মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, গণতন্ত্রের আপোষহীন সৈনিক, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, বঙ্গবীর জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী’র ১০৫তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবীরকে নিবেদিত পংক্তিমালা’। প্রায় ২০০টি বাছাই করা কবিতায় সমৃদ্ধ ২৬০ পৃষ্ঠার এই অনবদ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি সম্পাদনা করেছেন সিলেট বিভাগের স্বনামধন্য সাংবাদিক, প্রথিতযশা সম্পাদক, ঐতিহ্য সন্ধানী লেখক ও গবেষক দৈনিক সিলেটের ডাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে এই মূল্যবান লেখাগুলো সংগ্রহ এবং বাছাই করা সহজ কাজ নয়। বঙ্গবীর ওসমানী সশস্ত্র সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অব্যাহতভাবে তুলে ধরার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী ও সফল সংগঠক ফয়জুর ভাই যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তা তুলনারহিত।
২০১৮-২০১৯ সালে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদের উদ্যোগে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য সচীব ও প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান এসব সৃজনকর্মে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তখন ওসমানীর জীবন ও কর্মের আলোকে সুদৃশ্য ও তথ্যবহুল স্মারকগ্রন্থ ‘অনুভবে বঙ্গবীর ওসমানী’ সম্পাদনা করে তিনি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবীর ওসমানীর ইন্তেকালের পর পরই মুহাম্মদ ফয়জুর রহমানের ঐকান্তিক উদ্যোগে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ওসমানী স্মরণে দেশের প্রথম স্মারক ‘নাম তাঁর ইতিহাস’। এতে অসাধারণ একটি কবিতা লিখে ছিলেন গণমানুষের কবি দিলওয়ার। ‘বঙ্গবীরকে নিবেদিত পংক্তিমালা’র প্রথম কবিতা হিসেবে সেটি সংকলিত হয়েছে।
আজ বঙ্গবীর ওসমানী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ইউকের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী কেএম আবুতাহের চৌধুরীর কাছ থেকে ‘বঙ্গবীরকে নিবেদিত পংক্তিমালা’ লেখক কপি গ্রহন করলাম। সাথে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা। বঙ্গবীর ওসমানীর কর্মময় জীবন নিয়ে দারুণ সব পংক্তিমালা রচনা করেছেনে দেশ-বিদেশের প্রাজ্ঞজনেরা। নতুন প্রজন্মের অনেক মেধাবী লেখকের কবিতাও স্থান পেয়েছে এই অমর সংকলনে।
বঙ্গবীর ওসমানী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ইউকের সহযোগিতায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবীরকে নিবেদিত পংক্তিমালা’ প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন সিলেটের পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী লেখক ও সংগঠক বায়োজীদ মাহমুদ ফয়সল। সম্পাদক ও প্রকাশক নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করেছেন। বরেণ্যদের লেখা সংগ্রহে আমিও সাধ্যমত সহায়তা করেছি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সমর সৈনিক গল্পকার ও ঔপন্যাসিক দৈনিক ইত্তেফাকের দীর্ঘকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদীকে লেখার কথা বলতেই মুগ্ধ চিত্তে লিখতে বসলেন। তাৎক্ষণিক লিখে ফেললেন অমর কবিতা ‘জেনারেল আতাউল গনী ওসমানী সমর সেনানায়কেষূ’। শেষ পঙক্তিটা হল- ‘এশিয়ার স্বর্গ পুণ্যস্নাত সুপ্রাচীন নগরী- সিলেট সন্তান/ তুমি বাঙলার ভাষা, জানো বাঙালির ভাষা/ কী মহিয়ান! কী মহিয়ান:- প্রিয় জেনারেল! প্রিয় ওসমানী- আয়ুষ্মান! চিরায়ুষ্মান / তুমি স্বাধীনতা প্রাণ! তুমি স্বাধীনতা প্রাণ।’
মুক্তিযুদ্ধের আরেক সমর সৈনিক আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী দীর্ঘ কবিতায় তুলে এনেছেন ওসমানীর অনেক স্মৃতি। তাঁর ভাষায় ‘আপনার হেলিকপ্টারটি একাত্তরে বিধ্বস্ত হয়নি/ নিক্ষিপ্ত গুলি আপনার শরীরেও লাগেনি/ গুলি লেগেছিল আপনার সাধের গণতন্ত্রের ওপর/ আপনি তাতে সরে দাড়ালেন/ গণতন্ত্র একটু একটু করে সরলো/ মুক্তিযোদ্ধারা ঝুর-ঝুর করে ঝরলো।’
জেনারেল ওসমানী স্মরণে মননশীল লেখক ও গবেষক, অধ্যাপক ফরীদ আহমদ রেজার কবিতার নাম ‘ভূমিপুত্র’।
‘মাটি ও জলের নৃত্যে নত হয় ফেরারি বাতাস/ বর্ষণের তোড়ে নাচে সৃষ্টিকুল আকাশ-পৃথিবী/ জেগে উঠে সময়ের নমশূদ্র আসহাবে কাহাফ/ কিষান-কৈবর্ত ভাঙে সুষুপ্তির কঠিন জোয়াল।/ ভয় নেই চেয়ে দেখো জোহরার রূপালী কিরণ/ তৃণ-লতা বৃক্ষরাজি কৃষকের মাঠের ফসল/ পাতার মর্মর ধ্বনি পাখিদের ডানার জাপট/ উল্লাসে জপনা করে অনাগত বিজয় সঙ্গীত।/ মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে লক্ষ্যস্থির শিকারি শৃগাল/ মানব-মুখোশ পরে ঘুরে ফিরে অনার্য-নগর/ কন্ঠে তার ভালবাসা প্রেম-খেলা আনত-কুর্ণিশ/ প্রলুব্ধ হৃদয় জুড়ে সোনা-দানা সম্পদের লোভ।/ প্রতিরোধে যুথবদ্ধ ভূমিপুত্র কন্যা ও জননী/ মানবিক বোধ-ভরা এ মাটির স্বপ্ন ও সঙ্গীত।’
কবি ও প্রাবন্ধিক আব্দুল মুকীদ চৌধুরী লিখেছেন ‘স্মরণের মহামেলায়’- ‘কিংবদন্তি নেতৃত্বের আজ এ স্মরণবেলা/ কাব্য-কথায় নজরানা এ-কবির মহামেলা।/ মুক্তিযুদ্ধের হে প্রাণপুরুষ! হে সূর্যসন্তান!/ অগণিত কন্ঠে বাজুক তোমার নামের জয়গান।/ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির অবদান/ দেশে দেশে নন্দিত হোক, থাকুক অম্লান।’
কবি ও গবেষক মুকুল চৌধুরী ‘জেনারেল’ শীর্ষক দুই পৃষ্ঠাব্যাপী অসাধারণ কবিতায় বঙ্গবীরকে স্মরণ করেছেন-‘যখন শেষবার দেখা হলো, সেই লামাবাজারেই।/ চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাবেন।/ সেই আপনার শেষ যাওয়া। গাজী সাহেবের পিছন পিছন / শহীদ আলী সাহেবের ঘরে ঢুকতেই শুনি আপনার কন্ঠে আমার সেই প্রশ্নের জবাব:/ ভাইসাব, বিজয়ের উদ্যানে আমি ছিলাম কি ছিলাম না/ সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়/ আমরাতো স্বাধীন হয়েছি।/ আমরা কারো গলার কাঁটা হয়ে, কন্ঠের ফাঁস হয়ে ঝুলে তো থাকিনি।’
দৈনিক নয়াদিগন্তের সাহিত্য সম্পাদক কবি ও কথাশিল্পী জাকির আবু জাফর ‘ওসমানী, জেনারেল ওসমানী’ শিরোনামে লিখলেন, ‘তুমি শাহজালালের সৌরভাম্বিত সিলেটের সন্তান/ একাত্তরের অগ্নিঝরা রণাঙ্গনের নাবিক/ একটি নতুন ভোরের উদ্বোধক/ এনেছো একটি নতুন সূর্যের উত্থান/ সেই সূর্য আমাদের সবুজে জাগ্রত বলেই/ পত পত আমাদের স্বাধীনতার নিশান।’
‘কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা’ আল মাহমুদ গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর স্মৃতির উদ্দেশে লিখেছেন ‘রক্তমাখা নিশানের স্বাধীনতা’। ‘যখন জনতা রক্ত আর বারুদের উত্তাপে রাজপথে জনপদে উত্তাল/ সন্ত্রস্ত মানুষ ট্যাঙ্ক গুলি আর আগুনের মুখে দিকবিদিক পালাচ্ছে/ বাঁচার আকুতি ও আর্তনাদে বাতাস আউল হয়ে যাচ্ছে/ ঠিক তখনই আপনার সাহস জ্বলে উঠলো আকাশছোঁয়া শিখার আলোয়/ ঝাঁকবাঁধা বাজপাখির বিরুদ্ধে আপনি এক লড়কু ফিঙে/ প্রতিরোধ ব্যূহ আর বারুদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে/ বাংলার সবুজ প্রান্তরে, মেঠোপথে, রাজপথে, জনপদে, অরণ্যে, অন্তরে/ শহীদের রক্ত গাজীর ত্যাগে অবশেষে জনসমুদ্রে উড়েছে/ জয়ের নিশান- যেখানে রক্তাভ সূর্যের রঙে আঁকা/ আছে আমাদের জীবন-আখ্যান। আপনার সুতীব্র হুঙ্কারে পরাজিত সব/ উদ্ধত নিঠুর হন্তারক। শহীদের রক্তধারা নদীর সব স্রোতে/ বহমান হতে হতে আপনার স্মৃতি ভুলে হয়েগেছি কৃতঘ্ন জীব/ আপনার মুক্তির পতাকা খামচে ধরেছে যখন হিংস্র দানবেরা/ আমরাও তখন আপনার সেই রক্তমাখা নিশানের স্বাধীনতা রক্ষায়/ রাত্রিদিন মিছিলে মুখর- সারা বাংলায়।’
প্রিন্সিপাল কবি কালাম আজাদের কবিতার শেষ লাইনগুলি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘এই বাংলার আঠারো কোটি এবং অনাগত সকলের তিনি এক পিতৃপুরুষ। ওসমানী ধ্রুব এক নাম। তাঁকে সালাম এবং সালাম।’
নন্দিত কবি ও শিক্ষাবিদ, কর্নেল অব. সৈয়দ আলী আহমদের কবিতার সমিকরণ ‘তোমার সমান তুমি… আমাদের সময়ের সম্মানের, মর্যাদার যে নাম/ হে বঙ্গবীর, তোমাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।’
‘তোমাকে সালাম’ বলে কবি নুরুজ্জামান মনি বঙ্গবীরকে শনাক্ত করলেন অনন্য মহীমায়। বললেন, ‘স্বাধীনতা ছিল তার আজন্ম সাধ/ এই বুঝি হায় তার কৃত অপরাধ।/ শকুনেরা তক্ষুণি নিল তার পিছুু/ তাতে তার উঁচু মাথা হয়নি তো নিচু।/ …সকলেই যদি আজ ভুলে যায় তাকে/ তার নাম তবু রবে সুরমার বাঁকে।/ যতদিন বেঁচে রবে মেঘনার ঢেউ/ ওসমানী নাম খানি ভুলবেনা কেউ।/ বাংলার বুক জুড়ে আছে তার নাম/ বঙ্গের শার্দুল তোমাকে সালাম।’
কবি ও গবেষক সোলায়মান আহসান বঙ্গবীর ওসমানীর আবেগঘন ছবি আঁকলেন এভাবে- ‘তুমি ছিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক/ দিয়েছো নেতৃত্ব যুদ্ধে একাত্তরের স্বাধীনতার/ তোমার নিপুণ রণ-কুশলতা সেদিন অপার/ বাঙালি লড়েছে নিয়ে বুকে বল (দারুণ শায়েক)/ একে একে কেটে গেছে ক্লান্তিহীন দীর্ঘ নয় মাস/ মুক্তিযোদ্ধা পাড়ি দেয় রাত্রি পথে যায় কেটে/ রাইফেল কাধেঁ নিয়ে প্রান্তর পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে/ গেরিলা বাহিনী খোঁজে আতিপাতি শত্রুর আবাস।’
কবি ও কথাশিল্পী তমিজ উদ্ দীন লোদী লিখেছেন ‘আপনি সূর্য হয়ে উঠবেন অচিরেই’। বর্ণনা করেন ‘আপনাকে মনে হলেই মনে পড়ে কর্নেল আউরিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা/ বীর ও অসহায়ের প্রতিচ্ছবি তিনি। একদার বীর সর্বাধিনায়ক বয়েন্দিয়া।/ বুয়েন্দিয়ার দিন কাটতো প্রতীক্ষায় আর আপনার উপেক্ষায়।/ অথচ আপনার রণকৌশলে কথিত শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী হীনবল/ নতজানু ও পরাস্ত হয়েছিল সেদিন।’
কবি-সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন সালেহ ‘গণতন্ত্রের সেনানী’ কবিতায় লিখেছেন- ‘লড়াইয়ের মাঝে মুক্তির গানে/ সকলের মনে, মাঠে-ময়দান/ শুনি আজ যাঁর কন্ঠের বানী/ তিনি জেনারেল এমএজি ওসমানী।’
কবি ও সংগঠক ময়নুর রহমান বাবুলের কবিতার নাম ‘বারুদের বাউল’। তাঁর ভাষায় ‘শাহজালালের জয় করা পুণ্যভূমি সিলেট/ গৌড়গবিন্দের ধসে পড়া প্রাসাদ/ পলিমাখা এই পুণ্যভূমিতে জন্ম তোমার/ বারুদের মতো জ্বলে ওঠা এক হুংকার।’
কবি ও কলামিস্ট ফকির ইলিয়াসের শিরোনাম ‘স্বভূমির সূর্যরেখা দেখে’। অসাধারণ শব্দবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের পতাকার রক্তলালে মেশা এই সবুজ/ হাতের স্পর্শে তাঁর- পেয়েছিল বিজয়ের দিন/ সেনাপতি তিনিই তো- স্মৃতি যার আজো অমলিন/ এখনও বাংলার মাটি প্রতি ভোরে করে তাঁর খোঁজ।/ যে বাংলায় এ প্রজন্ম, কথা বলে উচ্চ করে শির/ তাদের মননে তিনি আজও প্রিয়- প্রিয় বঙ্গবীর।’
আর আমি (সাঈদ চৌধুরী) লিখলাম ‘সর্বাধিনায়ক’। ‘ঘন কুয়াশায় তুমি ছুটে গেলে/ বিবর্ণ ধূসর অস্পস্ট প্রান্তরে।/ জাতির শৃঙ্খলাবদ্ধ হাত, হানাদারের/ আঘাতের ক্ষতগুলো তোমাকে কাঁদায়।/ বৃষ্টি সুরের মূর্ছনায় ধীরে অতি ধীরে/ এগিয়ে গেলে সূর্যহীন জল জঙ্গলে।/ বারুদের গন্ধ আর মুক্তিসেনার রক্তে/ তুমি যেন স্ফুলিঙ্গ অগ্নিশিখা।/ তোমার রণকৌশলে শত্রুর/ ট্যাঙ্ক-কামান-রকেট দিকবিদিক।/ শত্রুর অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে গ্রামের কৃষক/ বিজয়ের গান গেয়েছে প্রদীপ্ত যুবক।/ শৌর্য আর অমিত সাহসী হে সর্বাধিনায়ক/ তুমি আমাদের অহংকার।/ আমার মায়ের অশ্রুজল, পিতার আশীর্বাদে/ দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এলে মৃদু-মন্দ বাতাসে।/ আমরা পেলাম স্বাধীনতা, নতুন পতাকা/ উদিত হল ভোরের আলো, নতুন সূর্যোদয়।’
এভাবে কী অনন্য রক্তিম আভায় কবিরা পংক্তিতে পংক্তিতে সাজিয়েছেন গণতন্ত্রের আপোষহীন সৈনিক, বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানী’র জীবনালেখ্য। জন্মশতবর্ষের ধারাবাহিক আলোচনা ও প্রকাশনার পঞ্চম বর্ষে ছড়া ও কবিতায় নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের আদর্শ এবং চেতনা। এই সময়ে বঙ্গবীরের প্রতি সশ্রদ্ধচিত্তে আবারো জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আমরা জানি, ওসমানী ছিলেন নিখাদ দেশপ্রেমিক ও আজীবন গণতন্ত্রী। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বিলিয়ে দিয়েছেন দেশ ও জাতির জন্য। পাকিস্তান ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের রণসংগীত হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটি তাঁর মাধ্যমে সরকারি অনুমোদন আদায় ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা ছিলা স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সূতিকাগার।
বঙ্গবীর ওসমানী স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমরনায়ক ছিলেন। শুধুমাত্র ভৌগোলিক ও মানচিত্রগত পরিবর্তন তাঁর কাম্য ছিলনা। রাষ্ট্রীয় পরিচয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, স্বার্বভৌমত্ব সবই তিনি চেয়েছেন। উপনিবেশবাদী দেশ ও শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং সাম্রাজ্যের ভাগবাটোয়ারার ফসল হিসেবে অতীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে। এমন স্বধীনতা তিনি চাননি। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শোষণ-আধিপত্য থেকে মুক্ত স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন। জাতিগত ও শ্রেণিগত শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন।
জেনারেল ওসমানীর মতে আমাদের স্বাধীনতা একসাথে হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম কয়েকটি স্তরে অর্জিত হয়েছে। ভাষা শহীদদের রক্ত এ দেশের উর্বর মাটিতে বপন করেছিল স্বাধীনতার বীজ। যার একপ্রান্তে ভাষা আন্দোলন আর অন্যপ্রান্তে মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিনষ্ট এবং জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর পথে অগ্রসর হলে তা প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
এমএজি ওসমানী’র নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয় সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা-সহ সকল কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন। তাঁর সুশৃঙ্খল নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে শত্রুসেনাদের পযুর্দস্ত করে বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত হয়।
ওসমানী মনে করেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে আরেকটি অনুরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ প্রয়াস ছিল না। নাগরিকদের জন্য ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সা-সহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা’, ‘মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ ইত্যাদি ছিল স্বাধীনতার মূল মন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ Equality, Human Dignity and Social justice এই তিনটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় দর্শন।
স্বাধীনতার মূল মন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষে ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী ‘জাতীয় জনতা পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর), বাংলাদেশ পিপলস লীগ, গণ আজাদী লীগ এই ৫ দলের গণ ঐক্য জোটের প্রার্থী ছিলেন তিনি। এই নির্বাচনে মোট ১০জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। নির্বাচনে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে জয়লাভ করেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
এই দুই নির্বাচনে পরাজয়ের কারণে ওসমানীর মনে কোন অনুসুচনা ছিল না। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জগনের কাছে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরতে পেলে তিনি সুখি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকর্মী হওয়া সত্তেও ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে তিনি সংসদ সদস্যপদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যপদ ত্যাগ করেন।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর বক্তব্য শুনেছি। আমাদের অতি প্রিয় সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম খান সহ যারা সাথে ছিলেন, তাঁরা এখনো সময়ের সাক্ষী হয়ে আছেন।
এমএজি ওসমানী ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদা প্রদান করা হয়। নতুন দেশের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি তাঁর এ দায়িত্ব থেকে অবসর নেন এবং অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভায় যোগ দেন।
১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ঐ নির্বাচনে এমএজি ওসমানী তাঁর নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন৷ এই নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন৷ তখন তিনি ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ধোপাদীঘির পাড়ে ওসমানীর পৈতৃক বাড়িটি পাকিস্তানী হানাদারেরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ উদ্যোগে সেখানে বাংলো টাইপ ঘর নির্মাণ করেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ মে এ বাড়ির ২ বিঘা জায়গা দিয়ে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের নামে গঠন করেন জুবেদা খাতুন-খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতি বছর মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রিদের একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বৃত্তি প্রদান করা হয়।
১৯৮৭ সালের ৪ মার্চ ওসমানী জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেই থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এটি। এছাড়া ঢাকার ধানমন্ডির (রোড-১০-এ, বাড়ি নং ৪২) সুন্দরবন নামক ওসমানীর নিজস্ব বাড়ির সম্পত্তি দিয়ে আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে ওসমানী ট্রাস্ট।
বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ওসমানী উদ্যান ও স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মেমোরিয়াল হল। সরকারী উদ্যোগে সিলেট শহরে তাঁর নামে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ওসমানী নগর থানার দয়ামীরে ওসমানী স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার।
বালাগঞ্জ উপজেলাকে ভেঙ্গে ওসমানী নগর থানা করা হয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। সিলেটে বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান, বঙ্গবীর রোডসহ অসংখ্য স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। তবে জাতীয় জীবনে জেনারেল ওসমানীকে আরও মূল্যায়ন করা উচিত। সেই সাথে ওসমানীর জীবনী পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তিও সময়ের দাবি।
যাদের লেখায়, শ্রমে ও সহায়তায় ‘বঙ্গবীরকে নিবেদিত পংক্তিমালা’ প্রকাশিত হয়েছে তাদের প্রতি অফুরান শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। সবগুলো লেখা পড়ে আগামীতে আরো যথার্থ মূল্যায়নের প্রত্যাশা করছি। অনবদ্য এই সৃষ্টি অমর হয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ এই মহৎপ্রাণ মানুষ গণতন্ত্রের আপোষহীন সৈনিক ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক প্রিয় ওসমানীকে জান্নাতে উচ্চ আসন দান করুন। আমীন।
* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক