পাকিস্তান সফর নিয়ে অনেকেই লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি প্রথমেই তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। কারণ, একজন ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট হিসেবে কাজের ব্যস্ততার কারণে আমি আলাদা আলাদা করে সময় নিয়ে লেখার ইচ্ছা থাকলেও লিখতে পারছিনা। সময় বের করা সম্ভব হচ্ছে না।
আমি ফেসবুকে পোস্ট আকারে সফরের নানা দিক তুলে ধরে লিখছি বেশ কিছু পর্বে সময় সুযোগ অনুযায়ী। কেউ সেখান থেকে নিয়ে ছাপালে আমার আপত্তি নেই। শুধু ছাপার পর আমার সঙ্গে শেয়ারের অনুরোধ থাকলো। পর্বগুলো শুরুর আগেই বলছি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের মাঝখানে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্ষমা না চাওয়ার মতো বিষয়। এসব নিয়েও আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পাকিস্তানের মানুষের ভাবনা তুলে ধরবো সাদা চোখে। নির্মোহ দৃষ্টি থেকে আমি সবগুলো বিষয় নিয়ে কথা বলবো। সেখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির নানা বিষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।

যারা আমাকে জানেন ও চিনেন তারা জানেন আমি আমার বাক্যে, কর্মে এবং চিন্তা-চেতনায় সততা ও আদর্শকে লালন করি। তাই আমি যা বলবো তা আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন। লেখা শুরু করছি…একবারও গুগল করবোনা ঠিক করেছি। যা দেখেছি যা শুনেছি তা থেকেই লিখছি…।
ইসলামাবাদ এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পরই হঠাৎ টের পেলাম ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু জ্যাকেটতো বড় ব্যাগে। কিচ্ছু করার নাই। লাগেজ থেকে জ্যাকেট বের করতে গেলে এখন বড় ধরণেরর হ্যাপা পোহাতে হবে। দরকার নাই! এটুকু ঠান্ডা সহ্য করতেই হবে। খবর নিয়ে জানলাম, আমাদের জন্য নির্ধারিত ইসলামাবাদের বিখ্যাত চার তারকা হোটেল রামাদায় এয়ারপোর্ট থেকে যেতে লাগবে মাত্র আধা ঘন্টা। সো আধা ঘন্টা গাড়িতে চুপ মাইরা পইড়া থাকো ফারুক মিয়া! সমস্যা হলো বাংলদেশ থেকে যখন পাকিস্তানের জন্য রওনা হয়েছি তখন অনেকটা শীতের শেষে বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আবহাওয়া প্রকৃতিতে দোল দিচ্ছে। সেই দোলে দুলতে দুলতে পাকিস্তান আসছি। কিন্তু এখানে ঠান্ডা এখনও কিছুটা আছে।

পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে পাকিস্তান এসেছি। জীবনে পত্থম আইলাম! এক্সাইমেন্টও আছে আবার কেমন হয় সেটা নিয়াও হালকা একটা টেনশন আছে। তবে যাই হোক খারাপ যাবেনা সময়টা সেটা বুঝলাম। এয়ারপোর্টে আমাদেরকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করেছিলেন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর মুজিব কাদির এবং এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর আমিনা ইকবাল।
হোটেলের দিকে গাড়ি ছুটছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি তার সামনেই। প্রথমে ভেবেছিলাম, প্রথম দিন তাই হয়তো এতো প্রটোকল। কিন্তু এটা যে পুরো ডেলিগেশনেই একইরকম থাকবে বুঝতাম পারি নাই! যাই হোক, সোডিয়াম আলোতে ইসলামাবাদের প্রশস্ত রাস্তা ধরে যেতে যেতে এক ভালোলাগা কাজ করছিল। আলো আধারির চমৎকার শোভা ছড়িয়ে ছিল চারদিকে। ভুলেই গেলাম নয় ঘন্টার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে ইসলামাবাদ এসেছি। ঢাকা থেকে থাই এয়ারের একটা উড়োজাহাজে প্রথমে দুই ঘন্টা ২০ মিনিটে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। সেখানে এক ঘন্টার ট্রানজিট শেষে থাই এয়ারের আরেকটা বোইং ৭৭৭ এ ব্যাংকক থেকে ৫ ঘন্টারও বেশি সময়ে ইসলামাবাদ। বিমানে দুই ঘন্টা বসে থাকার পর বোরড হয়ে গিয়েছিলাম। একেবারে পেছনটায় কজি কিচেনটায় চা খেয়ে আর আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছি। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের ডার্মাটোলজিস্ট ডা. সোহেল আর তুরুণ তুর্কি বদর। বিমানেই তাদের সঙ্গে পরিচয়।
একটা কথা আগেই বলি, পাকিস্তানের যেখানেই যান না কেনো যদি জানতে পারে আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন তাহলে আপনি যেকোনো পাকিস্তানির কাছ থেকে যে সম্মান ও এটেনশন পাবেন এতে বিমোহিত হবেন। তো ডাক্তার সাহেব আর বদর মোটামুটি পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, খাবার, কেনাকাটা থেকে শুরু করে পুরো পাকিস্তান আর ইসলামাবাদের বর্ণনা দিয়ে দিলেন। জেনে নিলেন বাংলাদেশের খবরাখরও।

হোটেল রামাদায় চলে এলাম। প্রবেশ করতেই এরিস্টোক্রেসি ভাবটা চোখে পড়বে। চারদিকে ঝলমলে আলো, ঝকঝকে, চকচকে। আমরা দশজন সাংবাদিক ছিলাম এই ডেলিগেশনে। আমি আর এনটিভির সিএনই মোঃ ফখরুল আলম কাঞ্চন ভাই একটা রুম শেয়ার করে থাকবো। সব ঠিক আছে কিন্তু হোটেলের এক রাতের ভাড়া শুনে সবার মোটামুটি পেটে একবার হলেও মোচড় দিল। প্রতিরাতে শেয়ার করা এক রুমের জন্য এখানে খরচ হয় ৪৪,০০০ পাকিস্তানি রুপি।
আমাদের জন্য কমিয়ে সেটা ৩৬,০০০ রুপি করা হয়েছে। বাঙালির স্বভাবতো জানেন। যেই দেশেই যাক খরচের হিসাব আসলেই টাকায় কনভার্ট করে দেখে অবস্থা কোন দিয়ে যাচ্ছে! আমিও তাই করলাম। হিসাব কষে দেখলাম বাংলাদেশের টাকায় প্রতিরাতে খরচ পড়বে প্রায় ভ্যাটসহ ১৮০০০ টাকা। আরও হিসাব করলাম তাহলে কাঞ্চন ভাইয়ের নয় হাজার আামর নয় হাজার! খাইছে রে!
প্রথম রাতে রুমে প্রবেশ করতেই শুধু মনে হলো ঘুম ভীষণ টানছে। কাঞ্চন ভাইয়েরও একই অবস্থা। উনার আর আমার মধ্যে একটা বিষয়ে ভীষণ মিল হলো, আমরা দুইজনই নিয়মিত নামাজ পড়ি। কোনো কারণে নামাজ মিস হলে আামদের দুইজনেরই মন খারপা হয়। তেমন বাক্যালাপ না করে গোসল সেরে রুমের জন্য দেওয়া একটা আপেল আর মাল্টা ভাগাভাগি খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম।
ভোরবেলা হঠাৎ ঘুম ভাঙলো লম্বা বিশাল সাদা পর্দার ফাঁক পেরিয়ে সূর্যের আলোতে। রাতে যে ঠান্ডাটা লাগছিল তা এখন যেন বেশ সহনীয়। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ইসলামাবাদের চারদিকেই পাহাড়। চমৎকার ভোর। তবু এখানেও এখন সবুজ কম। শীতের রুক্ষতায় খয়েরি রংই বেশি। তবুও বেশ শান্ত ও স্নিগ্ধতা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে। উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখি প্রশস্ত রাস্তাও দেখা যায়। দু একটা গাড়িও চলছে।
হোটেল রামাদায় সকালের নাশতা রুমের ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত। মনে মনে ভাবলাম আহা! টাকা কিছু বাঁচলো। বুফে নাশতা। ব্যালকনি পেরিয়ে বুফেতে এসেই ঢাকনা খুলতেই প্রথমে দেখি আস্ত নেহারি টুকরোগুলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আনলিমিটেড নিতে পারেন। এরপর গরুর গোশতের কিমা। তারপর ছোলা। তারপর মুরগির জালফ্রাই। আমি আর কাঞ্চন ভাই যে কয়েকটা দিন রামাদায় ছিলাম আমরা নেহারি খেয়েছি মন ভরে। সঙ্গে আস্ত দুটো করে ডিম পোস। পরোটা আর লুচির পাশাপাশি চমৎকার একটা রুটি বানায় এখানকার শেফ। ডেজার্টে নানা খাবারের পাশাপশি ত্বীন ফল ছিল ফেভারিট। ছিল কমলা আর আপেলের জুসও। সবশেষ চা, কফি।

প্রথম দিন আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ও সেশনে অংশ নেই ইসলামাবাদে। সেসব আলাপে যাবো না। ইসলামাবাদে গিয়ে প্রথমে যেটি ভালো লাগলো তা হলো, এখানে কেনো জ্যাম নেই। কোনো জটলা নেই, দুর্গন্ধ নেই। খুবই পরিকল্পনা করে নির্মাণ করা একটা শহর। রাস্তা খুবই প্রশস্ত। ইসলামবাদকে আসলে এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যে, এখানে এসে মানুষ কাজ করবে। কাজ শেষে আবার নিজ গন্তব্যে ফিরে যাবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানকার উন্নয়ন এবং স্থাপনা গুলোর বৈশিষ্ট্য খুবই আধুনিক।
পাকিস্তানে যে কয়দিন ছিলাম তাতে সেখানকার অন্যতম সমস্যা মনে হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। পাশাপাশি পলিটিক্যাল স্টাবিলিটির বিষয়ে সেদেশের মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে।
চলবে….
হক ফারুক
তরুণ কথাসাহিত্যিক ও কবি হিসেবে দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছেন। জন্ম ২৭ মার্চ, ১৯৮১। লক্ষীপুরের বিরাহিমপুর গ্রামে। আরমানিটোলা গর্ভমেন্ট হাই স্কুল, নটর ডেম কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সমাজ-বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও মার্কেটিংয়ে এমবিএ ডিগ্রি নিয়েছেন। বর্তমানে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে জাতীয় দৈনিক যুগান্তর-এ কর্মরত। বাবা সায়েদুল হক, মা শাহীন আরা বেগম। ভাই হক ইকবাল আহমেদ ও বোন কাবা কাওসাইন। তার স্ত্রী মেহেরী হাসান; তিন সন্তান মায়ান, ফারিন ও মাজিন। ‘জলের জমিন’ তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। প্রকাশনা: কবিতা : ‘নিঃসঙ্গতার পাখিরা’ ২০১৯ (অন্যপ্রকাশ), মেঘদরিয়ার মাঝি (২০২০) (অন্যপ্রকাশ)। গল্প : ‘শহরে দেবশিশু’ (পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স) (২০২০)। প্রবন্ধ : ‘ধীমান কথন’ ২০১৯ (বাংলানামা)। ইতিমধ্যে সিটিব্যাংক-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ পেয়েছেন।