ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লম্বা এই লড়াইয়ের অন্যতম দুই মিত্র বিএনপি ও জামায়াত। সম্ভবত হাসিনার এমন কোন রাজনৈতিক বক্তব্য পাওয়া যাবে না, যেখানে তিনি দোষ চাপাতে গিয়ে ‘বিএনপি-জামায়াত বা জামায়াত-বিএনপি’ নাম একসাথে উচ্চারণ করেন নি। জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন দুই দলের উপর দিয়েই গিয়েছে। সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবেও দুই দলেরই অংশ গ্রহণ রয়েছে। কারও বেশি, কারও কম। যাদের অবদান বেশি (আজকের এই ডিজিটাল সময়ে তা অটো ডকুমেন্টেড হয়ে যায়) তার ঢোলের সাউন্ডও কিছুটা অটো হবেই। এটাই ন্যাচারাল। এটা সহজভাবে মেনে নিয়েই দুই দলের উচিত ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যের চেতনাকে আরও বেশি সিমেন্টেড করা। কিন্তু বিধি বাম। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের চোখের সামনে এত বড় একটা রক্তক্ষয়ী বিপ্লব দেখেও আমরা আমাদের চরিত্রে, কর্মে এতটুকু পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারিনি। কেন আওয়ামী লীগ ও হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠল, কেন তাদের বিরুদ্ধে এতবড় আপরাইজিং হলো এ নিয়ে কোন নির্মোহ বিশ্লেশন ও তার থেকে শিক্ষা নেয়ার কোন প্রচেষ্টাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
পতিত ফ্যাসিস্ট ফিরে আসতে চাইবে। এজন্য সাধ্যের সবটুকু তারা করবে এটাই তো স্বাভাবিক। লুট করা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ইনভেস্ট করে হলেও তারা আসতে চাইছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত ইন্টেলিজেন্স ও শিকড় গেড়ে থাকা ফ্যাসিস্ট দোসরদের দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ, ও প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয়ার চেষ্টা করছে। দু:খজনকভাবে এই টোপে ইতোমধ্যে অনেকেই আটকে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
ফ্যাসিজমের নেরেটিভ হলো, আগে জামায়াত ঠেকাও। নাইলে তোমার আমার (চাদাবাজি-লুটপাটের রাজনীতির) কারও ভবিষ্যৎ নাই। যে ফ্যাসিস্ট কিছু দিন আগেও জামায়াতের সাথে বিএনপির নাম তাসবীর মত পাঠ করত, আজ তারা জামায়াতকে সিংগেল আউট করে বিএনপিকে বন্ধু ভাবছে। বিএনপিতেই তারা তাদের ফিরে আসার শেষ আলো দেখছে। আর বিএনপিও এই টোপ গ্রহণ করে জোরে শোরে নৌকা বাইতে শুরু করেছে। বিএনপির এখনকার একটিভিটি অন্তত তাই প্রমাণ করে। বিশেষ করে অনলাইন একটিভিটি।
বিএনপি মহাসচিব কিছু দিন আগে সরল মনে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, টেকনোলজি ব্যবহারে তারা জামায়াতের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। অনলাইনের দৃশ্যপট এর পর থেকে নেতিবাচকভাবে পাল্টে যেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ আমলে অনালাইন যুদ্ধের জন্য প্রতিষ্ঠিত সিপি গ্যাং সহ বিভিন্ন গ্রুপের কাজ ছিল মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেদারসে গুজব ছড়ানো। বিএনপি- জামায়াত দুই দলের বিরুদ্ধেই তারা এই কাজ করত। এ জন্য তারা বিভিন্ন মিডিয়ার নামে মিথ্যা ফটো কার্ড তৈরি, ভিডিও কাট-পিস করে বা ভয়েস চেঞ্জ করে প্রচার করত। বিভিন্ন আইডি হ্যাক করে অথবা সিন্ডিকেট রিপোর্ট করে রিচ কমিয়ে দেয়ার কাজেও তারা ছিল দক্ষ। এই রকম অনেক গ্রুপ এখন বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের সাথে একীভূত হয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যার ফলে সোস্যাল মিডিয়া এখন বিভিন্ন মিথ্যা ফটো কার্ডে সয়লাব হয়ে আছে। কোথাও চাঁদাবাজির জন্য নিউজ হয়েছে বিএনপির নামে, ভুয়া ফটো কার্ডে বিএনপির জায়গায় জামায়াত লিখে ছেড়ে দিচ্ছে। অথবা কোথাও ছাত্রদল কোন নেতিবাচক কাজের জন্য মিডিয়ায় এসেছে, কিন্তু তা এডিট করে শিবিরের নাম লিখে সোস্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিচ্ছে। এগুলো অনেক সচেতন জনগণ বুঝলেও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের বিশেষ করে দলীয় ভক্তদের এইসব ফটো কার্ডের অথবা ভিডিওর সত্য-মিথ্যা আলাদা করে বুঝার ক্ষমতা নাই। এই সুযোগটাই নিচ্ছে বিএনপি। এর মাধ্যমে তারা একটা আর্টিফিশিয়াল সুখ অনুভব করছেন হয়তো । এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অনলাইন যুদ্ধ হিসেবে দেখে হতাশ হচ্ছেন। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল সুখ যে বেশি দিন থাকে না তা বুঝতে বিএনপির আরও কিছু দিন সময় লাগবে মনে হচ্ছে।
তাদের এমন কাজ যদিও অনলাইনের জামায়াত-শিবিরের সাধারণ সমর্থকদের উস্কে দিচ্ছে, তবুও এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, জামায়াত-শিবিরের কেউ কারও নামে মিথ্যা সংবাদ প্রচার, ভুয়া কার্ড কিংবা এডিটেড ভিডিও প্রচার করছেন না। এটা তাদের নীতি বিরুদ্ধ। ইনফ্যাক্ট, মিডিয়ায় প্রতিদিন তাদের নামে যে পরিণাম সত্য নিইজ ও ঘটনা আসছে তাতে করে আলাদা করে তাদের নামে মিথ্যা কার্ড কিংবা ভিডিও বানানোর তো কোন দরকারই পড়ে না। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কোন সুযোগ করে না দিতে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যের কথা চিন্তা করে জামায়াত-শিবিরের অনলাইন একটিভিস্ট ও এক্সপার্টদের বেশির ভাগই বিএনপির অপকর্ম প্রচারের কাজ থেকে সচেতনভাবে নিজেদের দূরে রেখেছেন। যা প্রচার হচ্ছে তা সাধারণ ছাত্র-জনতার দ্বারাই স্বতস্ফূর্তভাবে হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের কারণে নয়। বিএনপি ও ছাত্রদলের উচিত তাদের এই ধৈর্য্যকে শ্রদ্ধা করে আওয়ামী বয়ানে ও ন্যারেটিভে জামায়াত-শিবিরকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা।
তাদের জানা উচিত, ৫ আগষ্টের পর থেকে সারা দেশে তাদের নেতা কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাস্তানি ও মামলাবাজিসহ বিভিন্ন আকামের যে পাহাড় গড়ে উঠেছে তার বেশির ভাগই এখনো ঢাকা রয়েছে। বিভিন্ন ডিজিটাল কন্টেইনারে এগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। মানে সব কিছুই তথ্য প্রমাণসহ ডকুমেন্টেড এবং ওয়েল রেকর্ডেড রয়েছে। আমরা আগের ফ্যাসিবাদ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই, যাতে মানুষ আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ভুলে না যায়। দয়া করে নব্য ফ্যাসিবাদের খায়েশে পাহাড় সমান এই কন্টেইনারগুলোর ঢাকনা খুলতে বাধ্য করবেন না। না হয়, ভাড়াটে বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট গ্রুপ আর হাতে গুনা কয়েকজন কন্টেন্ট মেকার দিয়ে এটা কাভার দিতে পারবেন না। মানুষ কেবল ছি ছি দিতে থাকবে এবং মিথ্যা ও ভুয়া প্রচার প্রপাগান্ডার জন্য জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের মত আপনারাও ধিকৃত হতে থাকবেন।