রূপকথার গল্পে আছে, এক দুষ্ট দৈত্য এক রাজ্য থেকে জনৈকা রাজকন্যাকে চুরি করে নিয়ে যায়। সে তাকে এক পাহাড়ের গুহায় বন্দী করে রাখে। রাজকন্যার পিতা অর্থাৎ রাজা তার প্রিয় কন্যাকে দুষ্ট দৈত্যের কবল থেকে উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। কারণ দৈত্যটি ছিলো অত্যন্ত শক্তিশালী। দৈত্যকে ধ্বংস করে কন্যাক উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে রাজা শেষে ঘোষণা করেন, যে সাহসী পুরুষ তার কন্যাকে উদ্ধার করতে পারবে, তিনি তার সাথে রাজকন্যার বিয়ে দেবেন এবং অর্ধেক রাজত্ব প্রদান করবেন। এই অত্যন্ত লোভনীয় হওয়া ঘোষণা সত্বেও কেউ এগিয়ে এলো না রাজকন্যাকে উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে। দৈত্যের নৃশংসতা ও শক্তির কথা ভেবে ইচ্ছা থাকা সত্বেও পুরুষেরা উৎসাহিত হলো না। রাজা এতে হতাশ হয়ে পড়লেন।
হঠাৎ প্রতিবেশী রাজ্যের এক সাহসী রাজপুত্র এগিয়ে এলো অপহৃতা রাজকন্যাকে উদ্ধারে। কন্যাহারা রাজার চোখে মুখে আশার আলো ফুটলো। তিনি রাজপুত্রের দৈত্য বিরোধী অভিযানে সশস্ত্র সৈন্য দল দিয়ে সাহায্যূ করতে চাইলেন। কিন্তু রাজপুত্র কারো সাহায্য ছাড়াই একই অভিযানে যেতে আগ্রহী। রাজা তাকে প্রাণভরে দোয়া করলেন এবং তার সাফল্য কামনা করে তাকে বিদায় দিলেন। সাহসী রাজপুত্র মাঠঘাট প্রান্তর পেরিয়ে সেই দৈত্যের এলাকায় গিয়ে উপস্থিত হলো, যেখানে দৈত্যটি রাজকন্যাকে একটি পাহাড়ের গুহায় বন্দী করে রেখেছে।
রাজপুত্র দৈত্যের বাসস্থান পাহাড়ের পাদদেশে পৌছতেই ক্রুদ্ধ দৈত্যটি তার দিকে তেড়ে এলো। রাজপুত্র কোষ থেকে তরবারি বের করে দৈত্যের সাথে মহল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। দৈত্যটি বিশাল হলেও রাজপুত্রের যুদ্ধ কৌশলের কাছে সে পরাজিত হলো। রাজপুত্র তরবারির এক কোপে দৈত্যের মাথা কেটে ফেললে সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। এতে রাজপুত্র আনন্দে চিৎকার করে নিজের বিজয় ঘোষণা করলো। কিনউত আনন্দ ধ্বনি দিগন্তে মিলিয়ে যেতে না যেতেই রাজপুত্র সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো, দৈত্যের রক্ত মাটিতে পড়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই রক্ত কণা থেকে অসংখ্য দৈত্যের জন্ম হতে শুরু করেছে।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়। কিন্তু গল্পটি মনে পড়ে গেলো সম্প্রতি সিলেটের কিছু নদী ও আশপাশ এলাকায় টাস্পফোর্স অভিযান চালিয়ে অনেকগুলো বোমা মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার খবরটি পড়ে। অনেকেই জানেন, বোমা মেশিন নামক এক ধরনের মেশিন দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়। তবে এই উত্তোলন প্রক্রিয়ায় পাহাড়, টিলা বনজঙ্গলসহ বিস্তীর্ণ ভূমি গভীর গর্তে বা গর্ত পূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়। এতে পরিবেশের যেমন মারাত্মক ক্ষতি হয়, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস হয়ে যায়। এতো ক্ষয়ক্ষতি এবং সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্বেও বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।
কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পাথর কোয়ারীতে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে বোমা মেশিন পোড়ানো সত্বেও এই মেশিনের ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। দেখা গেছে, কিছুদিন পর পর ডজন দু’ডজন বোমা মেশিন ধ্বংস বা পোড়ানো সত্বেও উপরের গল্পের দৈত্যের রক্ত কণিকা থেকে রক্তবীজের বংশের মতো যেনো অসংখ্য বোমা মেশিন সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকের অভিযোগ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসকারী বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলন ব্যবসার সাথে অনেক হোমরা চোমরা নেতা ও আমলা জড়িত। অর্থের ভাগাভাগিতে জড়িত প্রশাসনের অনেক অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বোমা মেশিন পোড়ানোর এই বিষয়টি ‘আই ওয়াশ’ কিংবা পূর্ব পরিকল্পিত সাজানো ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই জাফলং ও ভোলাগঞ্জে এতো বোমা মেশিন ধ্বংসের ঘটনার পরেও এগুলো শেষ হচ্ছে না, বরং গল্পের দৈত্যের রক্তকণিকা থেকে জন্ম নেয়া নতুন নতুন দৈত্যের মতো প্রতিনিয়ত এই ক্ষতিকর বোমা মেশিনের জন্ম বা সৃষ্টি হচ্ছে।