সাহিত্য আমার হৃদয়ের তৃষ্ণা মিটায় – ড. মাহফুজ

জীবনী-সাক্ষাৎকার
শেয়ার করুন

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছড়াকার, কবি, গবেষক এবং সাহিত্য সমালোচক। ছড়া-লিমেরিক, কবিতা এবং গবেষণাগ্রন্থসহ মোট তেইশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সেইসাথে বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বসাহিত্যের মহানায়কদের নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধও তিনি লিখে চলেছেন। নিখাদ শিশুতোষ ছড়া রচনায় তাঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়। বিষয়ের বৈচিত্র্য, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপকের ব্যবহার এবং ছন্দের কারূকাজে তাঁর কবিতাও হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় এবং শিল্পমানে সমৃদ্ধ। পেশাগত জীবনে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর। গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মোজাফফর রহমান আখন্দ এবং মাতার নাম মর্জিনা বেগম। তিনি ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্টক্লাশ ফার্স্ট হয়ে এম. এ করেছেন; অতঃপর ২০০০ সালে এম. ফিল এবং ২০০৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। রোহিঙ্গা ও আরাকান তাঁর গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয়। ভালো সংগঠক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি ইয়াসিন মাহমুদ।

সময়: আপনি সাহিত্যচর্চা করেন কেন? এটা কি শুধু শিল্প না দায়বদ্ধতাও?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: সাহিত্য আমার হৃদয়ের খাদ্য। ক্ষুধা তৃষ্ণার সময় খাবার-পানীয় যেমন আপনাকে তৃপ্তি দেয়, তেমনি সাহিত্যও আমার হৃদয়ের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটায়। কখনো শিল্পবোধের আকর্ষণ আবার কখনো সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাকে ক্ষুধার্ত করে তোলে। সেই অভাব পূরণে আমি ছুটে যাই সাহিত্যের দুয়ারে; সে আমাকে ভীষণভাবে তৃপ্তির সন্ধান দেয়।

সময়: আপনার প্রথম প্রকাশিত লেখা এবং তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: ১৯৮৭ সালে ছাপার অক্ষরে ছড়া প্রকাশের মধ্যদিয়েই মূলত সাহিত্যের অঙ্গনে পথচলা। সে এক অন্যরকম অনুভুতি। পত্রিকায় লেখা পাঠনোর পর আর ঘুম আসে না। চোখ বুজলেই নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে এসে নতুন কল্পনার জগৎ তৈরি করে দিয়ে যায়। মনটা পাখির মতো উড়তে থাকে উন্মুক্ত আকাশে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুঁজতাম; অনেককেই বলে রাখতাম আমার লেখা ছাপা হবে। লেখা ছাপার পরে মনে হলো, আমি বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। অনুভূতিটা আমি এভাবে বলতে চাই:

পয়লা পিরিত পয়লা শিশু পয়লা লেখা ছাপা
বুকের ভেতর কালবোশেখী যায় কখনো মাপা?

সময়:
গবেষণা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সমন্বয় করেন কিভাবে?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: ইতিহাস অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান আমার পেশাগত দায়িত্ব। ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি একটা আলাদা টান ছিল। সেটা এখন গভীর প্রেমে রূপলাভ করেছে। দুটো কাজের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। আমি অবশ্য এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। যখন যে কাজে বসি আমি নিজেকে তখন সেই রঙে রাঙিয়ে নেই।সময়: বর্তমান ছড়া ও লিমেরিক চর্চার গতি-প্রকৃতি কেমন মনে হচ্ছে?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: এককথায় খারাপ না। নানাজনের নানা মত থাকলেও আমি মনে করি ছড়াচর্চা এখন সকল সময়ের চেয়ে তুঙ্গে। নানা ঢঙে যেমন ছড়া লিখা হচ্ছে তেমনি ছড়াকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ছড়া বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ এবং ছোট কাগজের প্রকাশনাও বেশ চোখে পড়ার মতো। মূলত প্রেক্ষাপট ছড়াচর্চার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও ছড়া একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তবে হতাশার দিক হলো, অধিকাংশ লেখক লেখাপড়া না করেই মিডিয়ার কল্যাণে অতি সস্তায় ছড়াকার হয়ে উঠতে পছন্দ করছেন; এটা শুধু ছড়াচর্চা নয়, বাংলা সাহিত্যের জন্যও খুব আশংকার দিক।

সময়: বাংলা সাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কে? তাঁর কোন সৃষ্টির কারণে তিনি আপনার প্রিয় লেখক?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: প্রিয় লেখক অনেকেই। সময়ের ব্যবধানে এ তালিকা নামের আগপিছ হয়ে যায়। এক সময় শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের অন্ধভক্ত ছিলাম। বিশেষকরে তার দেবদাস এবং শ্রীকান্ত আমাকে বহুবার পড়তে হয়েছে। পরীক্ষার রাতেও চুরি করে তার বই পড়েছি। নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের আনোয়ারা আমাকে মুগ্ধ করেছে, ডা. লুৎফর রহমানকে পড়তাম খুব। তার মহৎ জীবন, উন্নত জীবন, ধর্মজীবন প্রভৃতি বইগুলো আমাকে আলো-আঁধার চিনতে সাহায্য করেছে। পরবর্তীতে ডিটেকটিভ উপন্যাস বিশেষকরে রোমেনা আফাজের দস্যুবনহুর, কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজ এবং আবুল আসাদের সাইমুম সিরিজ গিলতাম গোগ্রাসে। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ছড়া-কবিতা, কাজী নজরুল ইসলামের শিশুতোষ ছড়া ও কিশোর কবিতা, জীবনানন্দ দাসের অদ্ভুত উপমা শোভিত কবিতা, জসীমউদ্দীন এর পল্লীবাংলার নিখাদ চিত্রায়ণের অন্ত্যমিল কবিতা, ফররুখ আহমদ এর শিশুতোষ ছড়া এবং ঐতিহ্যবাদী কাব্যসম্ভার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শাহেদ আলীর গল্পের অদ্ভুত গাঁথুনি, আল মাহমুদ এর সোনালী কাবিন থেকে শুরু করে শিশুশতোষ ছড়া, মতিউর রহমান মল্লিকের সবুজাভ কাব্যভান্ডার এবং আধুনিককালের অগ্রজ, বন্ধুপ্রতীম এবং অনুজদের অনেকের লেখাই আমার খুব উপভোগ্য।

সময়: আপনি প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে থাকেন, একজন কবির জন্য গদ্য লেখা জরুরি কি?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: একজন লেখকের জন্য প্রবন্ধ লেখা অবশ্যই জরুরি। প্রবন্ধ না লিখলে নিজেকে লেখক ভাবাই কঠিন। কারণ প্রবন্ধ লেখার জন্যে প্রচুর স্টাডি দরকার হয়। আর পড়া যত বেশি হবে কবিতা বলুন আর অন্য যে কোন লেখা বলুন ততো মানসম্পন্ন হবে। তাছাড়া কবিদের প্রবন্ধ অনেকটা ঝরঝরে ও মজাদার হয়। এজন্য কবিদের বিশেষ করে আধুনিক কবি ও কবিতা নিয়ে বেশি বেশি প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখা উচিৎ। প্রবন্ধ লিখার উসিলায় অগ্রজ-অনুজ এবং সমকালীন লেখকদের লেখা সম্পর্কে একটা মৌলিক ধারণা লাভ করা সহজতর হয়।

সময়: আপনি গান লিখে থাকেন। গানে সাহিত্যিক মূল্যবোধ কতটা জরুরি?

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: গান আমার অন্যতম প্রিয় বিষয়। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে এখন ব্যাপক ভাটা পড়লেও শোনার নদীতে জোয়ার আগের মতোই। লেখারও চেষ্টা করি। গান শুধু গান নয়, মূলত এটি গীতি কবিতা। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতে সাহিত্যিক মূল্যবোধ প্রখর বলেই সেগুলো অমর। সুতরাং গানকে বেঁচে রাখতে হলে এর সাহিত্যিক মূল্য একান্ত জরুরি।

সময়: পাঠকদের প্রতি আপনার কোন বক্তব্য থাকলে বলুন!

মাহফুজুর রহমান আখন্দ: সবই তো পাঠকদের উদ্দেশ্যেই; তবু স্পেশাল কথা, আসুন দেশকে ভালবাসি, পৃথিবীকে আগামী প্রজন্মের জন্য কিছুটা হলেও সুন্দর করে রেখে যাবার চেষ্টা করি। ‘বৈরি হাওয়ার ভয় কাটেনি ঊথাল পাথাল নদী/ভিড়বে তবু জীবনতরী স্বপ্ন থাকে যদি’। স্বপ্নকে ঘিরে আমরা সবাই ভালো থাকি, নিরাপদে থাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *