নিরপরাধ মানুষ যাতে অভিযুক্ত না হয় তা শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান রাজধানী ঢাকার গুলশান লেকশোর গ্রান্ড হোটেলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক, প্রধান নির্বাহী, বার্তা সম্পাদক ও চীফ রিপোর্টারদের সাথে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশে প্রধানত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এই চার ধর্মের লোক বসবাস করেন। আমাদের কথা খুব পরিষ্কার, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ। এখানে ধর্ম বা দলের ভিত্তিতে বিভক্ত করা চরম অন্যায়। আর যে জাতি এ ধরনের বিষয় নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সে জাতি একটা দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়। আমাদের পারস্পরিক বিভক্তির কারণে আমাদের প্রতি অন্যদের মাতব্বরি করার সুযোগ তৈরি হয়। আমরা পরস্পর বিভক্ত হয়ে এ মাতব্বরির সুযোগটা তৈরি করে দিই। আমরা মনে করি, যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত সেখানে বিভক্তি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এ জায়গাটায় আমাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা আর কোনো ধরনের বিভক্তি চাই না। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর একজন নিরপরাধ মানুষ যাতে অভিযুক্ত না হয় তা শতভাগ নিশ্চিত হতে হবে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ সাবেক এমপি, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও এডভোকেট মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে দেশ ও জাতি গঠনে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি পরামর্শ ও করণীয় বিষয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিগণের মধ্যে বক্তব্য প্রদান করেন দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন, বিএফইউজে’র সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আব্দুল হাই শিকদার, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম এ আজিজ, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার নির্বাহী যুগ্ম সম্পাদক শামীমুল হক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, বাংলা ভিশনের প্রধান সম্পাদক ড. আব্দুল হাই সিদ্দিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হাসান আহমদ কিরণ, প্রবীণ সাংবাদিক সাবেক ডিইউজে’র নেতা এলাহী নেওয়াজ। উপস্থিত ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, দৈনিক কালবেলা সম্পাদক ও প্রকাশক সন্তোষ শর্মা, আমার সংবাদ সম্পাদক হাশেম রেজা, নয়া শতাব্দী সম্পাদক নাঈম সালেহীন, ডেইলি স্টারের বিশেষ সংবাদদাতা রাশেদুল হাসান প্রমুখ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।

জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, “আমাদের প্রিয় সমাজ, জাতি ও দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজের যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রয়েছে, তার মধ্যে সাংবাদিকতা বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। সমাজের দুটি অংশের একটি সাংবাদিকতা ও আরেকটি রাজনীতি। এই দুইটি ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্টগণ যখন সমন্বিতভাবে কাজ করেন, তখন সমাজটা কাঙ্ক্ষিত সমাজে পরিণত হয়। আর যেখানে এই বুঝাপড়ার ব্যত্যয় ঘটে সেখানে সমাজকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। জাতির ক্রান্তিলগ্নে এই দুই ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হয়।

জামায়াত নেতা বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এদেশের বুকে গড়ে উঠা সংগঠন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে বুকে ধারণ করে দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আপনাদের সমালোচনা, পরামর্শ আমাদের চলার পথকে সহজ করবে। আমরা জাতি হিসেবে এক। আমরা কোন বিভক্তি চাই না। আসুন আমরা শপথ নিই, আমরা জাতির স্বার্থে সর্বদা এক থাকব।”

তিনি আরও বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত সাড়ে ১৫টি বছর আমরা আমাদের মুখের ভাষা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের কর্মের বিষয়গুলোতে আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। আমরা মিডিয়াগুলোতে আমাদের বক্তব্য পাঠাতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেখানে যে কারণেই হোক আপনাদের মনের আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করতে পারেননি বলে আমরা ধারণা করি। এ না পারার জায়গাটা চিরতরে বিলীন হয়ে যাক, নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়ে যাক আমরা দোয়া করি। আমি ব্যক্তি হিসেবে এবং আমাদের দল ভুলের ঊর্দ্ধে নয়। আমাদের ভুল কেউ ধরিয়ে না দিলে, আমরা তো ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে যাব। আসুন আমরা সমাজের সব হাতগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসি। শপথ নেই, আমরা জাতীয় স্বার্থে এক। এ জায়গায় আমরা কম্প্রমাইজ করব না। এটা কারো পক্ষে বা বিপক্ষে গেলেও এতে আমাদের কিছু আসে যায় না।

ডা. শফিক বলেন, সবকিছুর ঊর্দ্ধে জাতীয় স্বার্থ। আপনাদের কলম মুক্ত ও শাণিত হোক। আপনাদের মুখগুলোও মুক্ত ও স্বাধীন হোক। সকলের চিন্তা ও মুখ খোলাসা হোক এবং আমরা যেন নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারি। একজন কৃষকও যেন নির্ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারে, লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যেতে পারে। একজন পিয়ন যেন ভয়ের সংস্কৃতিতে না থাকে, তাকে যেন বসের দাসে পরিণত হতে না হয়। সমাজের শাসকরা যেন প্রভু বনে না যান। তারা যেন নাগরিকদের অধীনস্ত দাস মনে না করেন। বরং নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে তারা বাধ্য হন এবং নাগরিকদের কাছেই তাদের জবাবদিহি করতে হবে এই অনুভূতি জাগ্রত হোক আমরা সেই দোয়া করি। সবকিছুর ঊর্দ্ধে আমাদের জাতীয় স্বার্থ- আল্লাহ তাআলা আমাদের এটা বুঝার এবং এক সাথে কাজ করার তাওফীক দিন। আমীন।”

আমীরে জামায়াত বলেন, “যে সমাজে সকলেই নিগৃহীত হন, সাংবাদিকরাও সেখানে নিগৃহের শিকার হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ সাংবাদিকগণও তো সমাজেরই অংশ।
সকল সরকারই একটা কথা বলেছে- আমাদের দেশের সাংবাদিকতার জগৎ স্বাধীন। এটা বাহিরে বলা হয়েছে, ভেতরের চিত্র আপনারা আমার থেকে অনেক ভালো জানেন।
এমন একটা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে একটা দেশ এগিয়ে যাবে, সেটি জনগণকে স্বস্তি দেবে এটা অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে করি। তিনি বলেন, আমাদের দলও যদি ক্ষমতায় যায় তাহলে আমরাও যেন বস্তুনিষ্ঠতা এবং উদারতাকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারি। অতীতে অমুক এমন কাজ করেছে, সুযোগ নিয়েছে, এজন্য আমাকেও এটা করতে হবে- এই দর্শনে আমরা বিশ্বাস করি না। এই জায়গাগুলো আমাদের জাতীয়ভাবে গ্রহণ করা উচিত। আমরা জাতীয় স্বার্থে এক। এই জায়গায় আমরা কোনো আপস করবো না। যার বিপক্ষে যাক আর পক্ষে যাক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের জাতীয় স্বার্থ। আমরা যেন সবাই নির্ভয়ে তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারি।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশটা আমাদের সবার। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এটা সবার দেশ। যখন একদল বলে পাকিস্তানি রাজাকার, একদল বলে হিন্দুস্তানি রাজাকার- খুব কষ্ট হয়। আমার দেশের জনগণকে আমি কেন আরেক দেশের দালাল বানাচ্ছি, রাজাকার বানাচ্ছি? এটা যারা করেন তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত। যে জাতি তার নাগরিককে স্বীকৃতি দেয় না, সেই জাতি বিশ্বের দরবারে সম্মান পাবে কীভাবে? সমাজে একটা কথা চালু আছে, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু। এই শব্দের মাধ্যমে একটা সমাজকে বিভক্ত করা হয়। আমরা এই কনসেপ্টের সঙ্গে একমত না। এই মাইনোরিটি-মেজোরিটির স্লোগান আমাদের দেশে যত ওঠে, দুনিয়ার আর কোনো দেশে ওঠে কিনা আমি জানি না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমরা সকলে যেন সজাগ হই। এবার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পাহারা দেয়ার জন্য আমাদের দল, বিএনপি, ছাত্রদলসহ মাদ্রাসার ছাত্ররাও ছিল। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে কাউকে পাহারা দিতে হবে কেন? এই সংস্কৃতি উঠে যাক সেটা আমরা চাই। সবাই যেন নিরাপত্তার গ্যারান্টি পায়। আমরা বিশ্বের সকল শান্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। আমরা সকলের মর্যাদা রক্ষার পক্ষে এবং আমাদের নিজেদের মর্যাদা পাওয়ার পক্ষে। এক দল শুধু দিয়ে যাবে আরেক দল শুধু পেয়ে যাবে, এটা কিন্তু জাস্টিস না। এটা মিউচুয়াল হতে হবে এবং মিউচুয়াল রিলেশন যখন ভালো থাকে তখন সবাই ভালো থাকে।

জামায়াতকে নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই মাসের ১ তারিখে আমাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যে ছাত্র সংগঠনটি আমাদের ভালোবাসে আমরাও তাদের ভালোবাসি, তাদের নিষিদ্ধ করা হলো। কোন প্রেক্ষাপটে? যখন অধিকারের দাবিতে সারা জাতি ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলনের ইস্যু ভিন্ন দিকে নিতেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি, ২৭ দিন আমাদেরকে নিষিদ্ধ করে যে জুলুম করা হয়েছিল সেটি ইতিমধ্যে প্রত্যাহার হয়েছে।

সকল রাজনৈতিক দলকে জামায়াতে ইসলামীর তরফ থেকে মাফ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের সাক্ষী রেখে বলছি- রাজনৈতিক দল হিসেবে কারও প্রতি আমাদের কোনো ক্ষোভ নাই। আমরা সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। যিনি নির্দিষ্ট ক্রাইম করেছেন, তার ওই নির্দিষ্ট ক্রাইমের শাস্তি যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে সমাজের সংশোধন হবে না। তখন পাবলিক বেপরোয়া হয়ে যাবে। এজন্য এটা ন্যয্যতার দাবি, ন্যায় বিচারের দাবি, সামাজিকতার দাবি, শান্তির দাবি। তিনি বলেন, সেই ক্ষেত্রে ভিকটিমরা যদি সঙ্গত উদ্যোগ নেয়, সেই উদ্যোগে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক সকলকে সাপোর্ট করা হবে। কিন্তু তারা অসৎ পথে কিছু করলে তাদের সঙ্গে আমরা নেই। একটা হত্যা মামলায় ৫০০ জনকে আসামি করা হচ্ছে, এটা কতোটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে আমাদের সকলের চিন্তা করা উচিত। এতে মূল ব্যক্তির বেঁচে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের সংগঠকদের বলেছি- আমরা সবার চাইতে মজলুম বেশি, সিম্বোলিক কিছু মামলাই মানুষের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *