নতুন দলের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’, গণপরিষদ যেভাবে দেখছে অন্যরা

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা,ডিডাব্লিউ :

তরুণদের নতুন দলের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার লক্ষ্যকে রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসাবে দেখছে অন্য দলগুলো৷ তবে সরকার তাদের দাবির প্রতি ঝুঁকলে রাজনৈতিক সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷

ঘোষিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতারা বলছেন, বিষয়গুলো নিয়ে তারা জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করবেন৷ তারা আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করবেন৷ সেটা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন৷ তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন সরকার যদি এসনিপির দাবি অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে যায়, জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেয় তাহলে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পরে৷

কী চায় এনসিপি?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছে শুক্রবার৷ ঢাকা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক সমাবেশের মাধ্যমে ১৭১ সদস্যদের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে নতুন এই দলটি যাত্রা শুরু করেছে৷ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন৷ তিনি তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এই দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে৷ ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার৷

নতুন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা জুলাই বিপ্লব এবং ২০২৪ এর চেতনায় একটি দেশ গড়তে চাই৷ সেজন্য আমরা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলেছি। এজন্য সংবিধান নতুন করে প্রণয়নের দরকার৷ আমরা যে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছি সেটা সাম্য, মানবিক ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে৷ এর সঙ্গে আছে সামাজিক সুবিচার৷ আমাদের যে সংবিধান আছে সেটা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করে না৷ এজন্যই আগে সংবিধান পরিবর্তন করা দরকার৷ আমাদের যে রিপাবলিক আছে তা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাইবো জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে৷ সেটা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি আমরা ক্ষমতায় যেতে পারি তাহলে আমরা যা চাই তা বাস্তবায়ন করবো,” বলেন তিনি৷

শিক্ষার্থীদের নতুন দলকে কিংস পার্টির সঙ্গে তুলনা করা নিয়ে মনিরা শারমিন বলেন, “আমরা কোনা কিংস পার্টি নই৷ আমরা সরকার বা কোনো দলের আনুকুল্য চাই না৷ আমরা আমাদের এজেন্ডা নিয়ে মানুষের কাছে যাব৷ জনমত গঠন করবো৷”

নির্বাচন নিয়ে অবস্থান ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে চলতি মার্চ মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবী করেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এ মাসের (মার্চ) মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার (অন্তর্বর্তী সরকারের) পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে৷ অন্যথায় সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷’’

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘‘আমরাও নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবো৷ আমরা মাঠে আন্দোলন করবো৷ মানুষের কাছে যাব৷ তারপর যদি জাতীয় ঐকমত্য হয় তাহলে আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবো৷”

তিনি জানান সেটি সম্ভব না হলে তারা জাতীয় নির্বাচনে যাবেন৷ ‘‘সেখানে যদি আমরা দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাই তাহলে আমরা যেভাবে চাই সেভাবেই হবে,” বলেন তিনি৷

নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ধরনের দাবিতে বিএনপির সাথে সংঘাতের আশঙ্কা অবশ্য দেখছেন না এনসিপির এই দুই নেতা৷ তাদের আশা তারা নিজেদের দাবির পক্ষে জনগণের সমর্থন পাবেন৷ সেক্ষেত্রে অন্য দলের কিছু বলার থাকবে না৷

নতুন দলের দায়িত্ব নেয়ার আগে উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান নাহিদ ইসলাম৷ কিন্তু এখনও বৈষম্যরিবোধী ছাত্র আন্দোলনের আরো দুই নেতা সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রয়ে গেছেন৷ নতুন দলে যোগ দেয়ার ঘোষণা তারা দেননি৷ এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে এনসিপির সম্পর্ক কেমন হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘‘অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যেমন সম্পর্ক আমাদেরও তাই৷ আমরা আমাদের দাবী নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করবো৷৷

তিনি জানান, তারা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে দলের নিবন্ধন নেবেন। আর মনিরা শারমিন বলেন, দলের প্রতীক এখনো চূড়ান্ত না হলেও তারা কাজ করছেন৷ মানুষ পছন্দ করে এমন একটা প্রতীক তারা চূড়ান্ত করবেন।

বিএনপি ও অন্যদের ভাবনা

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এনসিপির ঘোষিত লক্ষ্যগুলো নিয়ে বলেন, ‘‘তারা এখন একটি রাজনৈতিক দল। তারা কর্মসূচিতে ওইসব কথা বলেছে৷ এখন তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাবে৷ মানুষ যদি তাদের কর্মসূচি গ্রহণ করে৷ আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায় তাহলে তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে৷ তারা তখন যা করতে চাইবে তা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে করতে পারবে।”

তবে তিনি মনে করে জাতীয় নির্বাচন বাদ দিয়ে দলটি সংবিধান ও পণপরিষদ নিয়ে চাপ দিলে তাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে৷ বলেন, “দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এখন জাতীয় নির্বাচন চায়৷ এখন যদি সেটা না করে তাদের দাবী মতো সরকার জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের দিকে যায় বা যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে নানা ধরনের রাজনৈতিক সংকট হবে, সংঘাত হবে৷ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এটা রাজনৈতিক সরকার নয়। এটা একটা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার৷ তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাদের কোনো কাজ তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে৷”

গণপরিষদ নির্বাচন ও সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে নতুন দলের এজেন্ডা ও বিএনপির অবস্থান স্পষ্টই ভিন্ন৷ দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-তরুণদের একাংশ নতুন রাজনৈতক দল গঠন করেছে। সেটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তারা যে কর্মসূচির কথা বলছে তা বাস্তবায়নের পথ হলো জনগণের ম্যান্ডেট নেয়া। এখন দেশে একটি সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের অধীনে নতুন করে সংবিধান রচনা ও গণপরিষদ নির্বাচনের সুযোগ নেই৷ আর তারা যদি বলে সেকেন্ড রিপাবলিক, আমি তো বলব থার্ড রিপাবলিক৷ কারণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় রিপাবলিক হয়ে গেছে৷ আর গণপরিষদ নির্বাচনের দরকার নাই। কারণ জাতীয় নির্বাচনেই ফয়সালা হতে পারে।”

বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এবং সংকট থেকে বের হতে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দরকার। সেটা না হলো রাজনৈতিক সংঘাত তো পরের কথা, সংবিধানে গণপরিষদ নির্বাচনের কোনো সুযোগই নাই। আর কিংস পার্টি নিয়ে যে কথা হচ্ছে সেটার সাথে যে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সংযোগ নেই সেটাও তাদের প্রমাণ করতে হবে।”

নতুন দল কি সরকারের আনুকূল্য পাচ্ছে?

শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান মনে করেন, এনসিপির লক্ষ্য অনুযায়ী ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ করতে হলে সংবিধান বাতিল করতে হয়। যারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন তারা সেটা পারেননি৷ তারা সেটা স্বীকারও করেছেন৷ এখন তারা সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন চান৷ সেটার জন্য তারা গণপরিষদ নির্বাচন চান৷ এজন্য তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে৷ কিন্তু আসলে সেটা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়৷ এখন উপায় হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সেটা যদি হয়, তারা তাতে অংশ নিয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে৷”

ড. জাহেদ উর রহমানের মতে সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিকের মতো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক দ্বিমত আছে৷ নতুন রাজনৈতিক দলটি এজন্য সরকারকে চাপ দিলে এবং সরকার তাদের দিকে ঝুঁকে পড়লে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা দেখেন তিনি৷

দলটির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘নতুন দলের (এনসিপি) সম্মেলনে আসার জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটির জন্য পিরোজপুর জেলার ডিসি ছয়টি বাস রিক্যুইজিশন করেছেন বলে তার আদেশের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে৷ সেপ্টেম্বর মাসের দিকে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়, ছাত্র সমন্বয়কদের প্রটোকল দেয়ার জন্য৷ ফলে তাদের প্রতি যে সরকারের আনুকূল্য আছে তা বোঝা যায়৷ এখান থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ আর তারা নির্বাচন পেছানোর নানা ইস্যু তৈরি করতে পারে৷ যেমন তারা বলছে বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন নয়। তাহলে নির্বাচন কবে হবে? … প্রধান উপদেষ্টা বলছেন সংস্কারের ব্যাপারে সবাই যদি একমত হতে না পারেন তাহলে তিনি নির্বাচন দিয়ে চলে যাবেন। ফলে নানা ইস্যুর ব্যাপারে সরকারকে নিরপেক্ষতা দেখাতে হবে৷’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *