ড. ইউনূসকে মামলায় ফাঁসাতে জালিয়াতির অভিযোগ, আদালতে তোলপাড়!

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার বাদীকে জেরা করার সময় আদালতে তোলপাড় কান্ড ঘটেছে গতকাল। দুই পক্ষের কৌসুলিদের মধ্যে দফায় দফায় বাকবিতণ্ডা হয়েছে। বিতণ্ডা থামাতে বিচারককে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

ড. ইউনূসকে মিথ্যাভাবে ফাঁসানোর জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের নিজস্ব চেক লিস্ট জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিদর্শক, মামলার বাদিসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন ড. ইউনূসের আইনজীবী।

আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা দীর্ঘ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জেরার প্রশ্ন এবং তার প্রেক্ষিতে বাদীর দেওয়া জবাব লিপিবদ্ধ করেন। জেরার একপর্যায়ে ড. ইউনূসের কৌসুলি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকসহ চার পরিদর্শকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আদালতের কাছে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করেন।

তিনি আদালতে বলেন, গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনের পর পরিদর্শক একটি পরিদর্শন চেকলিস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে সিল সম্বলিত কারও স্বাক্ষর ছিলো না। কিন্তু আদালতে যে পরিদর্শন চেকলিস্ট প্রদর্শনী হিসাবে দাখিল করা হয়েছে সেখানে চার জনের সিল সম্বলিত স্বাক্ষর রয়েছে।

এছাড়া ওই পরিদর্শন চেকলিস্টের সর্বশেষ ঘরগুলোও টিক চিহ্ন দিয়ে পূরণ করে দেওয়া হয়েছে। এতেই বোঝা যায় ড. ইউনূসকে অপরাধী হিসাবে প্রমাণ করতে এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

ব্যারিস্টার মামুন আদালতে বলেন, একজন নোবেলজয়ীকে মিথ্যাভাবে ফাঁসানোর জন্য জালিয়াতি করার অপরাধে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের মহাপরিদর্শকসহ যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করুন। তখন আদালত এ বিষয়ে লিখিত আবেদন করার কথা বলেন। এ সময় ড. ইউনূসের আইনজীবী লিখিত আবেদন করার জন্য সময় চান। পরে আদালত আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর এ মামলার পরবর্তী জেরার দিন ধার্য করেন।

এর আগে আইনজীবী ব্যারিস্টার মামুন মামলার বাদিকে প্রশ্ন করেন আপনি জালিয়াতি করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন? জবাবে মামলার বাদি বলেন, সঠিক নয়। তখন ড. ইউনূসের আইনজীবী বাদির কাছে জানতে চান, আপনি যখন কোথাও পরিদর্শনে যান, তখন মালিক পক্ষকে জব্দ তালিকা বা চেক লিস্ট দেন। জবাবে পরিদর্শক বলেন চাইলে এক কপি দেই। তখন ইউনূসের আইনজীবী বলেন, এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মালিক পক্ষকে কি কোনো জব্দ তালিকা বা চেক লিস্ট দিয়েছেন। জবাবে বলেন, হ্যাঁ দিয়েছি।

তখন ইউনূসের আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, মালিক পক্ষকে দেয়া চেক লিস্ট আর কোর্টে দেয়া চেক লিস্টের মিল নেই। এ সময় তিনি আদালতের কাছে এই মামলার বর্তমান বাদিসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়না জারির আরজি জানান। জবাবে আদালত লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন।

আইনজীবী ব্যারিস্টার মামুন আদালতের কাছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের মহাপরিদর্শক, মামলার বাদিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার জন্য আদালতের কাছে সুয়োমোটো আদেশ দেয়ার আবেদন করেন।

এসময় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, সুয়োমোটো আদেশ দেয়া যায় না। এরপর ব্যারিস্টার মামুন বলেন, আমরা আবেদন করব। এরপর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের অপর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সাক্ষীর জেরা শেষ করেন।

জবাবে ব্যারিস্টার মামুন বলেন, আরো তিন দিন লাগবে। তিনি আরো বলেন, সব ধরা পড়ে যাচ্ছে। সারা পৃথিবী জেনে গেছে। এসময় দুই পক্ষের আইনজীবীরা তর্কে জড়ান।

দুই পক্ষের আইনজীবীর চিৎকারের কারণে আদালত বলেন, আদালতের পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। এসময় হায়দার আলী বলেন রায়ের পর জালিয়াতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আবেদন দেবেন। তখন ব্যারিস্টার মামুন বলেন, জালিয়াতি করে রায় নিয়ে যাবে কেন? তিনি আদালতে অভিযোগ করেন, কোর্ট যদি একতরফা শোনেন সেটা ঠিক হবে না। জবাবে হায়দার আলী বলেন, এটা ঠিক না।

এসময় ব্যারিস্টার মামুন বলেন, এর আগে আমি এক মাস সময় চেয়েছি। আর আপনারা চার দিন দেয়ার কথা বলেছেন। সেই চার দিনই দেয়া হয়েছে। এসময় দুই পক্ষের আইনজীবীদের চিৎকারের একপর্যায়ে বেলা আড়াইটার দিকে বিচারক এজলাস ছেড়ে চলে যান। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আবার আদালত বসে। এ সময় ড. ইউনূসের পক্ষে সময় আবেদন করা হলে আদালত তা গ্রহণ করে পরে আদেশ দেয়া হবে বলে জানিয়ে দেন। পরে আদালত আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর সাক্ষীকে জেরার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

এ বিষয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ড. ইউনূসকে দোষী সাব্যস্ত করতে খালি জায়গায় টিক মার্ক দিয়ে জালিয়াতি করার জন্য আমরা তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করেছি।

সাংবাদিকদের এজলাস থেকে বের করে দেন আদালত

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের শুরুতে সাংবাদিকদের এজলাস থেকে বের হয়ে যেতে বলেন বিচারক। আদালত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা বাইরে যান। আইনজীবীদের কাছ থেকে ব্রিফ নেবেন।

এ সময় ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন আদালতে সাংবাদিকদের থাকতে না দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি আদালতের কাছে জানতে চান এটা কি ক্যামেরা ট্রায়াল, যে সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলো? তিনি বলেন, হাইকোর্টে এবং আপিল বিভাগেও সাংবাদিকরা থাকেন। তাদের সরে যেতে বলা হয় না। তাহলে এখানে কেন? এখানে যদি ক্যামেরা ট্রায়াল হয় সেটা ভিন্ন কথা। তবে নরমাল বিচার হলে সেখানে সাংবাদিকরা থাকবেন। অন্য সবাই থাকবেন। পরে বিচারক বলেন, সবাইকে নিয়ে বিচার শেষ করতে পারব না আমরা।

গতকাল ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে বাদি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক তরিকুল ইসলামকে জেরা করার সময় এ ঘটনা ঘটে। পরে আদালত সাংবাদিকদের এজলাসের পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করার অনুমতি করে দেন।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কোর্ট বলেছেন যারা সাংবাদিক তারা বের হয়ে যাক। তখন আমি বলেছি এটা কি ক্যামেরা ট্রায়াল। কারণ আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উন্মুক্ত ট্রায়ালে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবেন। যদি এটা ক্যামেরা ট্রায়াল হয়, তা হলে এক রকম হবে। আর যদি ক্যামেরা ট্রায়াল না হয় তা হলে সেখানে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করবে। তাদের এখানে বাধা দেয়া ঠিক না।

এর আগে ১২টা ২৬ মিনিটে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আদালতে ড. ইউনূসের পক্ষে আছেন ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। সাথে ব্যারিস্টার খাজা তানভীর আহমেদ। অপর দিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। গত ৩১ আগস্ট এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য গতকাল দিন নির্ধারণ করেন আদালত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *