মোহাম্মদ শিশির মনির। শিক্ষাজীবনে ছিলেন তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে শুরু করেন তার দৃপ্ত পথচলা। লিখেছেন ‘An Overview of 100 Sensational Murder Cases of Bangladesh’ শিরোনামের বইটি। বইয়ে রয়েছে ১০০ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিশ্লেষণ যেগুলো বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জটিল জটিল ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে সফল হয়েছেন শিশির মনির। ইতিমধ্যে ভারি করে ফেলেছেন নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিও। সে সবের মধ্য হতে ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখে যাচ্ছেন মামলা পরিচালনার নানান ঘটনা। এবারের পর্বে রয়েছে তেমনই একটি বিষয়, ‘ডেথ রেফারেন্স ও ডেথ সেল’।
প্রায় ৮০০ ডেথ রেফারেন্স_২০০০ আসামী ডেথ-সেলে ১-১৮ বছর বন্দী_ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার স্বরুপ_গণহারে ফাঁসির আদেশ_Sentencing Guideline_চূড়ান্ত হওয়ার আগেই Condemned Cell_Inhuman and Degrading Treatment_মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি_সভ্য সমাজ
১। হোসেন আলী। হত্যা মামলার আসামী। পেশায় কৃষক। দুই সন্তানের জনক। মা জীবিত আছেন। ২০০৮ সালে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। অভাবের কারণে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে নাই। জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেল আপিল দায়ের করে। শুনানির সময় কোর্ট State Defence Lawyer নিয়োগ দেয়। ২০১৪ সালে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তারপর সুপ্রীম কোর্টেও জেল আপিল দায়ের করে। আজ অবধি শুনানি হয় নাই। হোসেন মৃত্যুর সেলে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। গেল বছর করোনার ছোবলে বাবা মারা গেছেন। শেষবারের মত বাবার মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। মূলতঃ বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছে প্রায় ১ মাস পর। সামর্থ থাকলে হয়ত প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বাবার জানাজায় অংশ নিতে পারত।
২। ঘটনার সারসংক্ষেপঃ ২০০১ সালে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়। ভিকটিমের চাচা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ করা হয় কে বা কারা তার ভাতিজাকে রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তিনদিন পর পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাঠে লাশ পাওয়া যায়। ক্ষত-বিক্ষত লাশ। পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে। ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দেয়। পরের দিন ময়না তদন্ত করা হয়। ডাক্তারের ভাষ্য মতে, ‘তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে। গলায় দড়ির চিহ্ন পাওয়া গেছে।’ ভিকটিম পরিবার এলাকায় বেশ প্রভাবশালী। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে। সন্দেহভাজন দুইজনকে আটক করে। কোর্টে চালান দেয়। ৭ দিনের পুলিশ রিমাণ্ড মন্জুর করে আদালত। নানানভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কেউ স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় নাই। আবারও তিন দিনের পুলিশ রিমাণ্ড চাওয়া হয়। আদালত ২ দিনের রিমাণ্ড মন্জুর করে। তাতেও কেউ দোষ স্বীকার করে নাই। তিনমাস জেল খাটার পর তারা জামিনে বের হয়ে আসে।
৩। আগেই বলেছি বাদী পক্ষ বেশ প্রভাবশালী। উপরের চাপ আছে। সন্দেহভাজন হিসেবে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হোসেন আলী তাদের একজন। ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ৭ দিনের পুলিশ রিমান্ড মন্জুর করে। ঐদিনই থানায় নিয়ে আসা হয়। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দিনে-রাতে, সকাল-সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসাবাদ চলে। কখনও মৌখিক কখনও ভিন্ন কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবুও কেউ স্বীকারোক্তি প্রদান করে নাই। রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হলে আদালতে তুলা হয়। আবারও ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মন্জুর করে। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। দ্বিতীয় দিন পার হতেই হোসেন আলী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়। অপর দুইজন রাজি হয় নাই। হোসেন অলীকে স্থানীয় মেজিস্ট্রেট সাহেবের খাস কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনঘন্টা চিন্তা ভাবনা করার সময় দেয়া হয়। অতঃপর তার স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। ভাঙ্গা ঙাঙ্গা গলায় বর্ণনা দেয়। এর উপর ভিত্তি করে পুলিশ চার্জশিট দায়ের করে। নিজেকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার কারণে আদালত তাকে জামিন দেয় নাই। একবার হাইকোর্টে জামিনের জন্য এসেছিল। বেশ টাকাও খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজ হয় নাই। টাকা পয়সার অভাবে আর চেষ্টাও করে নাই। অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার মত অবস্থা। বাকি দুই জন প্রায় তিন মাস পর জামিন পেয়ে যায়।
৪। বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ ডাক্তার, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশসহ মোট ১১ জন সাক্ষী হাজির করে। ঘটনা কেউ দেখে নাই। তাতে কী! স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দী ত আছে। অবশেষে ২০০৮ সালে বিচারিক আদালত তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়। জেলে পা ফেলতেই কয়েদির পোশাক পরানো হয়েছে তাকে। সাদার মধ্যে চেক চেক। মাথায় ক্যাপ। সেই দিন থেকে আজ অবধি প্রায় ১৪ বছর মৃত্যুর সেলে আছে। ৮/৮ ফিট একটি রুম। কোন ভেনটিলেশন নাই। ভিতরেই বাথরুম। ফেন নাই। খাট নাই। শীতের দিনেও মেঝেতে ঘুমাতে হয়। বের হতে পারে না। দুয়ারে একজন রক্ষী বসে থাকে। বাড়ি থেকে এখন আর কেউ যোগাযোগ করে না। সামর্থ নাই। অনেক খরচের ব্যাপার। দুই বিঘা জমি ছিল তাও আর নাই। এদিকে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। বাবার অবস্থা জানার পর কেউ আর সম্পর্ক করতে চায় না। ছেলের পড়াশুনাও হল না। ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে নামেমাত্র মাইনেতে চাকুরি করে। কোন রকম পেট চলে যায়। স্ত্রী ২০ বছর ধরে আসার বুক বেঁধে বসে আছে।
৫। সরকারিভাবে যতটুকু কপালে জুটে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। নামাজ-রোযা পালন করেই দিন কাটায়। আইনজীবী ধরতে পারে নাই। জেল থেকে চিঠির মাধ্যমে জেল আপিল দায়ের করেছে। অপেক্ষায় থাকে কখন তার মামলা সুপ্রীম কোর্টে শুনানি হবে। মৃত্যুর ঘন্টা ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতিতে বেজে উঠে। জেলের ঘন্টা আর মৃত্যুর Pendulum একাকার হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম দুঃস্বপ্ন দেখত। এখন তাও আর দেখে না। ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি প্রায় ১৪ বছর কেটে গেল। অবশ্য তার চেয়ে বেশি সময় ধরে অনেকই মৃত্যুর সেলে আছে। তাদের কথা ভেবে কিছুটা স্বস্তিবোধ করে।
এভাবেই দিন যায় রাত আসে। রাত যায় দিন আসে কিন্তু হোসেন আলীর মামলার কোন সুরাহা হয় না। সুরাহাই বা হবে কেমন করে!! হাইকোর্টে এখনও প্রায় ৮০০ ডেথ রেফারেন্স মামলা ঝুলে আছে। নিয়মিত ২/৪ টি আদালতে শুনানি হয়। গেল বন্ধের সময় মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিশেষ আদালত গঠন করে ২০/২২ টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ঝিনুক দিয়ে নদীতে পানি সেচার মত। নিম্ন আদালতের অনেকেই গণহারে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে যাচ্ছেন। এক মামলায় ৬/৭/১৮/২০ জনকে পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। প্রায় ২০০০ হাজার বন্দী মৃত্যুর সেলে আছে। সাজা প্রদানের সুনির্দিষ্ট কোন guideline নাই। নিজস্ব বিবেচনায় যে যা ভাল মনে করে তাই করে। উন্নত দুনিয়াতে সাজার Guidelines আছে। কি কি factor হাজির থাকলে সর্বোচ্চ সাজা দেয়া যায় আর কখন লঘু সাজা দিয়ে হয় এর জন্য লিখিত নীতিমালা রয়েছে। আমি নিজে বাদি হয়ে একটি রিট মামলা দায়ের করেছি। কেন সাজার নীতিমালা তৈরি করা হবে না হাইকোর্ট এই মর্মে রুল জারি করেছে। হয়ত কোন একদিন সাজার নীতিমালা তৈরি হবে। সাজার মাত্রার ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
৬। প্রশ্ন হল হোসেন আলীকে মৃত্যুর সেলে রাখা হল কেন? তার সাজা কি চূড়ান্ত হয়েছে? আপিল বিভাগে তার মামলা এখনও শুনানির জন্য অপেক্ষমান। এমনও হতে পারে সে খালাস পাবে বা সাজা কমে যাবে। কিছুদিন আগেও সুপ্রীম কোর্ট প্রায় ১৮ বছর মৃত্যুর সেলে থাকার পর খালাস দিয়েছে? যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেই হোসেন আলীর সাজা সুপ্রীমকোর্ট বহাল রাখবে তারপরও সে রিভিউ আবেদন করতে পারবে। সেখানেও যদি বহাল থাকে তাহলে সে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবে। তারপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রশ্ন আসবে। এখনও অনেক পথ বাকি! তাহলে কেন তাকে নির্জন কক্ষে রাখা হল? কেন সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুর প্রহর গুণতে হচ্ছে! মৃত্যুর জন্য ক্ষণ গণনা করা কী এতই সহজ!! শেষ মেস খালাস পেলে কী হবে!! পারব তার হারানো সময় ফেরত দিতে!! শুধু কি তাই? খালাস পেয়ে বেরিয়ে এসে দেখবে তার বাবা-মা নেই। স্ত্রী বৃদ্ধ হয়ে গেছে। মেয়ে আজও অবিবাহিত। ছেলে কোথায় আছে কেউ জানে না। ভিটে মাটি অন্যের দখলে। রাষ্ট্র কী পারবে এগুলো ফেরত দিতে? চূড়ান্ত হওয়ার আগেই কেন এই নির্জন condemned cell?
৭। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই প্রশ্ন উঠেছিল। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘সকল আইনি ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষ হলেই তাকে মৃত্যুদণ্ডের আসামী বলা যাবে। এর আগে নয়।’ আমরা শুরুতেই মৃত্যুদন্ডের আসামী বানিয়ে তাকে condemned cell এ নিয়ে যাচ্ছি!!
ব্রিটিশ বেনিয়াদের তৈরি করা জেল কোড আজও তাবিজ হয়ে আছে!! কত শিক্ষিতজন! কত হুমরা চুমরা আসেন আর যান জেল কোডের অমুঘ বাণী সেভাবেই থেকে যায়। এটা কী ধর্মীয় গ্রন্থ যে পরিবর্তন করা যাবে না? কেন আজও নির্জন কক্ষে একাকী রাখার বিধান জেল কোডে রয়ে গেছে? শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কি জন্য দেয়া হয়? শুধু উদর পুর্তি করার জন্য! নাকি বিবেক খাটিয়ে চিন্তা করার জন্য!
৮। কিছুদিন আগে হাইকোর্টে একটি মৃত্যুদণ্ডের মামলা শুনানির সময় এই প্রশ্ন আমি তুলেছিলাম। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড হাইকোর্ট কর্তৃক confirm করতে হয়। তাহলে বিচারিক আদালত কর্তৃক রায় ঘোষণার সাথে সাথে কেন মৃত্যুর সেলে নিয়ে যাওয়া হয়? আদালতের কাছে নিবেদন করলাম, ‘My Lords, বিগত ৫০ বছরে হাইকোর্টে কতগুলো ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়েছে? কতগুলোতে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে? কতগুলোতে খালাস পেয়েছে? কতগুলোতে সাজা কমেছে? দয়াকরে ডেথ রেফারেন্স শাখা থেকে তথ্য চান? আপিল বিভাগের ক্ষেত্রেও একই রকম তথ্য জানা দরকার? তবেই বুঝা যাবে কী করণীয়?’
একজন জজ সাহেব বললেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম রিট করেছেন। বললাম, জি করেছি।’ জজ সাহেব মাথা নারলেন আর বললেন,’ আপনিও চেষ্টা করেন। আমরাও দেখব।’ তারপরের দুই সপ্তাহ হন্যে হয়ে সেকশনে সেকশনে ঘুরেছি। ডেথ রেফারেন্স সেকশনে গিয়েছি। কোন তথ্য দিতে পারল না। বলল, ‘আদালত বললে দিবে। বা তৈরি করে দিবে।’ লুকোচুরি করে। খোলামেলা কথা বলতে চায় না। তবুও বার বার জিজ্ঞাসা করলাম। বুঝলাম তারা এইগুলোকে গোপনীয় তথ্য মনে করে। আমি থেমে গেলাম। পরে শুনলাম জজ সাহেব ডেথ রেফারেন্স শাখার অফিসারকে খাস কামরায় ডেকেছিলেন। আপিল বিভাগের সেকশনে গেলাম। সেখানে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, ‘স্যার, আমার কাছে তেমন কিছুই নাই। এইগুলো রাখার কোন সিস্টেম নাই।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। যা বুঝার বুঝে গেলাম। আপিল বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গেলাম। তিনিও লুকোচুরি করলেন। বুঝাতে চাইলেন এইগুলো গোপনীয় তথ্য। আমি শুধু বললাম, এইগুলো ত ‘Public Information. ‘আর কথা বাড়ালেন না। মুচকি হেসে সালাম দিয়ে চলে আসলাম।
৯। এদিকে রিট আবেদনটি শুনানির জন্য আসল। তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির পক্ষ হয়ে রিট আবেদনটি করা হল। মূল যুক্তি ছিল, ‘আমাদের ত মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হয় নি। আমাদের কেন মৃত্যুর সেলে রাখা হল।’ দেশি-বিদেশি নজির উপস্থাপন করা হল। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণাপত্রের প্রাসঙ্গিক অংশ পড়ে শুনালাম। জজ সাহেব আমার submission শুনে convince মনে হচ্ছিল। কিন্তু লিখিত আদেশ দেন নাই। মৌখিকভাবে কারা মহাঅধিদপ্তর থেকে রিপোর্ট চেয়েছেন। বার বার চেয়েছেন। বাংলাদেশের মাননীয় এটর্নি জেনারেল শুনানি করেছেন। কারা অধিদপ্তর কোন রিপোর্ট আদালতে দায়ের করেনি। সর্বশেষ তারিখ ছিল ফেব্রুয়ারি’২২ মাস। ইতোমধ্যে বেঞ্চ পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি চিন্তিত হয়ে পরলাম। কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আমার এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে গেলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কোর্টগুলো observe করতে লাগলাম।
অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম একটি সিনিয়র কোর্টে যাব। মামলাটি জমা দিলাম। লিস্টে শুনানির জন্য আসল। অতিরিক্ত ভীড় থাকার কারণে আমি আর মেনশন করলাম না। এরই মধ্যে মার্চ মাসের vacation এসে গেল। মনে মনে চিন্তা করলাম বিষয়টি খন্দকার মাহবুব হোসেন স্যারকে বলব। স্যার মেনশন করলে অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। এদিকে স্যারের শরীর ভাল না। তবুও ফোনে স্যারকে খুলে বললাম। স্যার খুব আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আমি যাব। আমি অবশ্যই যাব। তুমি ব্যবস্থা কর।’ বেশ কয়েকদিন পর আপিল বিভাগে একটি আলোচিত মামলা করার জন্য স্যার আসলেন। আমি কাছে বসে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। স্যার ও মেডাম দুইজনই খুব আগ্রহ দেখালেন।
১০। ভেকেশন শেষ হল। আবার কোর্ট পরিবর্তন হয়ে গেল। যে কোর্টে জমা দিয়েছিলাম সেই কোর্টের আর ক্ষমতা থাকল না। আবার চিন্তায় পরে গেলাম। এখন কোথায় যাব? কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করলাম। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে আরেকটি বেঞ্চে জমা দিলাম। পুরানো মামলা হওয়ার কারণে লিষ্টে উপরের দিকে আসল। প্রথম সপ্তাহে হল না। দ্বিতীয় সপ্তাহে হঠাৎ উপরে চলে আসল। আমি অন্য আরেকটি কোর্টে শুনানি করছিলাম। হঠাৎ আমার জুনিয়র সাদ্দাম মেসেজ দিল, ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসেন। দৌড় দিলাম। গিয়ে দেখি আমাদের আইটেম পার হয়ে পরের আইটেম ধরেছে। ঐ আইটেম শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমি মেনশন করলাম। জজ সাহেব আমার আইটেম ডাকতে বললেন। আমি তখনও হাপাচ্ছিলাম। ভাল করে কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু অনুমতি নিলাম, ‘My Lords, kindly allow me few seconds to become stable. I rushed from another court.’ জজ সাহেব বললেন, ‘Take your time.’ ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বস্তিবোধ করলাম। বললাম,’ My Lords, Petitioners are the condemned prisoners who have been awarded death sentence by the trial courts in different criminal proceedings. Their death references are now pending before the High Court Division. As per normal schedule, these will be heard about 5 years later. Their sentences have not been finalized by the Apex Court. However, they have been put to condemned cell from the very day of the judgment of the trial court. It is inhuman and degrading treatment violating article 35 of the constitution. Indian Supreme Court already settled this issue that before finalization of the death sentence, nobody can be put to condemned cell.’
১১। এই introduction এর পর পাতায় পাতায় পড়লাম। রেফারেন্স দেখালাম। আইন দেখালাম। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্ত দেখালাম। জজ সাহেব নানান প্রশ্ন করলেন। সাধ্যমত জবাব দেয়ার চেষ্টা করলাম। মনে হয় তিনি convinced. আমার পর ডেপুটি এর্টনি জেনারেল submission রাখলেন। তিনি কিছু প্রাসঙ্গিক কিছু অপ্রাসঙ্গিক submission রাখলেন। মনে হল জজ সাহেব তার কথায় বেশি সন্তুষ্ট হলেন না। আবার আমাকে ডাকলেন। এইবার খুব ঠান্ডা মাথায় বললাম, ‘My Lords, I do have full respect to the submissions made by my learned senior friend. My humble submission before your Lordships,’
৬ বছর লাগে হাইকোর্টে শুনানি করতে। আপিল বিভাগে শুনানি করতে আর ৮/১০ বছর। তারপর কেউ কেউ খালাসও পায়। তাহলে শুরুর দিন কেন আমাকে death cell এ নিয়ে যাওয়া হবে? খালাস পাওয়ার পর আমার জীবনের সেইদিনগুলি কে ফিরিয়ে দিবে? আমাকে আলাদা করে রাখুক কিন্তু মৃত্যুর সেলে নয়। কারণ আমার মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হয় নি।’ এই কথা বলে সমসাময়িক অনেকগুলো ঘটনা উল্লেখ করলাম। জজ সাহেব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কিছুটা ভরসা পেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি চেয়েছেন?’ বললাম My Lords, আইনটি চ্যালেন্জ করেছি। সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগে কেন মৃত্যুর সেলে রাখা হল সেজন্য রুল চেয়েছি আর কারা মহাঅধিদপ্তর থেকে রিপোর্ট চেয়েছি।’
জজ সাহেব বললেন, ‘বসেন।’ সরকার পক্ষ উঠে বললেন, ‘My Lords, বিজ্ঞ এটর্নি জেনারেল আসবেন। একটু সময় দেন।’ জজ সাহেব তাকেও বসতে বললেন। আদেশ দিলেন, ‘Yes. Rule in terms of Supplementary Affidavit and the Substantive prayer and the interim order in terms of submission of the report within 6 months.’ আমি মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম।
১২। এই মামলার সাথে জড়িয়ে আছে হাজারও বন্দীর হাহাকার। তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্হ্যের বিকাশ। জানি না কত নিরপরাধ মানুষ বছরের পর বছর মৃত্যুর সেলে বন্দি আছে। যিনি অপরাধ করেছেন আইন অনুযায়ী তার সাজা হবে। তবে বিচারের আগেই কাউকে সাজা দিয়ে দেয়া কাম্য নয়। হতে পারে না। ইনশাআল্লাহ একদিন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই।