কিছু মানুষ জন্মগ্রহন করেন যাদের জীবন ও কাজ বিশাল ইতিহাস হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে রাজনৈতিক বাঁক পরিবর্তন হলেও ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে থাকেন তারা। জাতীয় জীবনে দ্যুতি ছড়ায় এদের অবদান। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাদের একজন।
মওদুদ আহমদ ছিলেন দারুণ কৌতূহলী রাজনীতিক। সফল আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান। ভাষা আন্দোলনের মিছিল থেকে জেল খেটেছিলেন। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মওদুদ আহমদ লন্ডন থেকে বার-অ্যাট-ল করেছেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে তিনিও মাঠে নামেন। ছয় দফার সমর্থনে লড়াই করেছেন। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সক্রিয় ছিলেন মওদুদ আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজনদের একজন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতিমান বৃটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়াম কিউসিকে নিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে মুজিবনগর সরকারে প্রভাবশালী কর্মকর্তা পোস্টমাস্টার জেনারেল হয়েছেন। তারপর জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে ক্ষমতার মসনদে ছিলেন।
বাংলাদেশে রাজনীতির অন্দর মহলের কারিগর হিসেবে তিনি সবার সেরা। এ বিষয়ে তার চেয়ে বেশী জানা মানুষ সম্ভবত আর কেউ নেই। এরকম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা মানুষের স্মৃতিকথাও নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক দলিল। তাই রাজনীতির উত্থান পতন নিয়ে তার লেখা বইগুলি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। বিশাল কর্মজীবন পেছনে ফেলে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ ২০২১ সালের ১৬ মার্চ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দেশের রাজনীতির বিরাট অংশ জুড়ে তার স্মৃতি ও অবদান রয়ে যাবে রাজনৈতিক ইতিহাস হয়ে।
বাংলাদেশের রাজনীতির বেড়াজাল বুঝতে হলে মওদুদ আহমদের ‘ডেমোক্রেসী অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’ বইটি পড়তে হয়। আর ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারী ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘এরা অফ শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’ পড়লে দেশের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অনুধাবন করা যাবে। এছাড়া ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ১৯৯১ থেকে ২০০৬, ‘কারাগারে যেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’ সহ তার অন্যান্য গ্রন্থও ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমাদৃত।মওদুদ আহমদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ হয় যখন তিনি জেনারেল এরশাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। অনেক কথার পর জানতে চেয়েছিলাম জিয়াউর রহমানের উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার ভূমিকা নিয়ে। তিনি হেসে হেসে অন্য বিষয়ে চলে গেলেন। আমি ঘুরে ফিরে আবার যখন একই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম, তখন তিনি খানিকটা বিনয়ের সাথে বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিয়োগান্তক ঘটনার পর অত্যন্ত পরিপক্ব সিদ্ধান্তের কারণে রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। এরশাদ সরকারের আমলে তিনি তথ্যমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, তারপর প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
সেই তখন থেকেই মওদুদ আহমদকে বেশ অমায়িক দেখেছি। এরপর সিলেটে ও লন্ডনে কয়েকবার তার যথেষ্ট সান্নিধ্য লাভ করেছি। তিনি সাংবাদিকদের বেশ স্নেহ করতেন। রাজনৈতিক বাঁক পরিবর্তনের কারণে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন মওদুদ আহমদ। তবে খালেদা জিয়ার মন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশী সাচ্ছন্দবোধ করেছেন বলে লন্ডন সফরকালে জানিয়েছিলেন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে তিনি আইনমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে মওদুদ আহমেদকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।
মওদুদ আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন সুনামখ্যাত শিক্ষক। ছয় ভাই বোনের মধ্যে মওদুদ আহমদ চতুর্থ। পল্লীকবি জসীমউদদীনের কন্যা হাসনা মওদুদ তার স্ত্রী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এরশাদ আমলে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হয়েছিলেন। তাদের দুই ছেলে অকালে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে আনা আসপিয়া স্বামীসহ থাকেন নরওয়েতে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স এর ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যারয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন।
মহান আল্লাহ তার জীবনের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন।
লেখক: সময় সম্পাদক। কবি ও কথাসাহিত্যিক।