আধুনিক খাদ্যবিজ্ঞানের পুরোটাই খাবারের গুণাগুণ আর প্রয়োগ সম্পর্কিত। খাবার শক্তি জোগায়। তাই খাদ্যবিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়েই খাবার গ্রহণ করতে হবে। খাবার নির্বাচন কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে, যেমন বয়স; আজকে যে মানুষটি জন্মগ্রহণ করল তার খাবারের ধরন আর একজন যুবক ও বৃদ্ধের খাবার কখনো এক নয়। দুধ শিশুদের আদর্শ খাবার হলেও বড়দের জন্য নয়। খাওয়ার মূল প্রেরণা অবশ্যই ক্ষুধা আর তা নিবৃত্ত হয় খাবার খেয়ে তৃপ্ত হলে। সুতরাং, ক্ষুধা এবং তৃপ্তি আমাদের খাবার পছন্দের মৌলিক নির্ধারক। খাবারে সর্বনিম্ন তৃপ্তির ক্ষমতা ফ্যাটের, তার চেয়ে বেশি কার্বোহাইড্রেটের, সবচেয়ে বেশি প্রোটিনের।
সামাজিক প্রথা: সামাজিক নির্ধারক যেমনÑ খাদ্য সংস্কৃতি, পরিবারিক রীতি, সহকর্মীদের পছন্দ এবং খাবারের ধরন ইত্যাদি। শারীরিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও রোগের ধরন খাবার বাছাইয়ে ভ‚মিকা রাখে।
খাবারের মূল্য : খাদ্যমূল্য এবং রোগীর সামাজিক অবস্থানের ওপর খাবারের পছন্দ নির্ভর করে। ধর্মীয় ও জাতিগত বিধিনিষেধ : ইসলামে শূকর হারাম। ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মে তা হালাল। চীনে এমন ধরনের প্রাণী জনগণের পছন্দের তালিকায় আছে যা অন্য কোনো দেশে নেই। পেশার ধরন : যত বেশি কায়িক পরিশ্রম, তত বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার দরকার।
রাসূলের খাবার নিয়ম
মহানবী সা:-এর খাদ্যাভ্যাস ছিল বর্তমান সময়ের ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং তুল্য : বর্তমান যুগের চিকিৎসকরা ওজন কমাতে, রোগমুক্ত থাকতে কম খেতে বলেন। আর মহানবী সা: নিজেও কম খেতেন এবং কম খেতে বলতেন। একবার রাসূল সা:-এর কাছে একজন অবিশ্বাসী ব্যক্তি এলো। তিনি তার মেহমানদারি করলেন বকরির দুধ দিয়ে। সেই অবিশ্বাসী একে একে সাতটি বকরির দুধ খেয়ে ফেলল। রাসূল সা: ভদ্রতার খাতিরে শুধু মেহমানদারিই করে গেলেন। পরের দিন সে লোক ইসলাম কবুল করল। রাসূল সা: আবার বকরির দুধ দিয়ে আপ্যায়িত করলেন কিন্তু মাত্র একটি বকরির দুধ পান করলেন। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মুমিন খায় এক পেটে আর কাফেররা খায় সাত পেটে’। (মুসলিম-৫২৩৪)
তিনি নবী করিম সা: খাবারের অপচয় পছন্দ করতেন না। শুধু কম খেতেন বললে কম বলা হবে। বরং প্রায়ই তাঁকে না খেয়ে থাকতে হতো। তবুও তিনি সপ্তাহে দু’দিন (সোম-বৃহস্পতিবার) রোজা রাখতেন।
এখন আমরা জানি, শাকসবজি অতি উত্তম খাবার, যাতে আছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, উপকারী খাদ্যোপাদান ডায়েটারি ফাইবার বা আঁশ। রাসূল সা: শাকসবজি পছন্দ করতেন। তার প্রমাণ হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে পাই। তিনি বলেন, একবার একজন দর্জি রাসূল সা:কে খাবারের দাওয়াত করেন। আমিও মহানবী সা:-এর সাথে সেই খাবারে অংশগ্রহণ করি। রাসূল সা:-এর সামনে বার্লির রুটি এবং গোশতের টুকরা ও লাউ মেশানো ঝোল পরিবেশন করা হয়। আমি দেখেছি, রাসূল সা: প্লেট থেকে খুঁজে খুঁজে লাউ নিয়ে খাচ্ছেন। আর আমিও সেদিন থেকে লাউয়ের প্রতি প্রীত হয়ে উঠি।’ (মুসলিম-২০৬১, বুখারি-৫০৬৪)
‘আমি রাসূল সা:কে তাজা খেজুরের সাথে শসা মিশিয়ে খেতে দেখেছি।’ (আবদুুল্লাহ ইবনে জাফর রা: বর্ণিত ইবনে মাজাহ)
লাউয়ে আছে ভিটামিন-এ ও বি কমপ্লেক্স, সি-সহ আছে ফলিক অ্যাসিড, ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড। এ ছাড়া ১০০ গ্রাম লাউয়ে জলীয় অংশের পরিমাণ ৯৬ দশমিক ১০ গ্রাম, আঁশ শূন্য দশমিক ৬ গ্রাম, আমিষ শূন্য দশমিক ২ গ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ১ গ্রাম, শর্করা ২ দশমিক ৫ গ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ১২ কিলোক্যালরি। লাউ খেলে মোটা হওয়ার আশঙ্কা নেই।
আমরা জানি, শর্করা জাতীয় খাবার সবজি মিশিয়ে খাওয়া উত্তম। কারণ এতে ভিটামিন, মিনারেল ও ডায়েটারি ফাইবার থাকে এবং এর কারণে খাবার হজম হতে সময় নেয়, হঠাৎ রক্তের গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে যায় না। রাসূল সা: তাই করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাফর রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, ‘নবী সা: খেজুরের সাথে শসা খেতেন’। (তিরমিজি-১৭৯৩)
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিতÑ ‘নবী করিম সা: তাজা খেজুরের সাথে একত্রে তরমুজ খেতেন’। (তিরমিজি-১৭৯২)
শর্করার সাথে সবজি মিশিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকর কিন্তু দু’টি দুই রকম পরিপক্ব শর্করা একসাথে মিশিয়ে খাওয়া অস্বাস্থ্যকর। কারণ এতে রক্তে গ্লুকোজ লেভেল দ্রæত বেড়ে যায়। রাসূল সা: দু’টি শর্করা জাতীয় খাবার একত্রে মিশিয়ে খেতে নিষধ করেছেন।
আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিতÑ ‘নবী করিম সা: কিশমিশ ও খেজুর একত্রে মেশাতে নিষেধ করেছেন’। (তিরমিজি-১৮২৫) এই সমস্ত নিষেধ করার কারণ হলো, এগুলো এভাবে মেশালে তা নেশাজাতীয় দ্রব্যে পরিণত হতে পারে।
নবী করিম সা: চাইলে সারা জীবন ঘরে বসে আরাম করে সাহাবিদের শুধু নির্দেশ দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের কাজকর্ম নিজে করতেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তিনি ছিলেন ওই সময়ের সবচেয়ে পরিশ্রমী একজন আদর্শ মানুষ। কম খাওয়া, নিয়মিত সাপ্তাহিক দু’দিন রোজা রাখা, কায়িক পরিশ্রম, দীর্ঘ সফর-যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি নানাবিধ কর্মতৎপরতার কারণে তিনি চিরজীবনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, যা বর্তমান স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য। রাসূল সা: তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ডে উম্মতের জন্য রেখে গেছেন মানসিক এবং শারীরিকভাবে সর্বাধিক সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকার উজ্জ্বল আদর্শ।
শরীর সুস্থ রাখতে কায়িক শ্রমের কথা চিকিৎসকরা বলে থাকেন। সুস্থ থাকা, ওজন কমানো, ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকা, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যান্সারসহ অন্য অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং, ফ্যাট এডাপ্টেশন এবং নিয়মিত শরীরচর্চার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অথচ এই সমস্ত কাজই রাসূল সা: বাস্তব জীবনে বাস্তবায়ন করে আমাদের জন্য এক জ্বলন্ত আদর্শ রেখে গেছেন।
পেট ভরে খাবার খাওয়ার অভ্যাস তার কখনো ছিল না। পেটের একভাগ খাবার, একভাগ পানি ও আরেক ভাগ খালি রাখার পরামর্শ মহানবী সা: বহু আগেই দিয়ে গেছেন। ভালো ডায়েটে আজকাল যা করতে বলা হয়, তার প্রায় সবটাই নবীজী সা:-এর খাদ্যাভ্যাসে বিদ্যমান ছিল। নবী সা: কিছু খাবার খেতে পছন্দ করতেন। এর মানে এই নয় যে, খাবার সামনে পেলেই পেট পুরে খেতেন। ওই খাবারগুলোকে প্রাধান্য দিতেন, কিন্তু কমই খেতেন। মহানবী সা: খেজুর খেতেন। খেজুর তার প্রিয় ছিল। এমনকি প্রসূতি মাকেও খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। খেজুরে রয়েছে ক্যালসিয়াম, সালফার, আয়রন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ফলিক অ্যাসিড, আমিষ ও শর্করা। তাই ডায়েটে উত্তম নাশতা হলো দু’চারটি খেজুর খেয়ে নেয়া।
নবীজী সা: দুধ খেতেন। আনাস রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘মিরাজের রাতে বায়তুল মাকদিসে আমি দুই রাকাত নামাজ পড়ে বের হলে জিবরাইল আ: আমার সম্মুখে শরাব ও দুধের আলাদা দু’টি পাত্র রাখেন। আমি দুধের পাত্রটি নির্বাচন করি। জিবরাইল আ: বললেন, ‘আপনি প্রকৃত ও স্বভাবজাত জিনিস নির্বাচন করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস-৩১৬৪, তিরমিজি, হাদিস-২১৩)
গরুর দুধে আছে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কোবাল্ট, কপার, জিঙ্ক, আয়োডিন ও সেলেনিয়াম। গরুর দুধ সব পুষ্টির আধার ও শক্তির উৎস। ডায়েটে দুধ খেতে বলা হয়। বয়স্কদের জন্য প্রতিদিন দুধ খাওয়া খুব প্রয়োজন। বিশ্বনবী সা: মধু খেতে পছন্দ করতেন। হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘মধু হলো উত্তম ওষুধ’। (বুখারি, হাদিস-৫৩৫৯)
মধুর উপকারিতা বর্ণনাতীত। পবিত্র কুরআনে নাহল (মানে মৌমাছি) নামে একটি সূরা রয়েছে। মধু খেলে শুধু যে উপকার হয়, তা নয়। মৌমাছির জীবনচক্র জানলে বিস্মিত হতে হয়। আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের প্রতি ঈমান বাড়ে। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা আসে।
অনেক সময় আমরা যেনতেনভাবে খাবার খেয়ে ফেলি। কিন্তু খাওয়ারও কিছু আদব আছে। হেলান দিয়ে কিছু খাওয়া উচিত না। নবীজী হেলান দিয়ে খেতে নিষেধ করছেন। নবী করিম সা: বালিশে বিশ্রাম নেয়া অবস্থায় খাবার খেতেন না। (বুখারি)
দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়া ও পানি পান করা ঠিক নয়। চিকিৎসকরাও এভাবে খেতে নিষেধ করেন। দাঁড়িয়ে খেলে পাকস্থলীর ওপর চাপ পড়ে। এতে পাকস্থলীর ক্ষত, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বাড়ে, কিডনি পানি শোষণ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূল সা: দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম, হাদিস-৫০১৭)
ধীরে-সুস্থে খাওয়া সুন্নত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। তাতে খাবার ভালো করে চিবানো হয়। মুখের লালা খাদ্যের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারে। হজম সহজতর হয়। রাসূল সা: ধীরে-সুস্থে খেতেন। একসাথে বেশি খাবার মুখে দিতেন না।
খাবার পর মিষ্টি খাওয়া সুন্নত কি?
কিছু ছিল কমন খাবার যা তৎকালীন আরবে সহজলভ্য ছিল, তা তিনি খেতেন সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের যে খাবার খেতেন, তিনি সে খাবারই একা না খেয়ে সবার সাথে ভাগাভাগি করে খেতেন। এমন কোনো প্রমাণ এখনো পর্যন্ত ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়নি যে, বিশেষ ধরনের খাবার যা স্থানীয়ভাবে দুর্লভ, তা অর্ডার দিয়ে বেশি টাকা দিয়ে কিনে আনিয়ে খেতেন একাই। বরং মদিনায় থাকাকালীন সময়ে আসহাবে সুফফারা যারা মদজিদে নববীর সন্নিকটেই বসবাস করতেন, কোনো খাবার রাসুলের কাছে এলে তিনি পরিমাণ যাই থাকুক তাদেরকে দিয়েই ভাগাভাগি করে খেতেন।
রাসূল সা: বাসি খাবার পছন্দ করতেন না। খাবার নষ্ট করা খুব অপছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, খাবারের কোনো অংশে বরকত আছে আমরা জানি না। সুতরাং খাবার একেবারে শেষ করে খেতে হবে, অবশিষ্ট রাখা যাবে না।’ খেজুর, মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দ করতেন কিন্তু যা খাবার সামনে পেতেন তা খেতেন।
মাদানি জিন্দেগির ছয় বছর নতুন রাষ্ট্র গঠন এবং অনবরত যুদ্ধবিগ্রহের কারণে খাবারের সঙ্কট ছিল। রাসূল সা: খাশির গোশত বিশেষ করে পায়ের গোশত পছন্দ করতেন। উটের গোশত, দুধ, মধু ভালো খেতেন। খরগোশ, রাজহাস, তিমি মাছ জাতীয় সামুদ্রিক মাছও খাবার কথা ইতিহাসে আছে। সব খাবারই তিনি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতেন। তিনি শুধু খাবার কম খেতেন তাই নয়, বরং তাঁর পেটের এক ভাগ খাবার, একভাগ পানি এবং এক ভাগের মতো খালি থাকত। পশ্চিমারা কম খাবারের এই ফর্মুলাটা পুরোপুরিই মানে, কিন্তু আমরা মানি না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা মধুর উপকারিতার কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। আর হাদিসে রাসূল সা: কালিজিরার গুণাগুণ সম্পর্কে বলেছেন স্পষ্ট করেই। তিনি বলেছেন, কালিজিরার মধ্যে সব রোগের প্রতিষেধক রয়েছে, মৃত্যু রোগ ছাড়া। ভিনেগার বা শিরকা জাতীয় পানীয় খেতেন। বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য যেমন মদ, আমাদের জন্য তেমনি শিরকা। তিনি বলতেন, অবিশ্বাসীরা শূকর খায়, ঈমানদাররা তার পরিবর্তে খাশি খায়। মাখন, ঘি এবং খেজুরের মিক্সারে একটা খাবার তিনি খেতেন। মিষ্টি খেতেন সহজলভ্য হলে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি শেরবাংলা নগর, ঢাকা।