মৃত্যুবরণ করলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৯ বছর। সাবেক এই পাক প্রেসিডেন্ট অ্যামাইলয়েডোসিস নামক একটি বিরল রোগ নিয়ে দুবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সাবেক এই সামরিক শাসক গত বছরের জুনে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২০১৮ সালে অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এপিএমএল) ঘোষণা দেয়, তিনি বিরল রোগ অ্যামাইলয়েডোসিসে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুর পরপরই জারি করা এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতর শোক প্রকাশ করেছে।
অ্যামাইলয়েডোসিস হলো বিরল রোগ, যা সারা শরীরজুড়ে অঙ্গ এবং টিস্যুতে অ্যামাইলয়েড নামক একটি অস্বাভাবিক প্রোটিন তৈরি করে। এর ফলে অঙ্গ এবং টিস্যুগুলোর জন্য সঠিকভাবে কাজ করা কঠিন করে তুলতে পারে।
১৯৯৯ সালে দেশে সামরিক আইন জারি করার পর মোশাররফ প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে অভিশংসন এড়াতে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। পরের নির্বাচনে ভরাডুবি হয় প্রতাপশালী সাবেক এই প্রেসিডেন্টের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ হামলার পটভূমিতে পাকিস্তানের শাসনে ছিলেন চার তারকা এই জেনারেল। প্রতিবেশি আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তিনি।
২০১৬ সালে তার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং মোশাররফ চিকিৎসার জন্য দুবাই ভ্রমণ করেন। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। যদিও পরে আদালত সেই রায় বাতিল করে।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ।
এক নজরে পারভেজ মোশাররফঃ
জন্ম ও বেড়ে ওঠা: ব্রিটিশ আমলে ভারতের দিল্লিতে ১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ মোশাররফ। সাবেক এই প্রেসিডেন্টের পরিবার ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় নয়াদিল্লি থেকে করাচিতে চলে যায়। তিনি ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং আর্মি স্টাফ অ্যান্ড কমান্ড কলেজ, কোয়েটা থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন ছিলেন। তিনি করাচি এবং ইস্তাম্বুলে বেড়ে ওঠেন। তিনি তার বাবা-মায়ের দ্বিতীয় পুত্র। তার দুই ভাই, জাভেদ এবং নাভেদ।
শিক্ষাজীবন: লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে মোশাররফ গণিত নিয়ে ভর্তি হলেও পরিবারের অমতে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন ১৯৬১ সালে।
কর্মজীবন: ১৯৬৪ সালে তিনি একাডেমি থেকে ২য় লেফটেন্যান্ট হিসেবে বের হন। এই ২য় লেফটেন্যান্ট পদবীতেই তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
বিবাহ ও পারিবারিক জীবন: পারভেজ মোশাররফ ১৯৬৮ সালে সেহবাকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান, আয়লা এবং বিলা।
সামরিক বাহিনীতে পারভেজ মোশাররফ: আশির দশকে ব্রিগেডিয়ার পদবীতে তিনি একটি গোলন্দাজ ব্রিগেডের অধিনায়কত্ব করেন। নব্বইয়ের দশকে মেজর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ একটি পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়কত্ব এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বাহিনী ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’ এর প্রধান অধিনায়ক হন। পরে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি এবং ডাইরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স ডাইরেক্টরেট ছিলেন।
১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে পারভেজ মোশাররফের পদবী লেফটেন্যান্ট-জেনারেল থেকে পূর্ণ জেনারেল পদবীতে উন্নীত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং বাহিনীর প্রধান হন। পূর্ণ জেনারেল হিসেবে পারভেজ সেনাবাহিনী প্রধান এবং চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চীফস অব স্টাফ কমিটির দায়িত্ব পান।
সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ: সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার প্রায় এক বছর পর তিনি নওয়াজ শরিফকেই ক্ষমতাচ্যুত করেন। জেনারেল মোশাররফকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা ছিল পিএমএল-নওয়াজের এই নেতার জন্য একটি বাজি। কারণ তিনি জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের পাশ কাটিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে কাশ্মিরের বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। ওই ব্যর্থতার দায় একা নিতে চায়নি সেনাবাহিনী।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পারভেজ মোশাররফকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। নওয়াজ সরকারের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন জানান জেনারেল মোশাররফ।
১৯৯৯ সালে ভারতে হামলার মূল পরিকল্পনা পারভেজ মোশাররফই করেছিলেন যেটা পরে কার্গিল যুদ্ধতে রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পারভেজের তর্কাতর্কি থাকায় নওয়াজ শরিফ পারভেজ মোশাররফকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জেনারেল পারভেজ এর জবাব হিসেবে নওয়াজ শরিফকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন ১৯৯৯ সালে। শরিফ গৃহবন্দী হন এবং তাকে রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয়।
পারভেজ দেশের শাসনক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে নিজের হাতে তুলে নেন এবং ২০০১ সালে চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চীফস অব স্টাফ কমিটির পদ ছেড়ে দেন যদিও তিনি আর্মি চিফের দায়িত্বে থেকে যান।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ: ২০০১ সালের ২০শে জুন পারভেজ নিজেকে দেশের প্রকৃত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন এবং ২০০২ সালের ১ই মে তারিখে একটি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তিনি পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকবেন বলে জানান।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন: ২০১৬ সালে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং মোশাররফ চিকিৎসার জন্য দুবাই ভ্রমণ করেন। ২০১৯ দেশদ্রোহের অভিযোগে পাকিস্তানের লাহোর উচ্চ আদালতের বিচারক শহীদ করিমের বেঞ্চে পারভেজের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। তবে খুব শিগগিরই মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করা হয়।
সূত্র: ইন্টারনেট ও খালিজ টাইমস