চুরি নয়, পরিকল্পিতভাবে কর্মকর্তারাই স্বর্ণ সরিয়েছেন

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টম হাউজের গুদামের লকার থেকে ৫৫ কেজির বেশি স্বর্ণ চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, এক রাতে চুরি হয়েছে। আসলে পর্যায়ক্রমে কয়েক মাস ধরে সরানো হয়েছে স্বর্ণ। পরিকল্পিতভাবে স্বর্ণ রাখার গুদামে বসানো হয়নি সিসিটিভি। গুদামের গেটে সিসি ক্যামেরা চার মাস আগে নষ্ট হলেও নতুন করে লাগানো বা মেরামত করা হয়নি। তদন্তে নেমে প্রাথমিকভাবে এমনসব তথ্য পেয়েছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

স্বর্ণ চুরির মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কাস্টম হাউজের নিজস্ব গুদামে সাধারণ কোনো ব্যক্তির প্রবেশ করার সুযোগ নেই। চাঞ্চল্যকর এ চুরির ঘটনার পর প্রকৃত অপরাধীদের আড়ালের চেষ্টা করা হয়েছে। ধামাচাপা দিতে না পেরে নতুন করে ‘ইনভেন্ট্রি’ শুরু করে হাউজ কর্তৃপক্ষ। তখনই বেরিয়ে আসে লকারে থাকা ৫৫ কেজি স্বর্ণ গায়েবের তথ্য।

আসলে দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ সরানোর পর অডিটে যাতে ফেঁসে না যান সেজন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সাজানো হয়েছে চুরির নাটক। আসলে চুরি নয়, পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে মামলা। গোডাউনের নিরাপত্তার দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন এ বি সি ও ডি শিফটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুম রানা, সাইদুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকরাম শেখ। তাদের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার নামে চার সিপাহিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এক জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে জড়িত দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার নামও। গতকাল মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এক সিপাহিসহ দুই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখানো হবে।

এক জন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গায়েব হওয়া স্বর্ণ ২০২০ থেকে ২০২৩ সালে আসা। অথচ মামলার এজাহার এবং ডিএম অনুযায়ী গায়েব হওয়া স্বর্ণগুলো গুদামে এসেছিল চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে। হেফাজতে থাকা সিপাহিসহ আট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে এটা স্পষ্ট যে, বিমানবন্দরে কাস্টমসের গুদামে সুরক্ষিত লকার থেকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ লুটে জড়িত কাস্টমসেরই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্র। স্বর্ণ চুরির এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত শনিবার। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় ৩ সেপ্টেম্বর। বিমানবন্দরের কাস্টম হাউজের নিজস্ব গুদামে দিনভর ইনভেন্টরি শেষে ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরি বা বেহাত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের। শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টা থেকে পরদিন রবিবার সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে কে বা কারা গুদামের আলমারি লকার ভেঙে স্বর্ণগুলো নিয়ে যান বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও এলিট ফোর্স রেবের গোয়েন্দা শাখা।

স্বর্ণ চুরির ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা আট জনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। ইতিমধ্যে চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এক জনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। বাকি চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার মধ্যে দুই জনের কাছ থেকে চুরিসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় যোগাযোগ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।

তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে চুরি নয়, পরিকল্পিতভাবে সরানো হয়েছে স্বর্ণ। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কাস্টমস কর্মকর্তাদেরই সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। স্বর্ণ এক দিনে সরানো হয়নি। যে সব স্বর্ণ সরানো হয়েছে তা কিন্তু এ বছরেরই জব্দ করা।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, বিমানবন্দর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই)। বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। অথচ কাস্টমসের গুদামে সিসিটিভি না থাকাটা বড় প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। স্বর্ণ চুরির আলামত নেই বললেই চলে। একটি বিষয় পরিষ্কার, কাস্টম হাউজের নিজস্ব গুদামে যার-তার প্রবেশের সুযোগ নেই। সুতরাং বাইরের কেউ এসে গুদাম থেকে স্বর্ণ নিয়ে যেতে পারবে না। আর বাইরের কেউ চুরি করতে এলে তো সবই নিয়ে যাওয়ার কথা। একটি-দুটি করে তো নেওয়ার কথা নয়। কাস্টমসের তথ্যমতে, ডিএম থেকে ‘আংশিক স্বর্ণ চুরি’ হয়েছে। প্রশ্নটা তাই এখানেই, চোর বাইরের নাকি ভেতরের কেউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *