বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমকে গাড়ি চাপা দিয়ে ‘হত্যাচেষ্টার অভিযোগের দাবি’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানা আলোচনা দেখা যাচ্ছে। বুধবার দু’জনই তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এ নিয়ে পোস্ট করেছেন। নিজেদেরকে “শহীদ আবরার এবং আলিফের উত্তরসূরি” উল্লেখ করে তারা লেখেন, “মারবা? পারবা না…মনে রেখো– শহীদেরা মরে না।”
তাদের এই পোস্ট দ্রুতই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্য সমন্বয়করাও তা শেয়ার করেন। বুধবার রাতেই “হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছবিসমেত আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন মি. মাসউদ। তিনি দাবি করেন যে হাসনাত আবদুল্লাহকে “আরেকবার” ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পরে সারজিস আলমও ফেসবুকে লেখেন যে “কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসার পথে হাসনাতের গাড়িতে পিছন থেকে আবার অন্য গাড়ি দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
ঢাকার ওয়ারী থানা সূত্রে জানা গেছে মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামতে কাপ্তান বাজারের মুখে হাসনাতকে বহনকারী গাড়িটিকে আরেকটি গাড়ি ধাক্কা দেয় বলে তারা জানতে পেরেছেন। তবে, এ ঘটনায় কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা হয়নি বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
সমন্বয়করা হত্যাচেষ্টার দাবি কেন করছেন? কেন-ই বা এ নিয়ে এত কথা হচ্ছে? বুধবার কী ঘটেছিল?
সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে ঘিরে সংঘর্ষে গত মঙ্গলবার ২৬শে নভেম্বর চট্টগ্রামে নিহত হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। কাজ শেষে আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পথে এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মি. ইসলাম। নিহত এই আইনজীবীর বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ফারাঙ্গাতে। জানাজা শেষে তাকে সেখানেই তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেকেই চট্টগ্রামের জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে তাদের প্রায় ১৫ জন চট্টগ্রাম থেকে চুনতির ফারাঙ্গা এলাকায়ও যান। চট্টগ্রাম থেকে তিনটি গাড়িতে করে মি. ইসলামের বাড়িতে গিয়েছিলেন সারজিস-হাসনাতরা।
গতকালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সারজিস আলমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের গাড়ি তিনটির একটি ছিল স্থানীয় আয়োজকদের, একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজকদের এবং আরেকটি গাড়ি মূলত ঢাকা থেকে গিয়েছিলো। “দাফন-কাফন শেষ করে সাতটার দিকে লোহাগড়া থেকে ফিরছিলাম আমরা,” বলছিলেন মি. আলম। “যাওয়ার সময় আমাদের (ঢাকা থেকে নেওয়া) গাড়িটি সামনে ছিল। কিন্তু আসার সময় আমরা ভাবলাম মাঝে (অন্য গাড়িতে) যাই। কিছুক্ষণ পর চুনতি হাজী রাস্তার মাথা এলাকায় সড়ক ক্রসিং-এর সময় ট্রাকের সাথে আমাদের সামনের গাড়ির ধাক্কা লাগে,” যোগ করেন তিনি।
মি. আলম নিজেই বলছিলেন যে ট্রাকের ধাক্কায় যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। কারণ গাড়ির চালক দ্রুততার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। “নইলে একটা ট্রাকের ধাক্কায় গাড়ির অস্তিত্ব টিকে থাকা কথা না,” বলেন তিনি। গাড়ি দুর্ঘটনার পর যেসব ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে দেখা গেছে যে গাড়ির সামনে বামদিকের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই গাড়িটিই ঢাকা থেকে গিয়েছিলো। কিন্তু ফেরার পথে তাদের ওই গাড়িতে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করা।
তারপর কী হলো?
দুর্ঘটনার পর ওই ট্রাক চালক আহমেদ নেওয়াজকে ঘিরে ফেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে লোহাগাড়া থানার পুলিশের কাছে তাকে সোপর্দ করা হয়েছে।
থানায় গিয়ে এ বিষয়ে প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার কথা জানান মি.আলম। পরে তদন্তের সুবিধার্থে মামলা করা হয়। লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন যে গতকাল রাতেই তারা ট্রাক ড্রাইভার মুজিবুর রহমান ও হেল্পার মোহাম্মদ রিফাত মিয়াকে আটক করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে তাদেরকে আজই আদালতে তোলা হবে, বলছিলেন তিনি।
মি. রহমানের কাছে জানতে যাওয়া হয়েছিলো যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কী মনে হয়েছে? তিনি উত্তরে জানিয়েছেন, মামলাটি সড়ক পরিবহন আইনে করা হয়েছে। এটি সড়ক দুর্ঘটনা হলেও এখানে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না, সে বিষয়ে এখনও কিছু নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি “তদন্তাধীন” বলে মন্তব্য করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
কেন সন্দেহ করছেন সারজিসরা?
এটি তো সাধারণ দুর্ঘটনাও হতে পারে। কেন তারা সন্দেহ করছেন? সারজিস আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো। “আমরা প্রথমে সন্দেহ করিনি। আমরা প্রথমে ওনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। কিন্তু তখন কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি বলে সন্দেহজনক মনে হয়। উনি বলছিলো, উনি জিনিসপত্র আনলোড করার জন্য এনেছিলো। কিন্তু কোনও নথিপত্র ওনার কাছে নাই। মালিকপক্ষের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে বিদেশে থাকে,” বলছিলেন মি. আলম।
“তাকে বললাম– মালিক ছাড়া তো আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না, আপনার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; কারণ শিক্ষার্থীরা এই গাড়ি ভাড়া নিয়ে এসেছে; এটি শিক্ষার্থীদেরও গাড়ি না; এই ক্ষতিপূরণ তো শিক্ষার্থীরা দিতে পারবে না। আমরা চাচ্ছিলাম যে এটি সহজে শেষ করে ফেলা যায়।” কিন্তু “তখন উনি আবার বললেন– মালিক জেলে আছে,” বলছিলেন সারজিস আলম।
“তখন তাকে প্রশ্ন করতে করতে পাওয়া গেল, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একটি হত্যা মামলার আসামি হিসাবে জেলে আছে ট্রাকের মালিক। তখন বিষয়টিকে সন্দেহজনক লাগে। পরে জিডি করি। কিন্তু জিডিতে তদন্ত করা যায় না। পরে মামলা দেই। এখানে ওনার সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।” ট্রাক মালিকের বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু জানতে পেরেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আলম বলেন, “জুলাই অভ্যূত্থানের মামলায় আসামীর ব্যাকগ্রাউন্ড তো আওয়ামী লীগই।”
লোহাগাড়া থানার ওসি আরিফুর রহমান নিশ্চিত করেছেন যে সারজিস-হাসনাতদের গাড়িতে ধাক্কা দেওয়া ট্রাকের মালিকের নামে একটি “রাজনৈতিক মামলা আছে”। সেই মামলায় গত ২৮শে অক্টোবর থেকে তিনি কারাগারে। “আমরা যে গাড়িতে ছিলাম, সেটার সাথেই এটি হয়েছে,” উল্লেখ করে সারজিস আলম বলেন যে তারা প্রতিনিয়ত রিকশা বা সিএনজিতে করে চলাফেরা করেন। গাড়িতে মাঝে মাঝে চড়েন। তাই, তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়াটা “গুরুত্বপূর্ণ।” – বিবিসি বাংলা