দাবানল কি ও কেন হয়?

ফিচার সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

লস অ্যাঞ্জেলেসের চলমান দাবানল দুর্যোগের বিধ্বংসী প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বকে। ৭ জানুয়ারি থেকে প্যালিসেডে শুরু হওয়া এই অগ্নিকাণ্ড বনাঞ্চল ছাড়িয়ে আশপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। উষ্ণ সান্তা আনা বাতাসের প্রভাবে দীর্ঘদিনের উত্তপ্ত অবস্থা থেকে উৎপত্তি এই দাবানলের।

উত্তর আমেরিকার গ্রেট বেসিন নামক বিস্তৃত মরু অঞ্চল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে ধেয়ে আসে এই গরম বাতাস। এখন পর্যন্ত দাবানলে ২৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে।

দাবানল কি শুধুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়? দাবানল সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ খুঁজে দেখার পাশাপাশি চলুন, ইতিহাসের সর্বাধিক প্রাণহানী ঘটানো দাবানলগুলো সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।

দাবানল কি এবং কেন হয়

শুষ্ক বনাঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপের রেশ ধরে সৃষ্ট আগুন গোটা বন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দাবানল হিসেবে পরিচিত। বনের ভেতরে ঘন ঝোপঝাড় এবং পরস্পর সংস্পর্শে থাকা গাছপালা স্বতঃস্ফূর্ত দহনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এমতাবস্থায় ছোট একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট পুরো বনভূমিকে অঙ্গারে পরিণত করার জন্য। এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নেপথ্যে প্রাকৃতিক ও মনুষ্য ঘটিত উভয় কারণই থাকতে পারে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ফুলিঙ্গের সাধারণ প্রাকৃতিক কারণ থাকে বজ্রপাত। মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাম্প ফায়ার, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।

দাবানলের ব্যপ্তি কতটা জায়গা জুড়ে হবে তা স্থানটির ভৌগলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। যেমন আশপাশের কোনো স্থান থেকে শুষ্ক ও উত্তপ্ত বাতাসের চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন, ও দীর্ঘস্থায়ী খরা। এসব কারণে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বনসহ আশপাশের অঞ্চলগুলোকে অধিক শুষ্ক করে রাখে।

উষ্ণ বাতাসের স্থায়ীত্বের সঙ্গে আগুন জ্বলতে থাকার মাত্রা সমানুপাতিক হারে বাড়ে। তাছাড়া ছোট একটি জায়গায় আগুন লাগলে তার আশপাশের পরিবেশ এমনিতেই উত্তপ্ত হতে থাকে। এমন সময় সেখানে থাকা তাপ পরিবাহী বস্তুগুলো আবহাওয়া উষ্ণ রাখার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। বাকি থাকে শুধু একটি সহায়ক মাধ্যম যার উপর দিয়ে আগুন নিমেষেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। এই অনর্থ সংঘটনের জন্য বন-জঙ্গল সব থেকে আদর্শ জায়গা। গায়ে গায়ে লেগে থাকা গাছপালা এখানে রীতিমত বৈদ্যুতিক তারের ভূমিকা পালন করে। একবার আগুন লেগে গেলে তা অনেক দূর পর্যন্ত নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে। চরম অবস্থায় এই আগুন আশপাশে থাকা গ্রাম বা শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসের কারণ হয়।

স্মরণকালের সব থেকে ভয়ানক কয়েকটি দাবানল

সবচেয়ে বেশি প্রাণহানীর বিচারে এই তালিকার শীর্ষস্থানীয় ঘটনাটি হচ্ছে ১৮৭১ সালের আমেরিকার গ্রেট ফায়ার্স। এটি ছিল মূলত কয়েকটি দাবানলের এক ভয়াবহ সমন্বয়, যা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছিল আমেরিকা ও কানাডার কিছু অংশকে।

শুরুটা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর মিনেসোটা থেকে। সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারি ঘটনা ঘটে ৮ থেকে ৯ অক্টোবরে, যখন আমেরিকার উইস্কন্সিন, ইলিনয়, মিশিগান এবং কানাডার অন্টারিওতে একযোগে দাবানল শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক ছিল উইস্কন্সিন এবং শিকাগোর ঘটনা, যেগুলো যথাক্রমে পেশটিগো ফায়ার এবং গ্রেট শিকাগো ফায়ার নামে পরিচিত।

প্রচণ্ড খরা, প্রবল বাতাস এবং জঙ্গলগুলোতে শুক্নো কাঠের অবশিষ্টাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্মিলিতভাবে এগুলো জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। সঙ্গত কারণেই দাবানলের দানবীয় রূপ পেতে খুব একটা সময় লাগেনি। এক পেশটিগো ফায়ারেই জীবন যায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ লোকের। প্রায় ১২ লাখ একরেরও বেশি জায়গা ধ্বংস করে দুর্বল হতে শুরু করে দাবানল।

শিকাগোর অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়, ৩ বর্গমাইল জায়গা পুড়ে যায় এবং ১ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। পুরো আমেরিকা ও কানাডা মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিপর্যয়কারী ঘটনাটিও ঘটে আমেরিকায় ১৯১৮ সালে, যেটির নাম ক্লোকেট ফায়ার। দীর্ঘ দিন যাবত গাছ কেটে কাঠের স্তুপ বাড়ানোর ফলে উত্তর-পূর্ব মিনেসোটা রীতিমত দাহ্য অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া অক্টোবরের সময় আমেরিকার মধ্য-পশ্চিম রাজ্যটি এমনিতেই শুষ্ক হয়ে থাকে।

১০ অক্টোবর ক্লোকেট শহরে একটি ট্রেনের স্ফুলিঙ্গ থেকে সূত্রপাত ঘটে আগুনের। ১২ তারিখ নাগাদ এই আগুনের ধ্বংসলীলার শিকার হয় আশপাশের বন এবং অবারিত কৃষিজমি। প্রবল বাতাস প্রজ্জ্বলনকে সঙ্গে নিয়ে মুস লেক ও গোটা ক্লোকেটের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে পুড়ে যায় ২ লাখ ৫০ হাজার একর জায়গা। ধ্বংস হয় ৫২ হাজার ঘরবাড়ি এবং মারা যায় ৪৫৩ জন।

মৃত্যু সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে থাকলেও ১৯৮৭-এর ব্ল্যাক ড্রাগন ফায়ার হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম দাবানল। উত্তর-পূর্ব চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) সহ মোট ১৮ মিলিয়ন বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়া এই দাবানলে মারা গিয়েছিল ২১১ জন। ৬ মে থেকে শুরু হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের স্থায়ীত্ব ছিল ২ জুন পর্যন্ত।

দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং জঙ্গলে কাঠের স্তুপ করে রাখার কারণে চীনের হেইলংজিয়াং প্রদেশ জুড়ে দুর্যোগ প্রবণ পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। পুড়ে যাওয়া ১৮ মিলিয়ন একর বনাঞ্চলের মধ্যে ১৫ মিলিয়নই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আর চীনের অংশ ছিল ৩ মিলিয়ন। তবে অবকাঠামো ও অর্থনৈতিকভাবে দুই দেশেই যথেষ্ট ক্ষতি সাধন হয়েছিল। আগুনে হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬৬ জন এবং গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার।

চতুর্থ স্থানে রয়েছে ২১ শতকের সবচেয়ে ভয়ানক দাবানল অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক স্যাটার্ডে বুশফায়ার। ২০০৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া রাজ্য জুড়ে আগুনের তান্ডবলীলা হতবাক করে দেয় গোটা বিশ্বকে।

মৌসুমটিতে স্থানটির তাপমাত্রা বিগত সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৪৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দমকা বাতাসের প্রবাহ ও দাবদাহ প্রদেশের সর্বত্রে ছড়িয়ে থাকায় আকস্মিক স্ফুলিঙ্গ নিমেষেই রূপ নেয় দানবীয় দাবানলে। এই অগ্নিকাণ্ড ১১ লাখ একরেরও বেশি জায়গা গ্রাস করে ফেলে। মেরিস্ভিল ও কিংলেকের মতো শহরগুলোকে নরকে পরিণত করে। ২ হাজারেরও বেশি বাড়ি ধ্বংস হয় এবং প্রাণ হারায় ১৭৩ জন।

তালিকার সর্বশেষ দাবানলটি হল ১৮২৫ সালে হয়ে যাওয়া কানাডার গ্রেট মিরামিচি ফায়ার। ৭ অক্টোবরে সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডের প্রভাবে দেশটির নিউ ব্রান্সউইকের বিস্তীর্ণ অংশ ভস্মস্তুপে রূপ নেয়।

এর সূত্রপাতের নেপথ্যেও স্থানীয় শুষ্কতা ও দমকা বাতাসের সঙ্গে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নির্বিচারে বন উজাড় করা। এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লেলিহান শিখায় রূপ নিয়ে প্রায় ১৬ হাজার বর্গকিলোমিটার জমি গ্রাস করে নেয়। এর মধ্যে ছিল নিউক্যাসল এবং ডগলাসটাউনের মতো শহরগুলো, যেগুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত দমকা হাওয়ায় আগুন বসত-বাড়ি ও খামারসহ সবকিছু পুড়িয়ে দিয়ে যায়। এতে কমপক্ষে ১৬০ জন বাসিন্দা প্রাণ হারায়।
পরিশিষ্ট

দাবানল হল একটি ধ্বংসাত্মক অগ্নিকাণ্ড, যা সাধারণত বন, তৃণভূমি বা শুকনো অঞ্চলগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটি প্রাকৃতিক কারণে ঘটতে পারে বা মানুষের কার্যকলাপের কারণে সৃষ্টি হতে পারে।

ইতিহাসের ভয়াবহ এই দাবানলগুলো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর বিপুল সংখ্যক প্রাণহানীর কারণ হয়েছে। যার মধ্যে সর্বাধিক মরণাত্মক দুটোই সংঘটিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৭১-এর গ্রেট ফায়ারে পেশটিগো, শিকাগো, মিশিগান এবং অন্টারিওর দাবানলে মৃত্যুসংখ্যা সব মিলিয়ে ছিল প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি।

অপরদিকে, ১৯১৮’তে মিনেসোটার ক্লোকেট ফায়ার-এ নিহতের সংখ্যা ৪৫৩। ১৯৮৭’তে চীন ও রাশিয়া জুড়ে ব্ল্যাক ড্রাগনের অগ্নিতাণ্ডবে ২১১ জন মারা যায়। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক স্যাটার্ডে বুশফায়ারে ১৭৩ জন এবং ১ হাজার ৮২৫-এ কানাডার মিরামিচি ফায়ারে ১৬০ জনের প্রাণ যায়। দাবানলের এই ভয়াবহ রেকর্ডগুলো এখনও সভ্যতার অবিরাম ক্রমবিকাশের উপর আস্থার ভীতকে নাড়িয়ে দেয়। ইউএনবি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *