মাসুম খলিলী
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যখন পুরো বিশ্বপরিস্থিতি আমূল পাল্টে দেয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে তখন মধ্যপ্রাচ্যে ঘটনাবলির নতুন বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই অঞ্চলে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা ঘটনা ঘটছে, যাতে মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল এই এলাকায় বড় কোনো বিন্যাস তৈরি হচ্ছে।
গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সৌদি আরব সফর করেন। সেখানে তিনি বাদশাহ সালমান এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করেন। এপ্রিলের শেষের দিকে, ইরানি মিডিয়া নিশ্চিত করেছে যে, সৌদি আরব এবং ইরানের ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইরাকি ও ওমানি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত স্বাভাবিকীকরণ আলোচনার পঞ্চম দফায় বৈঠক করেছেন। মার্চ মাসে ইসরাইলের রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজোগ তুরস্ক সফর করেন। ১৪ বছরের মধ্যে সে দেশে একজন সিনিয়র ইসরাইলি কর্মকর্তার এটিই প্রথম সফর। একই মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দুবাইয়ের এক্সপো-২০২০-এ অংশ নেন এবং আমিরাতি নেতাদের সাথে দেখা করেন। আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স গত নভেম্বরে তুরস্কে যাওয়ার পর এরদোগান ফেব্রæয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। আর শীতকালে আমিরাত এবং ইরানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল বিনিময় হয়।
এসব ক‚টনৈতিক তৎপরতায় ওয়াশিংটনের কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ‘উত্তেজনা কমানো’ এবং ‘পুনর্বিন্যাস’ নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এটিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের সমর্থকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবে দেখা হয়। তাদের যুক্তি হলোÑ যদি আঞ্চলিক অভিনেতারা দায়িত্বশীল আচরণ করে এবং তাদের মতপার্থক্য মীমাংসা করে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে দাঁড়াতে পারে এবং শুধু কোনো সঙ্কটের ক্ষেত্রে আবার ফিরে আসতে পারে।
প্রশ্ন হলো, বাস্তবে কি সেটিই ঘটবে? আমেরিকান ফরেন পলিসি সাময়িকীর কলামিস্ট স্টিভেন এ কুক মনে করেন, ক‚টনীতির এই সাম্প্রতিক উজ্জীবন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি, ভালোবাসা এবং বোঝাপড়ার কিছু নতুন পরিবেশের সূচনা করেছে। অধিকন্তু, এই অঞ্চলে চলমান বিভিন্ন পুনর্গঠন ও বিন্যাসের মাধ্যমে এখানকার নেতারা গত দশকের মতো একই প্রতিযোগিতা এবং দ্ব›দ্বকে অনুসরণ করতে পারেন।
নিকট ইতিহাস
প্রায় ৫০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিসরের অবস্থান পাল্টে দেয়। স্নায়ুযুদ্ধের শূন্য-সমষ্টির ক‚টনীতিতে এটি তাদের বড় জয় ছিল। মিসরীয়রা এমন একটি প্রভাববলয়ের ক্লাবে যোগ দেয়, যেখানে সৌদি, জর্দানি, ইসরাইলি এবং ছোট পারস্য উপসাগরীয় রাজ্যগুলো ছিল।
পরবর্তী দশকগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আরো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়ার ফলে সেই দেশগুলো মার্কিনবান্ধব একটি রাষ্ট্রগোষ্ঠীর ভিত্তি গঠন করে, যা ওয়াশিংটনের জন্য এই অঞ্চলে তার লক্ষ্য অনুসরণ করা সহজ করে তোলে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চল থেকে তেল, ইসরাইলি নিরাপত্তায় সাহায্য করা, সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং সেই সাথে ইরাক আক্রমণের মতো অন্যান্য অতি উচ্চাভিলাষী আমেরিকান নীতি বাস্তবায়নের সিরিজ কাজ চলে।
টানাপড়েন
মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অংশীদারদের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের বিশদ বিবরণ প্রকাশ হয়েছে। অবশ্যই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সাথে বিশ্বব্যাপী দাম বেড়ে যাওয়ায় সৌদি বা আমিরাত কেউই তেল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাইডেন প্রশাসনের অনুরোধ গ্রহণ করেনি। আমিরাত সরকার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা প্রস্তাব থেকে বিরত থাকে। আর যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন, সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাত কেউই ওপেক প্লাস-এ তাদের অংশীদার রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেনি।
মার্চের মাঝামাঝি আমিরাত দুবাইতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে আতিথ্য দেয়। আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বিশাল আকারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তির সফর থেকে কী বার্তা পাঠাচ্ছেন তা কল্পনা করা কঠিন, তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের একটি ফাটল স্পষ্ট করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্বৈরশাসক এসেছেন এবং গিয়েছেন, কিন্তু সীমানা এবং এমনকি শাসনব্যবস্থা সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের পর এই অঞ্চলের বেশির ভাগ প্রধান দেশ পরস্পরের সাথে সরাসরি লড়াই বন্ধ করে, সন্ত্রাসবাদ এবং বিদ্রোহ-দুর্বলদের কৌশল-প্রথাগত আক্রমণের জন্য বেছে নেয়। তবে একটি তির্যক সামরিক ভারসাম্য বজায় থাকে, যা পরিবর্তনের জন্য প্রায় দুর্ভেদ্য প্রমাণিত হয়েছিল। উপরের তলায় বিশৃঙ্খলা থাকতে পারে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার ভিত্তি ছিল শক্ত। স্পেকট্রামের এক প্রান্তে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিমান ছিল, পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক হলে যেকোনো শত্রæকে পরাস্ত করতে সক্ষম ছিল। তার পেছনে ছিল ইসরাইল। বর্ণালির অন্য প্রান্তে আরব রাষ্ট্রগুলো ছিল, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে আধুনিক যুদ্ধ চালাতেও হয়তো বা অক্ষম ছিল। ইরান এবং তুরস্কও এর মধ্যেই ছিল।
এই পরিস্থিতিতে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বহিরাগত শত্রæদের বিরুদ্ধে নিয়মিত শক্তি ব্যবহার করেছে। যেহেতু উভয়ই স্থিতাবস্থার কট্টর রক্ষক ছিল, তাই তারা বিদ্যমান ব্যবস্থাটিকে পুনর্নির্মাণের পরিবর্তে সংরক্ষণ করার জন্য কাজ করেছে। ফলস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বড় কোনো প্রচলিত আন্তঃরাষ্ট্র যুদ্ধ দেখেনি। এর আংশিক ব্যতিক্রম ছিল ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ, যেখানে ইসরাইল লেবাননের ডি ফ্যাক্টো শাসক সত্তা হিজবুল্লøাহর সাথে যুদ্ধ করে। এটিও একটি ব্যতিক্রম ছিল। কোনো পক্ষই যুদ্ধ চায়নি। উভয়েই এতে হোঁচট খেয়েছিল এবং ফলাফলের দ্বারা এতটাই আঘাত পেয়েছিল যে, তারপর থেকে তারা তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেনি।
পরিবর্তনের সূচনা
সেসব কিছুর এখন পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন এই অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। নতুন সামরিক ও বেসামরিক প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে গৌণ ভূমিকার চিন্তাভাবনা করে। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নতুন কৌশলগত সমীকরণ শুরু করে। কোন দেশ কার সাথে কতখানি কৌশলগত হাতটি এখন রাখছে তা জানা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
যুদ্ধ সবসময় পরিবর্তিত হয়। আর কোনো যুদ্ধ আগের মতো হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে, পরিবর্তনগুলো গভীর হতে পারে। সাধারণত, একটি বিশাল অর্থনৈতিক পরিবর্তন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। এসব পরিবর্তন মূলত অ-সামরিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন থেকে প্রবাহিত হয়। রেলপথ, টেলিগ্রাফ, রেডিও, বিমান, অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন, পরমাণুর গোপনীয়তাÑ প্রাথমিকভাবে বেসামরিক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। একবার আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত হওয়ার পরে এগুলোকে দ্রæত যুদ্ধ-নির্মাণে প্রয়োগ করা হয়। শিল্পবিপ্লব যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যুদ্ধকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্নির্মাণ করেছিল, তেমনি তথ্যবিপ্লবও আজ তাই করছে। তথ্যের যুগে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব হচ্ছে; কিন্তু এখনো কেউ জানে না কোনটি যুদ্ধে প্রভাবশালী হবে এবং কোনটি প্রান্তিক প্রমাণিত হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যে নতুন অবস্থা দেখা দিতে শুরু করেছে। নতুন সামরিক প্রযুক্তিকে প্রায়ই একটি বিদ্যমান সমস্যার জন্য রুপালি বুলেট হিসেবে দেখা হয়। শেষ পর্যন্ত কিছু নতুন প্রযুক্তি এতটাই মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয় যে, তারা সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। শিল্প যুগে বিমান, সাবমেরিন এবং যান্ত্রিক যানবাহন এই তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল। নিরন্তর আকাশ অভিযান চালানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল নিবেদিত বিমানবাহিনী। বিমানযুদ্ধ তার নিজস্ব যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে; কিন্তু এটি স্থল ও নৌযুদ্ধ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, লজিস্টিক ক্ষমতা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং কমান্ড ও কন্ট্রোলের সাথে নিয়মিত সমন্বয় করেছে।
এই মুহূর্তে কেউ জানে না তথ্যবিপ্লবের কোন উদ্ভাবনগুলো যুদ্ধের নতুন জটিল ক্ষেত্র বিকাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইউক্রেন আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে রাশিয়া এখান থেকে প্রাপ্ত সীমিত সুবিধা সত্তে¡ও সাইবার-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাইবার-সৈন্যরা শত্রæর গতিশক্তি, রসদ, উৎপাদন, পরিবহন এবং কমান্ড এবং কন্ট্রোলে আক্রমণ করতে চাইবে। বিমানযুদ্ধের মতো, সাইবার শক্তি একযোগে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে সামরিক শক্তির অন্য সব উপাদানের সাথে সমন্বয় করবে।
সাইবার ওয়্যারফেয়ারের আবির্ভাব একমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, যা যুদ্ধবিপ্লবের জন্য হুমকিস্বরূপ। শিল্প যুগে সঙ্ঘাতকে ট্যাংক, যুদ্ধজাহাজ, বিমান ইত্যাদি যান্ত্রিক প্লাটফর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। যখনই বিশ্লেষকরা একটি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মূল্যায়ন করতে চান বা যুদ্ধে দুই পক্ষের আকার বাড়াতে চান, তারা অবিলম্বে তাদের প্লাটফর্মগুলো হিসাব করেন। তাদের কত ট্যাংক আছে এবং কী ধরনের ট্যাংক বা কয়টি প্লেন আছে? বিভিন্ন ধরনের জাহাজ আছে কয়টি? এখন প্রতিরক্ষা সক্ষমতার সেই হিসাব পাল্টে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির প্রতিযোগিতা
নতুন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো কৌশলগতভাবে কে কার সাথে আছে তা জানা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জার্মানি এবং এর শেষার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মতো কিছু সামরিক বাহিনী শক্তিমান ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে আরব রাষ্ট্রগুলো কখনোই সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। আজ নতুন নতুন সামরিক প্লাটফর্মের গুরুত্ব বাড়ছে। বিশ্বের এখন প্রায় পাঁচ দশক ধরে স্মার্ট যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে এবং তারা ক্রমবর্ধমানভাবে যেকোনো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভাবশালী মেশিন হয়ে উঠছে।
এফ-৩৫-এর সামর্থ্যরে সমন্বয় ভবিষ্যতের যুদ্ধের আরেকটি তরঙ্গ উপস্থাপন করে। এর উজ্জ্বল সেন্সরগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা উন্নত যুদ্ধ-ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচালিত। এগুলো সমানভাবে উজ্জ্বল দূরপাল্লøার যুদ্ধাস্ত্রের সাথে যুক্ত। গোলাবারুদগুলো সরাসরি সেন্সর থেকে তথ্যের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ-ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম দ্বারা পরিচালিত হবে এমন যেকোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য ট্র্যাক রাখতে সক্ষম হতে পারে। একই সাথে এই সরঞ্জামগুলো দ্রæত লক্ষ্য এবং হুমকি শনাক্ত করতে পারে, তাদের ধ্বংস করার জন্য অস্ত্র বরাদ্দ করতে পারে এবং অস্ত্রগুলো চালু করতে পারে।
এফ-৩৫ এবং অনুরূপ জটিল অস্ত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ যথেষ্ট ধনী, তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য যথেষ্ট প্রতিশ্রæতিবদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের অধিগ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ। ইসরাইলের এফ-৩৫ বিমান রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এগুলো পরে পাবে এবং সৌদিরাও শেষ পর্যন্ত সম্ভবত এগুলো পাবে। তবে মিসর, ইরাক এবং জর্দানের পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তবে এর মধ্যেই প্রতিরক্ষা সম্ভাবনায় নতুন কিছু আসছে।
সিদ্ধান্তকারী অস্ত্র ড্রোন ও তুরস্ক!
এখন ড্রোনগুলো তথ্যযুগের যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দ্রæত আবিভর্‚ত হচ্ছে। ড্রোন মনুষ্যবিহীন এবং নিজেই চূড়ান্ত তথ্যসমৃদ্ধ যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধে নাগরিকদের বলি দিতে নারাজ দেশগুলোর কাছে ড্রোন আকর্ষণীয়। তা ছাড়া অনেক ড্রোনের যথেষ্ট পরিসর, অন্তর্নির্মিত সেন্সর, স্টিলথ ক্ষমতা এবং লক্ষ্যে নির্ভুল আঘাত হানার ক্ষমতা রয়েছে। অনেক সস্তা ড্রোন প্রথাগত প্রাথমিক সতর্কতা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারসহ অনেক বেশি ব্যয়বহুল প্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্তকরণ এড়াতে পারে। একইভাবে ব্যয়বহুল বিমান প্রতিরক্ষা অস্ত্র দ্বারা ধ্বংস করাও কঠিন এবং দুর্বল লক্ষ্যবস্তুতে বেদনাদায়ক ক্ষতি সাধনে সক্ষম। ড্রোন অনেক ক্ষেত্রেই সর্বতোভাবে শক্তিমান না হলেও তাদের নিজস্ব ক্ষমতাকে সমন্বিত করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ভবিষ্যতের পাল্টা ব্যবস্থাগুলোকে অতিক্রম করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক দেশ মাইক্রোড্রোনের ওপর কাজ করছে, যা আরো সহজে শনাক্তকরণ এড়াতে পারে। অনেক দেশ ড্রোনের প্রধান দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কঠোর পরিশ্রম করছে। স্থলভাগে কোনো অপারেটরের কাছ থেকে তাদের কিছু ধরনের নির্দেশনার প্রয়োজন। অত্যাধুনিক কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সিস্টেম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত স্বচালিত ড্রোন সেটি দূর করতে পারে।
৭৫ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের মহা অস্ত্র পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। প্রধান অস্ত্র প্রস্তুতকারী সোভিয়েতরা মিসরে, আমেরিকানরা ইরাকে আর রাশিয়ানরা সিরিয়ায় যুদ্ধে তাদের সর্বশেষ হত্যা মেশিন পরীক্ষা করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সস্তা থেকে স্বল্প ব্যয়বহুল ড্রোনও তা থেকে আলাদা নয়। এগুলো ক্রমবর্ধমান হারে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করছে এবং এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে।
উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুর্কি বাহিনী কুর্দি বিদ্রোহী বা ইসলামিক স্টেট যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সামান্যই বাস্তব সক্ষমতা প্রদর্শন করে। এরপর তুর্কিরা ড্রোন আবিষ্কার করে। এর ফলে তারা আজ তাদের অটোমান গৌরব অনেকটাই ফিরে পেয়েছে। ২০২০ সালে, লিবিয়ার বিদ্রোহী শক্তিমান খলিফা হাফতার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি অবরোধ করেছিলেন এবং শহরটির পতন কেবল সময়ের ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। তারপর আঙ্কারা সেখানে উপদেষ্টা এবং ড্রোন-সমৃদ্ধ একটি সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, যা লিবিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারকে হাফতারের বাহিনীকে ধ্বংস করতে এবং তাকে রাজনৈতিক আলোচনায় বাধ্য করতে সক্ষম করে তোলে। একই বছর, সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের শক্ত ঘাঁটি ইদলিবের বিরুদ্ধে একটি বড় আক্রমণ শুরু করে বাশার আল-আসাদ। ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় পুনর্নির্মিত একটি সাঁজোয়া বাহিনী নিয়োগ করে আসাদ সরকার। এখানেও তুর্কি ড্রোনের একটি ঝাঁক সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে তুর্কি ড্রোনের আরেকটি বহর আজারবাইজানকে নাগরনো-কারাবাখের বিতর্কিত অঞ্চলে তাদের সর্বশেষ রাউন্ডের লড়াইয়ে আর্মেনিয়ান স্থলবাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম করে।
শুধু তুর্কিরাই ড্রোন ব্যবহার করে না। ইরানও ড্রোন ব্যবহার শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার বিভিন্ন মিত্র এবং প্রক্সিদের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান প্রায় দুই ডজন ড্রোন এবং তিনটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আবকাইকের বিশাল সৌদি তেল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে আঘাত করে। ড্রোনগুলো সাইটের চার পাশে বিস্তৃত আকাশ প্রতিরক্ষা এড়াতে সক্ষম হয়। এভাবে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সৌদি আরবের প্রায় অর্ধেক তেল উৎপাদন অফলাইনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
তারপর থেকে ইরানের মিত্র ও প্রক্সিরা বারবার ইরাক এবং সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীকে ড্রোন দিয়ে আঘাত করেছে এবং সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবিরাম বিমান অভিযান চালিয়েছে। এই ধরনের আক্রমণগুলো উল্লেøখযোগ্যভাবে কার্যকর হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ক‚টনৈতিক ধাক্কাধাক্কির পর কেন সৌদিরা বাগদাদে ইরানিদের সাথে সরাসরি আলোচনায় সম্মত হয়েছিল তা বোঝার জন্য মনে রাখতে হবে যে, এপ্রিল ২০২১ সালে হুথিরা ড্রোন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সৌদি আরবে ৮৪ বার আক্রমণ করে।
২০ বছর আগে ইরান এবং তুরস্ক তাদের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করার জন্য খুব দুর্বল ছিল। তারা তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বেলুচি এবং কুর্দি বিরোধীদের সাথে লড়াই করতে পারেনি। আজ তারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। তুরস্ক এরই মধ্যে লিবিয়া ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্তব্ধ করে দিয়েছে। ইরান সম্ভবত সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ইতিহাসে প্রথম সত্যিকারের কার্যকর জবরদস্তিমূলক বিমান অভিযান চালিয়ে রিয়াদকে একটি দর কষাকষির টেবিলে বসতে বাধ্য করেছে। আমিরাতিরা একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এবং শুধু স্বল্পমেয়াদে ইরানিদের জন্য অগ্রিম ছাড় দিচ্ছে না; বরং দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজস্ব একটি ড্রোন সেনাবাহিনী তৈরি করতে তারা যা যা করতে পারে তা-ই করছে।
আমেরিকা থেকে প্রস্থান
সামরিক প্রযুক্তির পরিবর্তনই মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্য পুনর্নির্মাণের একমাত্র কারণ নয়। প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে একটি বহিরাগত মহাশক্তি সর্বদা এই অঞ্চলের আধিপত্য এবং চূড়ান্ত নিরাপত্তা গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করেছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি অটোমান তুর্কিরা মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ অংশ জয় করে এবং প্রায় ৪০০ বছর ধরে শাসন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পতন হলে ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং পরবর্তী ৫০ বছর ধরে একই ভূমিকা পালন করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকা থেকে কিছুটা সরে আসতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে এই অঞ্চল আরো বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। এ সময় দেশটি কিছু আঞ্চলিক মিত্রকে পরিত্যাগ করে। জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের বলে চলেছেন যে, তিনি আর বিচ্ছিন্ন হতে চান না। এমনকি কোনো-না-কোনো উপায়ে পুনরায় যুক্ত হতে চান। কিন্তু আমেরিকান মিত্ররা তার শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা নিয়ে রয়েছে সংশয়ে। ২০১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তুরস্কে এই ধরনের এক কাজে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করা হয়। প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি সেই এজেন্ডা আবারো সামনে এগিয়ে নিতে চান বলে সন্দেহ আঙ্কারা রিয়াদ আবুধাবি এমনকি কায়রোরও রয়েছে। ফলে এসব শক্তি নিজেদের বিরোধ দূরে ঠেলে দিয়ে নিজস্ব বা আঞ্চলিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি ভারসাম্য নির্মাণ করতে চাইছে।
ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রত্যাশিত পশ্চাদপসরণ এই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের আতঙ্কিত করে একসময়। একই সাথে এটি প্রভাব বাড়ায় ইসরাইলের। বাহরাইন, মরক্কো, সুদান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আব্রাহাম অ্যাকর্ডস স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইসরাইলের সাথে বোঝাপড়ার বিষয়ে মিসর এবং জর্দানের সাথে যোগ দেয়। সৌদি আরবও এটি অনুসরণ করবে বলে ধারণা ইসরাইলি বিশ্লেষকদের, যদিও সম্ভবত সালমান বাদশাহ থাকাকালে এটি না-ও হতে পারে।
ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি এই দেশগুলোর আগের ঘৃণাকে নমনীয় করার বিষয়টিকে একটি বাস্তবসম্মত উপলব্ধি বলে চিহ্নিত করতে চান তারা। অনেকেই এই নতুন বন্ধুত্বকে আরব-ইসরাইল দ্ব›েদ্বর সমাপ্তি হিসেবেও উদযাপন করেছেন। এমনকি ফিলিস্তিনিদের অমীমাংসিত দুর্দশাকে একপাশে রেখে ইসরাইলের সাথে আরব নেতারা সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন বলে মনে করছেন; কিন্তু এটি শেষ দৃশ্য বলে মনে হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন শক্তির উন্মেষ ঘটছে। লেখার শুরুতে যে ঘটনাবলির উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো এমন এক অস্থিরতার প্রতিফলন, যা নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষণ বলে মনে হয়।
এটি মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ শক্তির বাইরে একটি আঞ্চলিক বলয় তৈরি করতে পারে। বিশ্বে এক মেরু আর বহু মেরুভিত্তিক প্রভাব বলয় তৈরির সঙ্ঘাত যেভাবে ইউক্রেনে রুশ-পশ্চিম সর্বাত্মক লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে তা দুই প্রধান শক্তির রক্ত ও শক্তিক্ষয়ের মধ্যে বিশ্বের জন্য বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। এ জন্য প্রয়োজন শক্তিমান মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার সমঝোতা। যার কিছু সম্ভাবনা এখন দেখা যাচ্ছে। এটি বিকল্প এক বৈশ্বিক শক্তির সৃষ্টি করতে পারে, তবে একবারে এই মুহূর্তে হয়তো নয়। হতে পারে এক বা দুই দশকের মধ্যে, যার ইঙ্গিত তুর্কি নেতা এরদোগান এর মধ্যে দিয়েছেন।
mrkmmb@gmail.com