সাঈদ চৌধুরী
উত্তর সিলেটের বাগজুর মাদ্রাসার জনপ্রিয় মুহতামিম, জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার, ভার্থখলা ও খাগাইল মাদরাসার সাবেক স্বনামধন্য শিক্ষক আমার অত্যন্ত প্রিয় খালাত ভাই লেখক ও সমাজচিন্তক মুফতি মুফিজুর রহমান আজ বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১২টায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের কালারুকা নিবাসী মুফতি মুফিজুর রহমান পার্শবর্তী হাঠখোলা ইউনিয়নের পাগইল গ্রামে একটি ওয়াজ মাহফিলে ছিলেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থানীয় শিবের বাজারে নেয়া হয়। কিন্তু অবস্থার দ্রুত অবনতি হলে সেখান থেকে সিলেট শহরের পার্কভিউ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালেই তিনি শেষ নি:শাস ত্যাগ করেন।
মুফতি মফিজুর রহমান উত্তর সিলেটে ইসলামের অগ্রযাত্রায় এক নতুন ইতিহাস তৈরী করেছেন। গ্রামীণ জনপদে আমাদের সংস্কৃতি, তাহযীব এবং মূল্যবোধের নতুন ভাষা উপহার দিয়েছেন। অকুতোভয় তেজদীপ্ত এই আলেম দ্বীনি তালিম ও তরবিয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম করেছেন। দ্বীন-ধর্মের উপর বিভিন্ন রকমের আক্রমণ মোকাবেলায় সিপাহসালার হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সীমান্তবর্তী জনপদ কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় ইলমের যে চেরাগ প্রজ্বালন করেছিলেন, সেই চেরাগ থেকে সমগ্র এলাকা আলোকিত হয়ে ওঠেছে।
মুফতি মফিজুর রহমান তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির ময়দানে রেখেছেন অনন্য অবদান। ইসলামী শিক্ষা বিপ্লবের মিশন নিয়ে কাজ করতেন। অনেকগুলো মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সেখান থেকে ইলমে দ্বীনের আলো ছড়াচ্ছে। সর্বশেষ বাগজুর মাদ্রাসার জন্য তার অদম্য সাধনা, ক্লান্তহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কোরবানির খবর যারা জানেন, তারা বুঝবেন কত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। অল্পদিনেই এই মাদ্রাসাকে তিনি উন্নতি ও প্রসিদ্ধির শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কুরআন-হাদীসের এই বাগানের অগ্রগতি সাধনে সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছেন।
আমি দেশে গেলেই বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সাবেক আমীর ও জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেবকে দেখতে যেতাম। তিনি আমার বড় ভাইয়ের ক্লাসমেট এবং তাঁর বাবা ছিলেন আমার আব্বার বন্ধু। তিনি বহুবার আমাদের বাড়িতে গিয়েছেন। আমাকে ভীষন ভালোবাসতেন।
সংগ্রামী আলেম ও রাজনীতিক মাওলানা হাবিবুর রহমান নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় এক সময়ের ছাত্র এবং পরে শিক্ষক হিসেবে আমার খালাত ভাই মুফতি মুফিজুর রহমানের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। মুফিজুর রহমান এই মাদ্রাসার কুতবখানারও দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালে প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে নিয়ে কুতবখানা দেখালেন। সুবিশাল এ লাইব্রেরিতে বিপুল সংখ্যক কিতাব, রেকর্ডস, পান্ডুলিপি ও মানচিত্র দারুণ ভাবে সাজানো দেখে মুগ্ধ হলাম। তখন তিনি বললেন, সকল কৃতিত্ব আপনার ভাইয়ের। আমার ভাইটিকে নিয়ে সেদিন গর্ববোধ করেছিলাম।
এরপর আরো বহুবার তাকে নিয়ে গর্ব করেছি। একজন মননশী লেখক মুফতি মফিজুর রহমান শিক্ষা ও সমাজ বিকাশে অধিক ব্যাপৃত থাকার কারণে লেখালেখি কম করতেন। গত বছর একুশের বই মেলায় ঢাকার সরলরেখা প্রকাশনা থেকে ‘সৃজনতরঙ্গ সাঈদ চৌধুরী সংখ্যা‘ প্রকাশিত হয়। এর উপদেষ্টা ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাকের দীর্ঘকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী ও দৈনিক সংগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কবি ও ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান। প্রধান সম্পাদক কবি ও কথাশিল্পী জাকির আবু জাফর, নির্বাহী সম্পাদক কবি ও গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন, সম্পাদনা পরিষদ সদস্য কবি ও প্রাবন্ধিক আশরাফ হাসান, কবি ও গীতিকার আজরা পারভীন সাঈদ, লেখক ও প্রকাশক নাজমুস সায়াদাত, কবি ও ছড়াকার মালেক ইমতিয়াজ, সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার ফাহিম ফয়সাল, লেখক ও ব্যাঙ্কার আমিনুল ইসলাম, লেখক ও প্রকাশক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল, কবি ও আবৃত্তিকার মামুন সুলতান এবং সাংবাদিক ও কন্ঠশিল্পী আবিদ আজম। ৮৬৪ পৃষ্ঠার ব্যতিক্রমী এই প্রকাশনায় লিখেছেন ৬২জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
এতে মুফতি মুফিজুর রহমানের লেখাটি পড়ে আমি তাজ্জুব হয়ে গেলাম। তার অনুভব শক্তি ও চিন্তার গভীরতা দেখে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ও গ্রন্থপ্রকাশের জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলাম। তখন কৌমী এদারার সিলেবাস ভিত্তিক গ্রন্থ লেখা শুরু করেছিলেন। মাঝে মধ্যে আমাকে পড়ে শুনাতেন।
তখন আমি বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি, উপমহাদেশের সংগ্রামী মাশায়েখ শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান, আশরাফ আলী থানবী, হুসাইন আহমদ মাদানী, আনোয়ার শাহ্ কাশমিরী, সাব্বির আহমদ উসমানী সহ বরেণ্য স্কলারদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে তার ব্যাপক অধ্যয়ন ছিল। যে কোন তথ্য চাইলে নির্ভুলভাবে তারিখ সহ ঘটনা বলে দিতে পারতেন।
স্বপ্নবান প্রতিভাধর সদা হাস্যমুখ মুফতি মুফিজুর রহমান ছিলেন বিনয় ও নম্রতার উজ্জ্বল উদাহরণ। বহু কারণে তিনি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন। আগামীকাল বেলা আড়াইটায় পুরান কালারুকা মিসবাহুল উলুম মাদরাসার প্রাঙ্গনে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। মহান আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।