হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী ও আহসান হাবিব
বর্ষণ-পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মঙ্গলবার (১৭ মে) দুপুরে। বিভাগের প্রধান নদী সুরমা, কুশিয়ারা বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের ৬টি ও সুনামগঞ্জের ৬টি মোট ১২টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
দেখা গেছে, সিলেট শহরের নিকট সুরমার পানি বিপদসীমার উপরে। পানি উপচে শহরের অভিজাত এলাকা উপশহরে পানি ঢুকছে। এছাড়া তালতলা, কুশিঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় হু-হু করে পানি ঢুকছে। শহরের ড্রেন ও নালা, ছড়া দিয়ে পানি সুরমায় প্রবাহিত হচ্ছে না। কাজীর বাজারের কাছের নালাসহ বিভিন্ন নালা দিয়ে এখন সুরমার পানি শহরে ঢুকে সয়লাব। অনেকের বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে রান্নাবান্না বন্ধ। গ্রামীণ সড়ক এমনকি জেলা সদরের সাথে উপজেলা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জের, ছাতক, তাহিরপুরের অবস্থাও সূচনীয়।
ছাতক-সিলেট সড়ক ও তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ এবং সিলেটের সাথে কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাটের সড়কে যান চলাচল বন্ধ। প্রায় স্থানে জীবনযাত্রা অচল। দুই জেলায় অন্তত: দুলাখ লোক পানি বন্দী। অনেকেই কাটা ধান শুকাতে পারেননি। আবার হাওর বহির্ভূত জমি থেকে ব্রিধান-২৯ কেটে আনতে পারেননি।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৩৬৯ মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সকাল ৯টায় জানিয়েছে, বৃষ্টি কম হলেও প্রায় নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে উজান থেকে নেমে আসা ঢল। ভারতের মেঘালয়, ত্রিপুরা ও আসাম প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাস্তাঘাট তালিয়ে যাচ্ছে
এদিকে ক্রমেই গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পাঠদান বন্ধ। ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। সিলেটের সাথে কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাটের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রবিবার থেকেই। কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও সুরমা ডাইকের গৌরিপুর-কুওরঘড়ি এলাকায় ৬টি ভাঙ্গন কবলিত পয়েন্ট দিয়ে তীব্র গতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক বাড়ি-ঘর ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে হয়ে পড়েছে। মাঠ ও গোচারণ ভূমিতে পানি উঠায় গো-খাদ্য সংকটসহ মৎস্য খামারিরাও চরম শঙ্কায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যায় সুরমার পানি সিলেটের কানাইঘাটে বিপদসীমার ১ দশমিক ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিলেটে সুরমা ১০ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারার পানি অমলশীদে বিপদসীমার ১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার ও শেওলায় দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার, সারি-গোয়াইন নদীর পানি সারিঘাটে বিপদসীমার দশমিক ৮২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, সিলেটে বৃষ্টিপাত অনেকটা কমে এসেছে। তবে ২১ মে পর্যন্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
ছাতকে থৈ-থৈ পানি
টানা এক সপ্তাহ’র বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ছাতকের সবত্রই বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে উঁচু জমিতে ক্ষেত করা কয়েক শত একর বোরো ফসল। এখানে এখন বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ছাতকে সুরমা, পিয়াইন, চেলা নদীসহ সকল নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি এখানে ব্যাপক আকার ধারণ করছে। ইতিমধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে এখানের বহু রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বীজতলা, উঁচু জমির বোরো ফসল। পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। শহরের নিচু এলাকার বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার।সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে ব্যাপক হারে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ছাতক শহরের সকল ক্রাশার মিল বন্ধ। নদীতে কার্গো লোডিং আন লোডিং বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে শত শত শ্রমিকরা এক সপ্তাহ ধরে বেকার হয়ে পড়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে- মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে উপজেলা সদরের সাথে ইসলামপুর, চরমহলা, ভাতগাঁও, সিংচাপইড়সহ ৭টি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মামুনুর রহমান জানান, ছাতকে জনসাধারণকে আগেই সতর্ক করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে বলে ছাতক সংবাদদাতা আবদুল আলিম জানিয়েছেন।
কানাইঘাটে ৬টি ভাঙ্গন, জৈন্তাপুরে গবাধি পশু নিয়ে মানুষ বিপাকে
কানাইঘটের সুরমা ডাইকের গৌরিপুর-কুওরঘড়ি এলাকায় ৬টি ভাঙ্গন কবলিত পয়েন্ট দিয়ে তীব্র গতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুমিন চৌধুরী ও নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন্ত ব্যানার্জি বন্যা কবলিত দক্ষিণ বাণীগ্রাম, ঝিঙ্গাবাড়ী ও রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকা সুরমা নদী যোগে পরিদর্শন করেন। বন্যায় মৎস্য খামার ও গবাদিপশুর খামারসহ অন্যান্য কৃষি সেক্টরের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জৈন্তাপুরে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার চার ইউনিয়ন বন্যায় পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। অব্যাহত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নিজপাট, জৈন্তাপুর, চারিকাটা ও দরবস্ত ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় আটকে পড়া লোকজন গৃহপালিত পশু নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ফখরুল ইসলাম জানান, জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। দরবস্ত চতুল রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে বন্যা কবলিতদের জন্য শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে ১২ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
গোয়াইঘাটে ৪ লাখ জনগোষ্ঠী বিপাকে, কোম্পানীগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
গোয়াইনঘাটে গত শনিবার রাত থেকে সারি ও ডাউকি নদী দিয়ে নেমে আসা পানিতে গোয়াইনঘাট উপজেলা সর্বত্র তলিয়ে গেছে। বিপদসীমার উপরে সারি ও ডাউকি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট শহরের সাথে উপজেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উপজেলা সদরের সাথে ১২টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লাখ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত। শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি চরম গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে শ্রমিকরা কাজে যেতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোম্পানীগঞ্জে ঢলে উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামীণ অনেক রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আউশধানের বীজতলা ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল। অনেক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম ইত্তেফাককে জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর জেলা প্রশাসনের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। রবিবার পর্যন্ত বন্যার্তদের জন্য ১০৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কানাইঘাট উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পৌর শহরসহ আশপাশ এলাকায় কিছুটা পানি কমলেও হাওর ও সমতল এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে।