‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ কতক্ষণ আটকে রাখতে পারে পুলিশ?

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

মুকিমুল আহসান বিবিসি

গত তিনদিনে কোটা আন্দোলনের অন্যতম ছয়জন সমন্বয়ককে তুলে নেয়ার পর তাদেরকে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ আটকে রেখেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবি। তাদের কাউকে নেয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায়, কাউকে বাসার গেট ভেঙ্গে তুলে আনা হয়েছিল ডিবি কার্যালয়ে।

আটকের পর ডিবি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নেয়া হয়েছে পুলিশি হেফাজতে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কাউকে নিরাপত্তা হেফাজতে কতক্ষণ আটকে রাখা যায়?

আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেফাজতের নামে কাউকে নিয়ে যাওয়ারই কোন আইন নেই। যদি সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার করতে হয় তাহলেও তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই।

আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে পরিষ্কার করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে প্রডিউস করতে হবে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের আদালতে তোলা হয় নি”।

রোববার নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওই সমন্বয়কদের সাথে পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে চাইলে তাদের সে সুযোগ দেয়া হয়নি।

তবে, ডিবি অফিসে ওই সমন্বয়কদের খাইয়ে তাদের সাথে কয়েকটি ছবি তুলে ও ভিডিও করে তা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।

এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিরাপত্তা হেফাজতে এর আগে এক বিএনপি নেতাকে খাইয়ে ছবি তুলেছিলেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

সোমবার আটক ওই সমন্বয়কদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে একটি রিট করা হয়।

ওই রিটের শুনানিতে, গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে খাইয়ে সেই ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে মশকরা বলে মন্তব্য করে হাইকোর্ট।

পুলিশ হেফাজতে থাকা নিয়ে আইন কী বলছে?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারকে কে গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবি।

শনিবার রাতে আটক করা হয় অন্যতম আরো দুইজন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে।

রোববার ভোরে আটক করা হয় আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে। মিরপুরের একটি বাসার গেইট ভেঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

গত শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত সবাই রয়েছে গোয়েন্দা হেফাজতে। তাদের আদালতে হাজির করা হয়নি বা কোন মামলায় আটক বা গ্রেফতারও দেখানো হয়নি।

তাদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ পুলিশ ‘হেফাজতে’ রেখেছে বলে দাবি করেছেন ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা হেফাজত বলতে আইনে কিছু নেই। হয় তাদের গ্রেফতার দেখাতে হবে, না হয় তাদের ছেড়ে দিতে হবে।

যদি নির্দিষ্ট মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাজির করতে হবে আদালতে।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৩৩ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘গ্রেফতারকৃত কোনও ব্যক্তিকে যথাসম্ভব গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ ও তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নিরাপত্তা হেফাজত একমাত্র আদালতের আদেশে হতে পারে। এখানে কোন আদালতের আদেশ ছিল না”।

“আটক বা গ্রেফতার করেন বা নিরাপত্তা হেফাজতে নেন আপনাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা আছে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ এর ২ ধারায় এটা বলা আছে। এভাবে আটকে রাখা সংবিধান লঙ্ঘন” বলছিলেন মি. নজরুল।

আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যদি সন্দেহবশত কাউকে গ্রেপ্তার করতে হয় তাহলেও তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখার সুযোগ নেই। কাউকে নিরাপত্তার জন্য জেলে আটকে রাখার হাস্যকার যুক্তি ইতোপূর্বে কখনো শুনিনি”।

‘সমন্বয়কদের খাইয়ে ছবি তোলা জাতির সাথে মশকরা’

গত তিন দিনে বিভিন্ন জায়গায় থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ঢাকার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আনা হয়।

রোববার রাতে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ নিজ ফেসবুক পেজ থেকে ওই ছয় আন্দোলনকারীদের সাথে খাবার টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার কয়েকটি ছবি ও দুইটি ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করেন।

এই ছবি প্রকাশ করে তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন, “কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই ওদের ডিবি কার্যালয়ে এনে তাদের সাথে কথা বললাম”।

এর কিছুক্ষণ পর এই সমন্বয়কদের একটি ভিডিও বার্তা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, যেখানে নাহিদ ইসলাম কর্মসূচি প্রত্যাহারের একটি লিখিত বার্তা পাঠ করতে দেখা যায়। ‘অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে’ ওই বার্তা পাঠ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অন্য কয়েকজন সমন্বয়ক।

এর আগে গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার রাস্তায় আহত অবস্থায় বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গোয়েন্দা হেফাজতে আনা হয়েছিল। তখনও খাবার টেবিলে ছবি তুলে একই ভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল ফেসবুকে।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় ডিবি কার্যালয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে অনেকের খাবার ছবিও বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে গত কয়েক মাসে।

কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের হেফাজতে রেখে খাবার টেবিলে ছবির বিষয়টি নিয়ে রোববার রাতে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়।

অধ্যাপক নজরুল বিবিসি বাংলাকে বলন “এই জিনিসটা আমরা সামরিক শাসন আমলে দেখেছি, ওয়ান ইলেভেনের সময়ও এটা দেখা গেছে। তাদের সম্মতি ছাড়া ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রাইভেসি লঙ্ঘন বলেই আমরা কাছে মনে হয়”।

ডিবি হেফাজতে নেয়া সমন্বয়কারীদের ছেড়ে দেয়া ও শিক্ষার্থীদের গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে সোমবার দুপুরে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন দুইজন আইনজীবী।

শুনানিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ সমন্বয়কদের খাইয়ে সেই ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে মশকরা বলে মন্তব্য করেন।

ডিবি হেফাজতে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা নিয়ে যে প্রশ্ন

রোববার দুপুরে ওই ডিবি হেফাজতে থাকা ওই ছয়জন সমন্বয়কের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে গেলে তাদের ডিবি কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ নাহার।

রাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মি. রশীদ খাবার টেবিলে সমন্বয়কদের ছবি প্রকাশের কিছুক্ষণ পর পুলিশ হেফাজতে থেকে একটি ভিডিও বার্তায় নাহিদ ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলন তুলে নেয়ার বার্তা দেন।

এ সময় তার পাশে ডিবি হেফাজতে থাকা অন্য পাঁচ সমন্বয়ককে বসে ছিল।

হেফাজতে থেকে ছয় সমন্বয়কের এই ছবিকে ‘সাজানো’ এবং ‘জিম্মি করে’এই বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন আত্মগোপনে থাকা অন্য দুই জন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসুদ।

পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আন্দোলনের প্রত্যাহারকে জোরপূর্বক মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অধ্যাপক নজরুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তাদেরকে ধরে নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে না দিয়ে যেভাবে ক্যামেরার সামনে এটাকে রিড আউট করা হয়েছে। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেছে”।

বিষয়টিকে প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনের এই অধ্যাপক।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সোমবার বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের সাথে। ফোন ধরলেও তিনি কোন মন্তব্য করেন নি।

তবে সোমবার ডিবি কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময়- কোটা সংস্কার আন্দোলন বন্ধে জোর করে ছয় সমন্বয়ককে আটকে রাখা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “ডিবি একটি আস্থার জায়গা। সেখানে কাউকে আটকে রাখা হয় না। জোর করে বিবৃতি নেয়া হয় না।”

শিগগিরই পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস

রোববার পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে গিয়ে ফিরে গেলেও সোমবার সকালে সমন্বয়কদের পরিবারের সদস্যদের সাথে করতে দেয়া হয়।

এদিন সমন্বয়কদের সাথে পরিবারের সদস্যরা দেখা করার পর ডিবি কার্যালয়ের সামনে তারা গণমাধ্যমের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বস্তি প্রকাশ করেন।

পরে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।

সেই সময় মি. রশীদ বলেন, “আমরা তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছি। খুব শিগগিরই তারা পরিবারের কাছে চলে যাবে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *