ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরে জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলের এবারের হামলার ঘটনাটিই প্রায় দু’দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণঘাতী হামলা।
ইসরাইলি সৈন্যরা একটি ভবনে গুলি, গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ব্যবহার করে অভিযান চালানোর এ ঘটনায় নয় ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। দেশটির সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের সৈন্যরা একজন উগ্রবাদীকে ধরতে গিয়েছিল। যারা বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করছিল।
বিবিসি বলছে, এখানে ঐতিহাসিক কিছু বিষয় রয়েছে। গত বছর পর্যন্ত সেখানে ইসরাইলের অভিযান বাড়ছিল এবং নতুন প্রজন্মের সশস্ত্র ফিলিস্তিনিদের সাথে প্রায়ই তাদের সংঘর্ষ হচ্ছিল। অনেকেই ২০০২ সালের এপ্রিলের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে এটি দ্বিতীয় ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করছিলেন।
জানা গেছে, ওই সময় ইসরাইল একটি পূর্ণ সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। যা জেনিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ওই সময় অন্তত ৫২ জন ফিলিস্তিনি আর ২৩ জন ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছিল। এর জের ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলে অনেক বার আত্মঘাতি বোমা হামলা চালিয়েছিলো।
ওই অভিযানে জেনিন শিবিরেরের বড় অংশই তখন ধ্বংসের মাত্রার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে ফিলিস্তিনিরাও নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু করে।
গত বসন্তে ইসরাইল ব্রেক দ্যা ওয়েভ নামে অপারেশন শুরু করে। এটি ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের বন্দুক ও ছুরি ব্যবহার করে হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় করা হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, এর মধ্যে কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে কথিত ইসলামিক স্টেট সমর্থকরা। এতে বেশকিছু ফিলিস্তিনি বন্দুকধারী মারাও যায়। যার মধ্যে রাদ হাজেমও ছিলেন। যিনি তেল আবিবের একটি বারে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। ফলে জেনিন আবারো আলোচনায় আসে। ইসরাইলের তল্লাশি, গ্রেফতার ও অভিযান বেড়ে যায়।
ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্স বলছে যে তারা আরো হামলা ঠেকাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিবিসি বলছে, পুরো পশ্চিম তীরে মৃত্যুর ঘটনা আরো বেশি। গত বছর সেখানে অন্তত দেঢ় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের অনেকেই শুধু সামরিক গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়েছে। কেউ কেউ হয়তো শুধু পথচারীই ছিল।
এদিকে ইসরাইলের সবসময়ই জাতিসঙ্ঘ ও অন্য কিছু মানবাধিকার সংস্থা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য অভিযুক্ত করে আসছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সেখানকার শহরগুলোতে সীমিত শাসনক্ষমতাই রয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই জেনিন ও নাবলুসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন এই কর্তৃপক্ষ নব্বইয়ে অসলো শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আব্বাসের দল ফাতাহ পার্টির প্রবল প্রতিপক্ষ হামাস।
জানা গেছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন ইসরাইলের সাথে নিরাপত্তা বিষয়টি সমন্বয় করছে। যার অর্থ হলো তারাই কিছু মিলিশিয়ার তথ্য আদান প্রদান করছে। যদিও প্রেসিডেন্ট আব্বাস বলছেন, জেনিনে হামলার কারণে নিরাপত্তা সমন্বয় তারা বন্ধ করে দেবেন।
২০২১ সালেই জেনিন শরনার্থী শিবির ও নাবলুসে কর্তৃত্ব হারিয়েছে মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ । মে মাসে গাযায় হামাস ও ইসরাইলের লড়াইয়ের সময় থেকেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সেখানে অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে। আবার ইসরাইলের একটি জেল থেকে ছয় বন্দী টানেল খুড়ে বেরিয়ে গিয়ে ধরা পড়েছিল। এর সবাই জেনিনের।
অভিযোগ রয়েছে, জেনিন ও নাবলুসের নতুন প্রজন্মের যোদ্ধারা মাহমুদ আব্বাসের কর্তৃপক্ষকে প্রত্যাখ্যান করছে। তারা সশস্ত্র হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীগুলোর সাথে যোগাযোগ হারাচ্ছে। তারা নিজেদের জেনিন ব্যাটালিয়ন বলছে আর নাবলুসে তাদের পরিচিতি লায়নস ডেন হিসেবে।
জর্ডান থেকে চোরাচালান হয়ে আসা বা ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্স ঘাঁটি থেকে চুরি বা বিক্রি হওয়া অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে। আর এদের অনেকেই অনেক কম বয়সী। যারা ২০০২ সালের ঘটনা মনেও করতে পারে না।
ইসরাইলের সেনাদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন সাংবাদিক বলছেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। এসব লোকেরা লড়াই করতে চায়। তারা প্রাণ দিতে আগ্রহ‘।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলছে তারা বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যদের ওপর হামলা প্রতিরোধ করছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট বলছেন, ‘ইসলামি জিহাদীদের টেরর স্কোয়াড ইসরাইলে হামলা করতে চাইছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরো অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যেই সোমবার ইসরাইল গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিংকেন’। – সূত্র: বিবিসি