পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ছাড়াই ইউক্রেনের জয়লাভ সম্ভব

মতামত সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আনাতোল লিভেন

কিছু পশ্চিমা দেশের সহায়তায় ইউক্রেন ইতিমধ্যে একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছে। রাশিয়ার আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল কিয়েভ দখল করা এবং ইউক্রেনীয় সরকারের পালাবদল নিশ্চিত করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাশিয়া সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছে। রাশিয়ান সেনাবাহিনী এখন অনেক বেশি সীমিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে পূর্বাঞ্চলে পুনঃসংগঠিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো রাশিয়ান ভাষার নাগরিক অধু্যষিত ডনবাস অঞ্চল পুরোপুরি দখল করা। মস্কো ইতিমধ্যে এই অঞ্চলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

রাশিয়ান সেনাবাহিনী যদি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তবে মস্কোর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কিন্তু এই যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজাত সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি তুলনামূলকভাবে ছোট শহর মারিউপোল দখল করতে তাদের দুই মাস সময় লেগেছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে হয়েছে (যদিও মারিউপোল পুরোপুরি রাশিয়ার দখলে চলে গেছে বলে আমরা এখনো নিশ্চিত নই)। এই প্রেক্ষাপটে ওডেসার মতো অনেক বড় শহর দখলের জন্য আরো একটি রাশিয়ান অভিযান অকল্পনীয় বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়া এখন আত্মরক্ষার পথ অনুসরণ করতে পারে। দিতে পারে যুদ্ধবিরতি ও শান্িত আলোচনার প্রস্তাব।

পুতিন এখন রাশিয়ান জনগণের কাছে রাশিয়ার বিজয়ের ভান করবেন। বলবেন, ক্রিমিয়ার পর ডনবাসের মতো ইউক্রেনের আরেকটি অঞ্চল তারা ছিনিয়ে নিতে পেরেছেন। তবে পুতিনের সঙ্গে পশ্চিমাদের একমত হওয়ার দরকার নেই। সত্য ঘটনা হলো, এই যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য সামরিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এতে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সুনাম বিনষ্ট হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশ্চর্যজনক গতিতে অগ্রসর হয়েছে। তৈরি করেছে রেজুলেশন। ক্রমান্বয়ে গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতেও তারা একমত হয়েছেন। এতে বোঝা যায়, ভবিষ্যতে রাশিয়ার গ্যাসের বাজার চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর অর্থ, গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা চলে যাবে চীনের কাছে এবং রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া চীনের প্রভাবাধীন হয়ে পড়বে।

রাশিয়ার এই পরাজয়ের প্রভাব বিশ্বে কতটা পড়বে? প্রথমটি হলো, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য হচ্ছে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এর মিত্রতা রক্ষা করা। এক্ষেত্রে ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্ব ইতিমধ্যে জিতেছে। আঞ্চলিক ইসু্যতে সমঝোতার ক্ষেত্রে এটি কিছুটা হলেও সুবিধাজনক হবে, যেহেতু ২০১৪ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ অঞ্চল রাশিয়ার দখলে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরো আগ্রাসনের জন্য ইউক্রেনকে একটি স্পি্রংবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল রাশিয়ার, সেটা এখন সমাপ্তির পথে। যদি রাশিয়ান সেনাবাহিনী রাশিয়া থেকে ২০ মাইলের কম দূরত্বের শহরগুলো দখল করতে না পারে, তবে এতে ন্যাটোর আক্রমণ করার সম্ভাবনা কম। রাশিয়া নিঃসন্দেহে মোল্দোভা, জর্জিয়া ও নাগোর্নো-কারাবাখের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোর প্রতিরক্ষায় মনোনিবেশ করবে। এসব অঞ্চলে ইতিমধ্যে তারা যে অবস্থান ধরে রেখেছে, তা রক্ষা করে চলবে। ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকলে জর্জিয়া ও আজারবাইজান তাদের হারানো অঞ্চলগুলো আবার বলপূর্বক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। এতে বিপদ আরো বাড়বে। এই সংঘর্ষের ফলাফল হবে আরো বিস্তৃত ও বিপজ্জনক।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হলে এই যুদ্ধের সম্প্রসারণকে ব্যাপকভাবে উত্সাহিত করা হবে। বাইডেন প্রশাসন দৃশ্যত এখন সেটিই চায়। মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব লয়েড অস্টিন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ করতে ইউক্রেন যুদ্ধকে ব্যবহার করা, যাতে রাশিয়া অন্য দেশে আক্রমণ চালাতে না পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরগুলো বলছেন, ইউক্রেনের পরিপূর্ণ বিজয়লাভে আমাদের সহায়তা করা উচিত। এর দ্বারা তারা বোঝাতে চাইছেন, ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করেছে, তা থেকে তাদের বিতাড়িত করা এবং এমন একটি অপমানজনক পরাজয়ের মাধ্যমে পুতিন সরকারকে উত্খাত করা। অবিশ্বাস্যভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের যেভাবে মার্কিন সমর্থন দেওয়া হয়েছে, এখন সেই ইতিবাচক মডেল ও যুক্তরাষ্ট্র-মধ্যপ্রাচ্য নীতির অনুসরণ করতে হবে।মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট সাময়িক অর্থনৈতিক দুর্ভোগ পশ্চিমা জনগণ মেনে নিয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, সাময়িক কষ্ট হলেও ইউক্রেনকে রক্ষা করা এবং সেখানে রুশ আগ্রাসন বন্ধ করা প্রয়োজন। অবশ্য রাশিয়াকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করা বা ধ্বংস করা একটি ভিন্ন বিষয়। এখন ইউক্রেনের প্রতি এই সমর্থন বৈধ ও জরুরি। এটি ইতিমধ্যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করেছে, লক্ষ্যটি হলো: ইউক্রেনের অধিকাংশ ভূখণ্ডের ওপর ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং আরো রাশিয়ান আগ্রাসন প্রতিহত করা।

এটি ভয়ংকরভাবে বিপজ্জনকও বটে। প্রথমত, উন্মুক্ত ভূখণ্ড জুড়ে রাশিয়ান অবস্থানগুলোতে ইউক্রেনীয়দের হামলা চালানো আর ঘনবসতি ইউক্রেনীয় শহরগুলোকে রক্ষা করা এক কথা নয়। কৌশলগত সুবিধা অনিবার্যভাবে রাশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হবে। এর ফলে ইউক্রেনের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে এবং জয়কে পরাজয়ে পরিণত করতে পারে।

অন্যদিকে, যদি ইউক্রেন পশ্চিমা সমর্থনে সম্পূর্ণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় এবং পুতিন সরকারের পতন ঘনিয়ে আসে, তাহলে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের খাতিরে ও পশ্চিমা হুমকি মোকাবিলায় এটা অসম্ভব নয় যে রাশিয়া ন্যাটোর সরবরাহ লাইন পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে শান্তি স্থাপনে বাধ্য করার জন্য ফ্রান্স ও জার্মানির বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করা। একবার ন্যাটো সদস্যদের ওপর আক্রমণ করা হলে ইউক্রেনে একটি নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে। অন্য কথায়, তখন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে স্হলভাগে সমর্থন করার জন্য মার্কিন বিমানবাহিনী পাঠানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে রাশিয়া থেকে সেই বিমানগুলো টার্গেট করে গুলিবর্ষণ করা হবে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতক্ষণ এই হতাহতের ঘটনা মেনে নেবে? তারা রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা শুরু করবে।

অতঃপর আমরা এমন একটি আশঙ্কার মুখোমুখি হব, যা শীতল যুদ্ধের সময় আট মার্কিন রাষ্ট্রপতি এড়াতে খুব যত্ন নিয়েছিলেন। এই আশঙ্কা হলো— একে অপরের ভূখণ্ডে রাশিয়া ও ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং ইউরোপে দুটি পরমাণু পরাশক্তির মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের সূত্রপাত, যা হবে ব্যাপক মানব বিধ্বংসী। মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতি থেকে এই সংযম অনুশীলন করেননি, আসলে এর সঙ্গে জড়িত শীতল যুদ্ধের ভয়ংকর ঝুঁকির হিসাব-নিকাশ। এই ভয়াবহ ঝুঁকি গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কেননা, কৌশলগত পরাজয়ের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে রাশিয়াকে আঘাত করতে সাহায্য করেছি।

লেখক: কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টের একজন সিনিয়র ফেলো এবং ‘ইউক্রেন অ্যান্ড রাশিয়া : এ ফ্রেটারনাল রিভালরি’ গ্রন্থের রচয়িতা

‘দ্য গার্ডিয়ান’ থেকে অনুবাদ: ফাইজুল ইসলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *