আল মাহমুদের সোনালি কাবিন ।। ড. ফজলুল হক তুহিন

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঁচ

বিষয় বৈচিত্র্য

‘সোনালি কাবিন’ বহুস্বর ও বহুস্তরে বিন্যস্ত অবিস্মরণীয় কাব্য। যে-কোনো কাব্যগ্রন্থের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য এর গভীরে বহমান ধারাগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। কবিতায় স্বাক্ষরিত বিষয়গুলো প্রসঙ্গে যৌক্তিক বিশ্লেষণ, প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন এবং বিচিত্র দৃষ্টির যোগসূত্র স্থাপন করা দরকার। ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে নানা ধরনের বিষয়-আশয়। নারী, প্রকৃতি, স্বাদেশিকতা, সমাজবোধ, রাজনৈতিক চেতনা, সাম্যবাদ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মৃত্যুচেতনা ইত্যাদি বিষয়সমূহ এ-কাব্যে গভীর দ্যোতনায় ও ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত।

নারী

নারী ও পুরুষ মানবজাতির আদি-উৎস। এই উৎসধারায় পৃথিবীতে মানুষের ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিস্তার ঘটেছে। এই প্রবাহের ধারাবাহিকতায় মানব সভ্যতারও সৃষ্টি। আর মানব সভ্যতার প্রকাশ শিল্প-সাহিত্যে সুচারুরূপে যতটা হয়েছে, অন্য কোনো মাধ্যমে তা হয়নি। শিল্পে, বিশেষভাবে সাহিত্যে মানুষের অন্তর ও বহির্জগতের সমগ্র ছবি অঙ্কিত হয়, যেখানে নারী বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। তবে ভারতবর্ষের ইতিহাসের হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীজাতির সম্বন্ধে শিল্প এবং ব্যবহারিক জীবনে দুই পরস্পর বিরোধী মনোভঙ্গির পরিচয়।

মানব সভ্যতার আদিপর্বে সামাজিকভাবে এবং বিধিগতভাবে নারীরা বেশি সম্মান এবং ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শ্রেণীভিত্তিক সমাজ তৈরি হবার আগের যুগে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী কালে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ওপরেও তার প্রভাব দীর্ঘদিন এবং ব্যাপক হারে বিদ্যমান ছিল। এ-কারণে সমাজে নারীর সংস্থিতি নির্দিষ্ট হয়েছিল মাতা অর্থাৎ জন্মদাত্রীরূপে, গোষ্ঠীর সংরক্ষয়িত্রী হিসেবে। আদিম সমাজে নারীর সেই সুদৃঢ় মর্যাদার আসন, তাকে গোষ্ঠীমাতা এবং ‘আদি প্রমাতামহী’তে রূপান্তরিত করে। উর্বরতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের ফলে তার পরিণতি মাতৃদেবতা বা উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে।

দৈনন্দিন জীবনে সে-ই সংসারের ভরকেন্দ্র, পরিবারের সম্পত্তি সমূহের সংরক্ষক হয়ে ওঠে। তার কাজকর্ম, কর্মনৈপুণ্য এবং শৈল্পিক গুণাবলী একত্রিত হয়ে গোটা সমাজের পক্ষে প্রধান এবং স্থায়ী ভিত্তিতে পরিণত হয়। ভারতের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলা হয়েছে সেগুলি এদেশের লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিক; যথা: লোককাব্য, লৌকিক কাহিনী, লোকগীতি ও নৃত্য, লোকায়ত চিত্রকলা এবং কারুকৃতি সবকিছু সম্বন্ধেই আরো বেশিভাবে প্রযোজ্য। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই নারীকে দেখা যায় তার পরিপূর্ণ কর্তৃত্বে, পূর্ণায়ত মর্যাদায়, পুরুষের সহযোগিতায় এবং দায়িত্বের যথাযথ পরিচালনার মধ্যে।

সেজন্য ভারতের সমস্ত রূপকথার নায়িকারূপে নারীর যে স্থান আছে, তার প্রকাশ বিচিত্ররূপে হয়েছে: কখনো রূপসী, কখনো চতুরা, কখনো যাদুশক্তিধারিণী অথবা দুঃসাহসিকা। সেই নারীর রূপ কোনো সময়ে কামনা বাসনায় উদ্বেল এবং মুক্ত জীবনের পিপাসার্ত, কখনো সে দেবী, কোনো সময়ে দানবী, সর্পকন্যা অথবা হংসবালা, রানী কিংবা রাজপুত্রী। কিন্তু সে সরলা গ্রামবালিকা বা কল্যাণী গৃহবধূরূপেও বিরাজিত। ভারতীয় লোককাহিনীর এই সমস্ত মূর্তির সারনির্যাসই নিবেদিত হয়ে আছে ভারতের শিল্পকলায় নারীর অনুভাবনায়।

আধুনিককালে নারীকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে নারীবাদ। পাশ্চাত্যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের সূচনায় নারীবাদ একটি আন্দোলন ও তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। পশ্চিমের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে সূচিত হয় নারীবাদের প্রেরণা ও যাত্রা। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ও লিঙ্গবৈষম্য এবং এই কর্তৃত্বের কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধান ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীমুক্তির পথ নির্মাণ নারীবাদের মূলকথা।

বাংলাদেশে নারীবাদের সূচনা সাম্প্রতিককালে এবং তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চিন্তার জগতে নারীবাদের বিকাশ ও প্রাধান্য ক্রমবর্ধমান। আল মাহমুদের কবিতায় পশ্চিমের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেনি। বাংলার কৃষিভিক্তিক ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থানকে কবি গ্রহণ ও প্রকাশ করেন; যেখানে লিঙ্গবৈষম্য বা পুরুষ কর্তৃত্ব নেই। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার সম্পর্কে কবি আস্থাশীল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় অঙ্কিত নারীচরিত্রের রূপ ও প্রকৃতি আল মাহমুদের নারীচরিত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, শাক্ত পদাবলী, সহজিয়া গান, বিদ্যাপতির কবিতা, বাউল গান, বৈষ্ণব কবিতা, মঙ্গল কাব্য, রোম্যান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে শরীরী-সংরাগসহ বাস্তব নারীর প্রকাশ ঘটেছে। তবে নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব সেখানে স্বীকৃত নয়। নারী পুরুষের কামের সঙ্গি হয়েছে, সৌন্দর্য পিপাসা বা কামতৃষ্ণা মিটিয়েছে। তাকে কখনো দেবী, কখনো দাসী করা হয়েছে। তবে লোকসাহিত্যে নারীর মর্যাদা বা নারীর স্বাধীন সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের ধারায় আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এসে নারী ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত। তাই কবিতায় নারীর অবস্থানের বদল ঘটেছে। সেই সঙ্গে আল মাহমুদের কবিতার রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নারীচরিত্রেরও বারবার পরিবর্তন ঘটেছে।

বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন পরবর্তী পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় একজন স্বতন্ত্র ও মৌলিক কবি হিসেবে আল মাহমুদের উন্মেষ ও বিকাশ। এ-সময়ের অন্যান্য কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতায় নারীর প্রাধান্য তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো’ পর্যন্ত দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের কবিজীবনে আল মাহমুদ নারীকে কবিতার প্রধান বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

আমার বিষয় তাই, যা গরিব চাষীর বিষয়
চাষীর বিষয় বৃষ্টি, ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানাখন্দহীন
সীমাহীন মাঠ।
চাষীর বিষয় নারী উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।
[‘কবির বিষয়’, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না]

গদ্যে স্বীকারোক্তি: আমার কবিতায় প্রধান বিষয় হলো নারী। আমি এক সময় ভাবতাম একজন কবি-পুরুষের কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর কি আছে? না, কিছু নেই। পৃথিবীতে যত জাতির কবিতায় যত উপমা আছে আমি আমার সাধ্যমত পরীক্ষা করে দেখেছি সবই নারীর সাথে তুলনা করেই। দয়িতার দেহের উপমা দিতে কবিরা পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে চষে ফেলেছেন। ৪৭

বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসের নারী আল মাহমুদের কবিতায় প্রধানরূপে বিবেচিত, তবে তাঁর নারী ভাবনার ক্রমপরিবর্তন লক্ষণীয়। ‘সোনালি কাবিনে’ নারী চরিত্র নিমার্ণে কয়েকটি দিক অনন্য ভাষাশৈলীতে প্রকাশিত হয়েছে।

আল মাহমুদ কাব্যচর্চার সূচনাকাল থেকেই নারীকে গৃহস্থ-প্রেমের প্রতীক ও যৌনতৃপ্তির আশ্রয় ভেবেছেন। তাঁর চিত্রিত নারী বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সামাজিক ও গার্হস্থ্য জীবনের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সাথে সম্পর্কিত। তবে এই নারী কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় অঙ্কিত সমাজের প্রকৃতি লালিত, বিরহে কাতর ও আনন্দে উদ্বেল নারী নয়; এমন কি আনন্দ-বেদনায় নারীর চিরসৌন্দর্যরূপিণী ধারণার সাথেও মেলে না। সামন্তবাদী সমাজের (Feudal System) নারী নয়; বরং এ নারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের (১৯১৪-৭৬) আঁকা পরিবর্তিত সমাজের সংগ্রামী নারী, যাকে কবি ইতিহাসের ধারায় অনার্য বাঙালি হিসেবে অভিহিত করেন। এই পরিচয়ের মাঝেই একজন নারী খুঁজে পায় প্রেমের স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ এবং জীবনের সার্থকতা।

এ-সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য: “আল মাহমুদের চিরকালের কবিতায় প্রেম যতটা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে নারী। প্রেমিকতার চেয়ে সম্পূর্ণ নারীত্বই তাঁকে চিরকাল আকর্ষণ করেছে। আর সে-নারীত্বে প্রেমের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে কামনা। নিষ্কাম প্রেমের কবিতা, মর্মচ্ছেদী বিরহের কবিতা, দিগন্তভেদী প্রিয়া-হারানোর ব্যথার কবিতা আল মাহমুদ কখনো লেখেননি। আল মাহমুদের বহু কবিতা গার্হস্থ্য প্রেমের কবিতা।”৫০

গৃহস্থ-প্রেমের আধারে আল মাহমুদের নারী হয়ে ওঠে যৌনতা ও কামজতার প্রতিভূ। কবি রবীন্দ্রোত্তর কালের মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) ও বুদ্ধদেব বসুর দেহাত্মবাদী ভাবধারার অনুগামী। ঘরের ও বাইরের জগতের নৈরাশ্য-নিঃসঙ্গতা-ক্ষোভ-বিচ্ছিন্নতা-সংকট থেকে কবি মুক্তি ও আশ্রয় এই নারীর মাঝে চেয়েছেন ও পেয়েছেন। ‘সোনালি কাবিনে’ নারীর কামজ ডাক কবি-পুরুষের দেহ-মনে-চৈতন্যে সঞ্চারিত হয় শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে। প্রাচীন বাংলার পথ ধরে কবি এই নারীকে ‘বাঙালি কৌমের কেলি’ সজাগ করতে বলেন, যে কামকলা বিশ্বখ্যাত বাৎসায়ন ও আর্যের যুবতীরা পর্যন্ত জানে না।

‘দেনমোহর’ ছাড়াই কবি তাকে শুধু দৈহিক আকর্ষণে বাঁধতে চান: ‘দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন’। কবি এভাবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে অঙ্কিত করেন উভয়ের শরীরী-সংরাগ, সত্তার আনন্দ ও উচ্ছ্বাসময় প্রাধান্য। অভাব, দারিদ্র্য কিংবা পিছুটান পুরুষের ইন্দ্রিয়তাড়িত সত্তাকে প্রতিরোধ করতে পারে না, সেজন্যে দেহের বিনিময়ে দেহ পাওয়ার শর্তে নারীর কাছে পুরুষের অকপট আর্জি। কেননা এই নারীই তাঁর সমস্ত আনন্দ, সংকল্প ও জৈবতৃপ্তির কেন্দ্রস্থল। যেমন:

ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ
তুলে মিলে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়,
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।
[‘সোনালি কাবিন: ৩’, সোনালি কাবিন]

নদীর ঢেউ মানুষের আবাস গড়ে, আবার ভাঙে। কবি-পুরুষের তাই আকুল আবেদন তার প্রার্থিত নারীর সাথে তিনি নতুন প্রতিশ্রুতিতে নদীর ঢেউয়ের মতো ‘অকর্ষিত উপত্যকায়’ যেন মিশে যেতে পারেন। সেই নারী চরের জমির মতো যেন উন্মুক্ত করে দেয় শরীরের সব বাঁধুনি-ভাঁজ। কাদার মতো নারীর দেহ-জমিনে কবি-পুরুষ যেন ‘তৃপ্ত’ হতে পারে। অতঃপর নারীর প্রতি কবি-পুরুষ ‘ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়’ ডুবে গিয়ে বংশধারায় চলমান হতে আহ্বান জানান। কেননা এই নারী একদিকে যেমন পুরুষের জৈবতৃষ্ণা নিবারণ করে, অন্যদিকে মানবপ্রবাহ সচল রাখে। কবি উভয় দিকের প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন।
অবশ্য ‘কাবিনে’র মাধ্যমে কবি নারীর সঙ্গে নৈতিক ও আইনি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জৈবিক ক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন।

প্রাবন্ধিক শিবনারায়ণ রায়ের মতে- “আল মাহমুদ শুধু শক্তিমান কবি নয়; এদিক থেকেও তাঁর কাব্য সাধনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। তাঁর উপজীব্য, বাক্-প্রতিমায় সংযুক্তিতে নাগরিকতা এবং আঞ্চলিকতার টানাপোড়েন অনেক সময় জামদানি শাড়ির কথা স্মরণে আনে। তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী; কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদোম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তাঁর টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে, সেই কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন।“ ৫১

লৌকিক সংস্কারে আকৃষ্ট হয়েও কবি নারীকে কূলপ্লাবী নদীর সাথে তুলনা করেছেন। এক্ষেত্রে কবি নদীর সঙ্গে নারীর স্বভাব ও হস্তনির্মিত কারুকর্মের সাযুজ্য সন্ধান করেন। কবির ভাষায় নদীর দু’পাড়ের শস্যখচিত সৌন্দর্যের অনুকরণে নিহিত রমণীর নকশা-কাটা শাড়ির বুননের এবং পরিধানের ধারণা। নদীর আকস্মিক বাঁকফেরার ভঙ্গি থেকে রমণীরা ঐ নকশা-কাটা শাড়ি দিয়ে তাদের শরীর বিচিত্র ভঙ্গিতে আবৃত করেন।

নদী, নদী-
সন্তানের উল্লসিত আনন্দের মধ্যে আঙুল তুলে
যে স্পষ্ট জলধারা দেখালো, তা আমাদের প্রাণ।
এই সেই স্রোতস্বিনী, যার নকশায় আমাদের রমণীরা
শাড়ি বোনেন। ঐ সেই বাঁক যার অনুকরণে
আমার বোনেরা বঙ্কিম রেখায় এঁটে দেহ আবৃত করেন।
[‘স্বপ্নের সানুদেশে’, সোনালি কাবিন]

আবার সেই নারী কখনো সম্পূর্ণ বদলে নদী হয়ে যায়। কবির পছন্দ মতো শাড়ি কোনো নারী পরলে সেও নদী হয়ে যায়, কেননা কবি নদীকে ভালোবাসেন। পদ্মা ও করতোয়ার মৃত্যুতে কবি নারীকে নদী হতে বলেন। কারণ নারীকে কবি জীবনের উৎসস্থল ও উৎসধারা মনে করেন।

ভারতের লোকায়ত দর্শনে ও সংস্কারে সন্তান উৎপাদনের ব্যাপারে নারীর ভূমিকা এবং ফসল ফলানোর ব্যাপারে প্রকৃতির ভূমিকা- এ দুয়ের মধ্যে একটা গভীর যোগাযোগ কল্পনা করা হয়। প্রকৃতি মাতার সঙ্গে মানবী মাতার, প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সঙ্গে মানবিক ফলপ্রসূতার, প্রকৃতির উর্বরা শক্তির সঙ্গে মেয়েদের উর্বরা শক্তির, ভূমিকর্ষণের সঙ্গে মৈথুনের সম্পর্ক ও সাদৃশ্য কল্পিত হয়ে থাকে। আর মেয়েদের মধ্যে একটি অদ্ভুত শক্তি লুকানো আছে যার দরুনই মেয়েরা সন্তানবতী হয় এবং যার প্রভাবে তারা পৃথিবীকেও ফলপ্রসূ করে।৫২

এ ধরনের আদিম সংস্কারে আপ্লুত হয়ে কবি মৃত্তিকা কর্ষণের মতো নারীকে কর্ষণে ফলবান করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। সমালোচকের মতে, “আদিমতাকে একটি প্রত্যয়ে উপস্থিত করার জন্য এবং সততায় নির্বাচিত করবার জন্য আল মাহমুদ অধিকাংশ কবিতায় যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তিকে গ্রহণ করেছে।”৫৩

অর্থাৎ বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করেই কবি নারীকে ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে একীভূত করেন। কবির ব্যক্তিসত্তা এখানে উপমিত হয় কৃষিজীবনের অঙ্গীকারে। “কেননা নারী বসুন্ধরা, নারী জননী এবং নারীতে সুপ্ত প্রজন্মধারা। সে কারণে তিনি আকৃষ্ট হন খনার শ্লোকের প্রতি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে বিদুষী নারী খনা ছিলেন জলবায়ু সচেতন। তিনি সঠিক ঋতু গণনায় ফসল ফলানোর সর্বোৎকষ্ট সময় নির্ধারণ করেন। তাঁর উচ্চারিত বচন বেদবাক্যের মতো পরম সত্য বলে বিবেচিত।”৫৪

‘জ্যোতিষী’ খনাকে সামনে রেখে কবি তাই বলেন, ‘নারীর দেহের চেয়ে নম্য কিছু নেই পৃথিবীতে’। সব মিলিয়ে কবির কাছে ‘নারী এক রহস্যের নাম’। কৃষির সূচনায় নারী, সমস্ত শক্তির আধার এবং জ্ঞানীদের তৃষ্ণা নিবারণের পানীয় বিশেষ এই নারী; এমন কি নারীতে জীবজন্তুও বশীভূত।” ৫৫

কৃষিব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বলে প্রকৃতির বিষয় উত্থাপিত হলেই কবি খনার প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। নারী ও প্রকৃতির একাত্মতার এই ধারণার সাথে বর্তমানে আলোচিত ‘সবুজ নারীবাদে’র (Ecofeminism) কথা উল্লেখ করা যায়। কবি আবার নিজস্ব মানবীর সাথে সাযুজ্য কল্পনায় খনা ও প্রকৃতিকে একাত্ম করে গভীর উপলব্ধির নিরীখে।

চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপটিপ শব্দে সারাদিন
জলধারা ঝরে! জমির কিনার ঘেঁষে পলাতক মাছের পেছনে
জলডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দেখেছি চেয়ে।
[‘প্রকৃতি’, সোনালি কাবিন]

খনাকে স্মরণ করে কবি মাটিতে কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে ইন্দ্রিয়জ আকর্ষণে আপ্লুত হন। নারী ও প্রকৃতি একই দৃষ্টিতে বিবেচনা করে ‘মৃত্তিকা’কে ‘প্রিয়তমা কিষাণী’রূপে আখ্যায়িত করেন। মৃত্তিকার মতো নারীও উর্বর শরীরে আহ্বান জানান কবিকে। কবি এইভাবে ই্িন্দ্রয়তাড়িত দুরন্ত কামনাকে জীবনের সঙ্গে শৈল্পিক সুষমায় ব্যক্ত করেন।

কতদূর এগোলো মানুষ!
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার।
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার।
[‘প্রকৃতি’, সোনালি কাবিন]

সমাজে ও সভ্যতায় মানুষ সামনের দিকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে, কিন্তু কবি এখনও প্রকৃতির মাঝেই ব্যাপ্ত হয়ে আছে। কেননা এই প্রকৃতিকেই কবির মনে হয় প্রিয়তমা নারী। প্রকৃতি যেমন বর্ষায় প্রাণ উদ্গমের জন্যে প্রস্তুত হয়, তার নারীও তেমনি প্রজন্মধারা রক্ষার লক্ষ্যে স্বভাবসুলভ লজ্জায় তার পুরুষের কাছে খুলে দেয় সবচেয়ে ‘উর্বর’ ক্ষেত্র। কেননা এই নারী ‘অঙ্কুরের প্রতিশ্রুতি জীবনের আদিম আধার’। বর্ষার বৃষ্টির কুয়াশায় ইন্দ্রিয় ক্ষয়প্রাপ্ত কবির কাছে ‘আইল বাঁধা জমিনের ছক’কে তাই মনে হয় ত্রিকোণ আকারে উন্মুক্ত হয়ে আছে ‘মৃন্ময়ী’ Ñ যার ‘ত্রিকোণ জ্যামিতি’ থেকে ক্রমাগত জন্ম নেয় ‘মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক। অর্থাৎ কবির কাছে সৃষ্টির ব্যাপারে প্রকৃতি আর নারীর মধ্যকার বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতার ধারণা একাকার হয়ে গেছে; যে কারণে কবির কাছে নারী এবং ‘মৃন্ময়ী’ পৃথিবীর রূপ অভিন্ন।

আল মাহমুদের সৃষ্ট নারীকে সামগ্রিক অর্থে বিবেচনা করলে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায়। যথা: ক. কবি অনার্য বাঙালি নারী সৃষ্টি করেন; এই নারীচরিত্র আধুনিক বাংলা কবিতায় কারো প্রতিকৃতি নয়, তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আঙ্গিকে তা প্রকাশিত। খ. কবির নারীরূপ এক জায়গায় স্থির থাকেনি, বারবার বদলে গেছে; গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনতৃপ্তির আধার থেকে প্রকৃতি; প্রকৃতি থেকে জননী, দেশজননী বা বঙ্গজননীতে রূপান্তরিত হয়। গ. কবির নির্মিত নারীচরিত্র আবহমান বাংলার কৃষি-ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বাংলার কৃষকের নারী সম্পর্কে যে ধারণা, সংস্কার ও চেতনা লালন করেন, কবি তার শিল্পরূপ দিয়েছেন জনজীবনলগ্ন বাংলার প্রকৃতি থেকে আহরিত উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প-রূপক ও প্রতীকে। ঘ. কবির সৃষ্ট নারী স্বভাবে, মেজাজে ও ব্যক্তিত্বে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, তিরিশোত্তর কবিবৃন্দ এবং জসীমউদ্দীনের কাব্যে নির্মিত নারী থেকে স্বতন্ত্র। ঙ. কবি অনার্য বাঙালি এই নারীকে ‘শুদ্ধতম শিল্প’রূপে অভিহিত করেন।

কাব্যচর্চার যাত্রারম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত সৃজিত আল মাহমুদের কবিতায় প্রধান আরাধ্য বিষয় হলো নারী। কবি অন্য কোনো মৌলিক বিষয়ও সন্ধান করেন না। তবে নারী-চরিত্র সৃষ্টিতে কবি শৈল্পিক সুষমা ও বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রাখেন। ফলে তাঁর নারীরা বাস্তবের রক্ত-মাংসের হয়েও শিল্পদৃষ্টিতে বর্ণিল। কবি কোনো অস্পষ্টতা ও দূরত্বের চিহ্ন রাখেননি এই নারী-প্রতিমা নির্মাণে। কবি এই কবিকৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের কবিতায় এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে। (চলবে)

* ড. ফজলুল হক তুহিন কবি ও গবেষক, কালজয়ী কবি আল মাহমুদের কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে পিএইচডি, শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’র নির্বাহী সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *