারায়ণগঞ্জের স্কুল ছুটির আগে শৌচাগারে আটকা পড়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা পরিচালক আজিজুর রহমানের হৃদয়ে দাগ কেটেছিল; সেই ঘটনা অবলম্বনে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ছুটির ঘণ্টা’ মুক্তির পর কাঁদিয়েছিল বহু মানুষকে।

ব্যবসাসফল সিনেমা ‘ছুটির ঘণ্টা’সহ ‘অশিক্ষিত’ ‘জনতা এক্সপ্রেস’র মতো হিট সিনেমা রেখে জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন এ চলচ্চিত্রকার।

২০১৬ সালে তার লেখা ‘চলচ্চিত্রে আমার কথা’ বইয়ে ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ‘ছুটির ঘণ্টা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের গল্প তুলে এনেছিলেন আজিজুর রহমান। সত্তরের দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার শুটিংয়ের ফাঁকে ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা পড়তে গিয়ে একটি খবরে চোখ আটকে যায় আজিজুর রহমানের।

‘একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা’ শিরোনামে দুই কলামের খবরে নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলছাত্র এক মাস ধরে শৌচাগারে আটকে থাকার পর মারা গেছে। সংবাদটি পড়ে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি; কিছুতেই ঘটনাটি ভুলতে পারছিলেন না। সেই ঘটনা বড়পর্দায় তুলে আনার পরিকল্পনা করেন তিনি। তিনি আঁটঘাট বেঁধে নামলেও প্রযোজকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কাউকে রাজি করাতে পারেননি তিনি। ছবিটি চলবে না-বলে মুখের ওপর না করে দিয়েছেন অনেকে। পরে তার ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার প্রযোজক সংগীত পরিচালক সত্য সাহাকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করান।প্রযোজক মেলার পর চিত্রনাট্যে হাত দিলেন আজিজুর; আর সংলাপ লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। দুই কলামের খবরে বিস্তারিত কিছু না থাকায় চিত্রনাট্যে অনেক ঘটনা ও চরিত্র জুড়ে দিতে হয়েছে তাদের।

স্কুলের দপ্তরি চরিত্রে রাজ্জাককে নেওয়া হল; তখনও চিত্রনাট্যে কোনো নায়িকার চরিত্র ছিল না। প্রযোজকের পরামর্শে স্কুলের ঝাড়ুদারের চরিত্র যোগ করা হয়; সেই চরিত্রে নেওয়া হয় শাবানাকে।

ঝাড়ুদারের চরিত্র ধারণ করতে ঢাকার বিভিন্ন সুইপার পল্লীতে ঘুরে ঘুরে তাদের চাল-চলন, কথা বলার ধরণ রপ্ত করতে হয়েছিল শাবানাকে।

যে স্কুলছাত্রকে নিয়ে সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছে সেই স্কুলছাত্র খোকার ভুমিকায় নেওয়া হয় শিশুশিল্পী সুমন সাহাকে; যিনি প্রযোজক সত্য সাহার ছেলে। সংগীত পরিচালন ইমন সাহার ভাই।

‘ছুটির ঘণ্টা’র আগে আজিজুরের ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় কাজ করেছেন সুমন। ১০টির মতো সিনেমার অভিনয়শিল্পী সুমন তিন দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সেখানেই থিতু হয়েছেন।

কাস্টিংয়ের পর শুটিংয়ের স্থান নির্বাচন করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে কাপ্তাই বাঁধ এলাকার একটি রেস্ট হাউসকে বেছে নেন আজিজুর।

আইয়ুব খানের আমলে নির্মিত সেই রেস্ট হাউসকে খোকার বাড়ি হিসেবে দেখানো হয়। পাশেই ছিল স্কুল। কাপ্তাইয়ে কিছু দৃশ্যের শুটিং শেষে এফডিসিতে সেট ফেলে শৌচাগারের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়।

দৃশ্যধারণ শেষে সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়ার পর ঘটে আরেক বিপত্তি। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আশঙ্কা করল, ছাত্র-ছাত্রীরা সিনেমাটি দেখলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। পরে বাধ্য হয়ে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের নিয়ে সেন্সর বোর্ডে দেখানো হলো; ছাত্র-ছাত্রীরা ভয় পায়নি জানালে সিনেমাটিকে মুক্তির অনুমতি দেওয়া হয়।

শুরুতে হল মালিকরা সিনেমাটি পাত্তা দেয়নি। অনেকে নিতেই চাননি; মাত্র ২০টি সিনেমা হলে মুক্তি পায়। পরে দর্শকদের মাঝে সাড়া ফেলায় হু হু করে হলের সংখ্যা বাড়তে থাকে; কোথাও কোথায়ও টানা পাঁচ মাসও চলেছিল সিনেমাটি। সেই সময় প্রায় চার কোটি টাকা ব্যবসা করেছিল ‘ছুটির ঘণ্টা’।

সিনেমার ‘একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাব’, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’সহ বেশ কয়েকটি গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। প্রযোজনা পাশাপাশি সংগীত পরিচালনাও করেছেন সত্য সাহা।

রাজ্জাক-শাবানা ছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা, শওকত আকবর, এটিএম শামসুজ্জামান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *