বন্ধু অন্তপ্রাণ একজন মানুষ কবি মাশূক ইবনে আনিস। দেশ-গ্রামের মানুষকে ভালোবাসেন। প্রবাসে থেকেও দেশের রাজনীতি করেন। দেখতে চান দেশটাকে সমৃদ্ধির সোনালী দিগন্তে। জন্মভূমি নিয়ে সীমাহীন বাসনা লালন করেন। তার কবিতায় তুলে ধরেন মনের কথামালা। দারুণ ছন্দে লিখেন তিনি। ২৩ মার্চ ছিল এই কবির শুভ জন্মদিন।
সৈয়দপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেছেন মাশূক ইবনে আনিস। সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম সৈয়দপুর। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় অবস্থিত। সেটা অবশ্য বৃহত্তর সিলেটের মানুষকে বলতে হয়না। সৈয়দপুর সম্পর্কে প্রায় সকলেই জানেন। হজরত শাহজালাল রহমতুল্লাহির অন্যতম সাথী শাহ সৈয়দ শামসুদ্দীন রহ. ১৩০৩ সালে এই গ্রামে যে সংস্কৃতির আবহ তৈরী করেছেন, আজো তা বহমান আছে। এই গ্রামের মানুষ আচরণগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এশিয়ার মধ্যে আলাদা। প্রায় প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত, বিনয়ী, ভদ্র ও মার্জিত। কুশলাদির সময় কিংবা কোন কাজের কথাতে এদের চেহারায় বিরক্তির ছাপ পড়ে না। তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ হাসি উপেক্ষা করা বেশ কঠিন।
প্রবাসী প্রধান গ্রাম সৈয়দপুর। হাজারো বিলেত প্রবাসির এলাকা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রয়েছে এ গ্রামের কৃতি পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এমন একটি নান্দনিক গ্রামের মায়াময় পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মাশূক ইবনে আনিস এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ। তার কথার মাঝে জাদু আছে। একজন চৌকস, মেধাবী ও সংস্কৃতিপ্রেমী হিসেবে সেই ছেলে বেলায় তাকে যতবার দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি।
মাশূক ইবনে আনিসের শিক্ষাজীবন শুরু পারিবারিক পরিবেশে, পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে। প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি হয় প্রথমে গ্রামের দরগাহ মসজিদ মক্তবে ও পরে সৈয়দপুর কৌমী মাদ্রাসায়। তারপর সৈয়দপুর মডেল প্রাইমারি স্কুল শেষে সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, সিলেট এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং এমসি কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন তিনি।
প্রেম আর দ্রোহের কবি মাশূক ইবনে আনিসের বহু পংক্তিমালা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তিনি লিখেন- ‘ধুলোবালিকণা/ শব্দগুলো শবাধিক ভারি/ তীরবিদ্ধ করো কুসুমের প্রাণ/ বহনে অযোগ্য আমি, তবু কবিতা শোনাবো/ এহেন কথার কাটিতে বিদ্ধ করোনা প্রাণ/ আমি যে কোমল হৃদয় বনস্পতির পালক/ শুধু মায়া ফেরি করি স্পন্দনে-স্পন্দনে।’
কুসুমকথা কবিতায় মাশূক ইবনে আনিস বলছেন- ‘এমন অবেলায় ফুটেছে যে ফুল,/ তার সঙ্গে নেই এতোটুকু পরিচয়/ শুধু মনে হয়/ আমি বুঝি তারে চিনি জন্ম জন্ম আগে/ আমি তারে অদৃশ্যে করি প্রার্থনা, করি প্রেম/ তারে বড়ো বেশি ভালোলাগে।’
দেশটাকে চেটেপুটে উপভোগ করার লালসে যারা রাজনীতি করে, মাশূক ইবনে আনিস তাদের ঘোর বিরোধী। সততা ও মহানুভবতায় অবিচল স্বদেশপ্রেমিক এই লেখক বন্ধুদের মাঝে খুবই জনপ্রিয়। মানুষ তো কতই আছে। রূপে-গুণে কিংবা মেধায়-মননে বৈচিত্রময়। কিন্তু মাশূক ইবনে আনিস ক’জন আছে। যাকে তার বন্ধুরা সবাই ভালোবাসে। অকপট সরলতা এবং অবিশ্বাস্য প্রাণচাঞ্চল্য ও সাহসী হৃদয়ের মানুষ তিনি। তার নিজের ভাষায়- ‘নদীটি যেখানে বিলীন হয়েছে আপন ইচ্ছায় সেইটিই আমার বিশাল শূন্য বুক,/ সেখানেই প্রেম নিহিত রয়েছে নীল বেদনায়!/ খুঁজে নিতে পারো যে-নয়ন উৎসুক।’
অথবা ‘পাথর-প্রস্তর বুকে মাশূক পরিচিতি আছে সদা-বিদ্ধমান, শব্দ-সংহার করে উদ্ধার করো যদি; খোঁজে পাবে শত সহস্র প্রমাণ …’
মুখের ভাষায় মনের কথা বলেন মাশূক ইবনে আনিস। মনের মাধুরী মিশিয়ে আশিক-মাসুকের কল্পনার জগৎকে ফুটিয়ে তোলাই যেন তার কাজ। আর তাইতো তিনি সহসা বলে বেড়ান- ‘কথাই কবিতা হয়, কবিতাও কথা হয়েছিলো কবিদের ভালোবাসা পেয়ে।’
অবশ্য ভালোবাসা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে এই কবি বলেন- ‘পিরিতের চালে যদি হয় কখনও ভুল/ তোমায় সারা জীবন দিতে হবে/ সেই ভুলের মাশূল!’
আর মাঝে মাঝে কবি নিজিই জানতে চান- ‘কোথায় দাঁড়িয়ে আছি অথবা দাঁড়ালাম কোথায় এসে!/ এখানে যমদূতেরা কথা বলে যায় হেসে হেসে/ আমিও তেমন স্বাভাবিকই আছি এক চেতনাহীন নরাধম/ সময় করছি পার মৃতবৎসার বৎসনাকে ভালোবেসে!’
১৯৮৩/৮৪ সালে সেই পনেরো-ষোল বয়স থেকে মাশূক ইবনে আনিস লেখালেখি শুরু করেছেন। গ্রামের অগ্রজ অনেকের সাহিত্য চর্চা তাকে তাড়িত করেছিল। বৃটিশ আমলে প্রখ্যাত মনীষী সৈয়দ শাহ শাহনুরের স্ত্রী সামিরা বানু ছিলেন সবিশেষ খ্যাতিমান কবি। ৫০ এর দশকে দৈনিক আজাদ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সৈয়দ শাহাদাৎ হোসেন ছিলেন আরেক উপন্যাসিক এবং সুসাহিত্যিক। তখন থেকেই সৈয়দপুরে সাহিত্য-সংষ্কৃতি চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে।
সৈয়দপুরে আমার অনেক আত্মীয়, প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও বন্ধু-স্বজন রয়েছেন। তাদের অনেকের কথাও এখানে উল্লেখ করতে মন চেয়েছে। কিন্তু পরিসর বৃদ্ধির কারণে সেটা হয়ত ঠিক হবেনা। সিলেট সদরে আমার নিজের গ্রাম নোয়াগাও ছাড়া জীবনে সম্ভবত সৈয়দপুর গ্রামে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি।
সিলেট নগরির হাউজিং এস্টেট এলাকায় বাস করেন আমার একজন প্রিয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দপুরের কৃতি সন্তান অধ্যাপক মাওলানা সৈয়দ একরামুল হক। তার কাছ থেকে জানা যুগ-জিজ্ঞাসার অনেক জবাব আমি বিভিন্ন সময় আমার লেখায় উল্লেখ করেছি। একজন ইসলামিক স্কলার ও আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তক হিসেবে তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ। প্রচার বিমুখ এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে বুঝতে হলে যে যোগ্যতা দরকার, সেটা সমকালের অনেকের মধ্যে নেই।
শহরের পাঠানটোলা বাস করেন সৈয়দপুরের আরেক কৃতিপুরুষ কর্ণেল অব. সৈয়দ আলী আহমদ। তিনি একজন কবি, কথাসাহিত্যিক, সাহিত্য-সমালোচক, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ। নব্বই দশকে আমি সংলাপ সাহিত্য-সংষ্কৃতি ফ্রন্টের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সাহিত্য চর্চায় তাকে সব সময় কাছে পেয়েছি। বিবিআইএস প্রতিষ্ঠাকালে রেক্টর হিসেবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা বিস্তারে এবং পরবর্তীতে ওয়েস্টপয়েন্ট স্কুল ও কলেজ সফল করতে এক সাথে বেশ দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছি।
সিলেটে আধুনিক ও ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা বিপ্লবের সূচনায় বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে (বিবিআইএস) আমার সহযাত্রীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দপুরে সাদা দ্যূতিময় অন্তরের মানুষ মরহুম সৈয়দ শাহ কামাল চৌধুরী এবং নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী ফজলুর রহমান। সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার জন্য তাদের আন্তরিক প্রয়াসে আমি মুগ্ধ ও প্রাণিত হয়েছি। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুচনালগ্নে বিশেষ করে সিলেটে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করতে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন সৈয়দপুরের আরেক কৃতি ব্যাংকার সৈয়দ আবু নসর। তার এই সফল প্রয়াসে আমরাও অংশিদার ছিলাম।
সেই তরুণ বয়সে সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে যখন সরব হই, তখন কবি দিলওয়ার ও কবি আফজাল চৌধুরীর পরেই যাকে শক্তিমান কবি হিসেবে পেয়েছিলাম, তিনি হলেন সৈয়দপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক কবি ফরীদ আহমদ রেজা। কলামিস্ট, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। সাপ্তাহিক সিলেট সংবাদে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সিলেটের ডাকে সহকারী সম্পাদক, দৈনিক জালালাবাদীতে সহকারী সম্পাদক ও সাপ্তহিক বিক্রমে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে তিনি লন্ডনে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক এবং ‘কবিতা’ নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করেন।
গত ডিসেম্বরের ২২ তারিখ চলে গেলেন মহৎপ্রাণ সৈয়দ সোলেমান। সদা হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল হাফিজ সৈয়দ সোলেমান আহমদ ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। সজ্জন, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী। তাকে নিয়ে সৈয়দপুর বাজার, ভবের বাজার, বড়গুল সহ এই গ্রামে কত ঘুরেছি, সেই সময়ের কথাগুলো মনের আয়নায় ভেসে ওঠেছে। আমার বাল্যবন্ধু সৈয়দ তালহা এবং সহপাঠী হাফিজ মইনুল সহ অনেকে আজো সে সম্পর্ক ধরে রেখেছেন। আমার ছাত্র মুসান্নাহ অনেক বড় হয়েছে। আমার ছাত্রী সৈয়দা নাহার এখন সৈয়দপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গ্রামীন জনপদে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে শিক্ষার প্রসারে বিপ্লব সাধন করছে।
বিলেতে আমাদের প্রিয় সাংবাদিক ও সহকর্মীদের মধ্যে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, সাংবাদিক ও রাজনীতিক সৈয়দ ফারুক, সত্যবানী ডটকম এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক শুদ্ধতা ও শুভ্রতার কবি আহমদ ময়েজ, লেখক-সাংবাদিক সৈয়দ আব্দুল কাদির, সৈয়দ মবনু, সৈয়দ নাছির সহ সৈয়দপুরের আরো অনেকে সৌরভে-গৌরবে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। সব্যসাচী লেখক হিসেবে রয়েছেন সৈয়দ শাহীন, মনি হক, সৈয়দ মিলু কাশেম, সৈয়দ ওবায়দুল হক মসনু, কবি ও ছড়াকার দিলু নাসের, লেখক ও প্রকাশক শাসস নুর সহ আরো অনেকে। যাদের লেখায় নতুনেরা প্রেরণা লাভ করেন।
মাশূক ইবনে আনিস অকপটে অগ্রজদের স্মরণ করেন। লেখালেখির সূচনাতে প্রথমে বিভিন্ন ম্যাগাজিন, ছড়াপত্র, স্মরণিকা ও সাহিত্য পত্রিকাতে তার লেখা ছাপা হতো। ১৯৯০ সালে প্রথম কবিতার বই ‘যদি বিদ্রোহ করি’ প্রকাশিত হয়। প্রায় একদশক পর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘অবশিষ্ট শূন্য এক’ এরপর ‘অলৌকিক মাশূকনামা’ এবং সর্বশেষ ‘অর্কের অধিবাস’ বেরিয়েছে। কবিতাই তার ধ্যানজ্ঞান। গীতিকবি হিসেবেও খ্যাতি আছে। অসংখ্য গান রচনা করেছেন। ‘মাশূকে এলাহি’ নামে অচিরেই প্রকাশিত হবে সেই গ্রন্থ।
মাশূক ইবনে আনিস ৮০ দশকের মধ্যভাগ থেকে সাহিত্যপত্র ও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে জড়িত। একসময় সিলেট এবং বিলেতের সাহিত্যাঙ্গনে ‘আদি কাকতাড়ুয়া’ একটি নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ছিলো। সেটা সম্পাদনা করতেন তিনি। এছাড়াও ৮০ দশকের সাড়া জাগানো ‘কথকতা’ সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদনা সহযোগী ছিলেন। সৈয়দপুর থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজ ‘আভাষ’ প্রকাশনায়ও নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন সংযুক্ত ছিলেন। লন্ডনের প্রায় সব কটি পত্রিকায় এবং বাংলাদেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় তার প্রতিবেদন, কবিতা, সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। এছাড়া কিছু দিন চ্যানেল আই ইউরোপেও কাজ করেছেন।
মাশূক ইবনে আনিস এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তার স্ত্রী নাসিমা জোহা চৌধুরীও একজন ভাল কবি। শুভ জন্মদিনে অফুরন্ত ভালোবাসা ও শুভ কামনা- ভালো থাকুন কবি, সমাজ ও মানবতার কল্যাণে লিখে যান অবিরাম।
লেখক: সময় সম্পাদক। কবি ও কথাসাহিত্যিক।