নিউইয়র্কে একটি কমিউনিটি সংবাদপত্রে টানা এগারো বছর কাজ করার সুবাদে সকল শ্রেনির প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগের সুযোগ ঘটেছে। তাদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদের অধিকাংশ বোঝাতে চান যে তারা বাংলা লিখতে ভুলে গেছেন। তারা বলেই ফেলেন, ‘বহু বছর যাবত আমেরিকায় আছি তো, বাংলাটা গুছিয়ে লিখতে পারি না।’ এটা শুধু আমেরিকায় থাকার দোষে কারণে নয়, বাংলাদেশে অনেক সচিব বা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানকেও দেখেছি তারা বাংলায় ডিকটেশন দিতে পারেন না। অধ:স্থনদের বিষয়বস্তু বলে নোট তৈরি করতে বলেন, এরপর ধাপে ধাপে সেটি ওপরে ওঠতে ওঠতে সচিব মহোদয়ের টেবিলে আসে এবং তিনি চোখ বুলিয়ে সন্তুষ্ট হলে আবার ধাপে ধাপে নিচে নামতে নামতে যখন সহকারী সচিবের টেবিলে ফিরে আসে তখন তিনি সেটি স্বাক্ষর করে জনস্বার্থে জারি করেন। বাংলাদেশেই যখন এই অবস্থা তখন প্রবাসে ‘দ্যাটস ইট,’ এর মধ্যে বাংলা চর্চা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া দোষনীয় কিছু নয়। ‘দ্যাটস ইট’ নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উল্লেখযোগ্য অংশের মুখে উচ্চারিত প্রিয় দুটি শব্দ। বাংলা ভাষার উদারতা আকাশসম এবং সেজন্য যেকোনো ভাষার শব্দ সহজে বাংলা ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। শুধু ভাষা কেন, কত জাতি, গোত্র, বংশ বাংলায় লীন হয়েছে, সেখানে ভাষা লীন হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: “হেথা আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন Ñ/শক-হুন-দল পাঠান-মোগল-এক দেহে হল লীন। ——- এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান/এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।”
এই যেখানে অবস্থা, সেখানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়। কিন্তু উৎসাহী মানুষের অভাব নেই। দেশের মত প্রবাসেও সাহিত্য চর্চায় ভাটা পড়েনি। বেশ কিছু সাহিত্য সংগঠন প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুলে ধরতে তৎপর। তারা নিয়মিত সাহিত্য অনুষ্ঠান করেন। মহান একুশে উপলক্ষে জাঁকজমতের সঙ্গে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেন। বহু বছর ধরে নিউইয়র্কে বার্ষিক বইমেলা আয়োজিত হয়ে আসছে, বাংলাদেশ থেকে অনেক প্রকাশক অংশগ্রহণ করেন। তখন দেশ থেকে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকরাও আসেন। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রবাসী সাহিত্যপ্রেমিকরাও সমবেত হন। কমিউনিটি সংবাদপত্রগুলোতে সাহিত্য পাতায় প্রবাসী কবি-লেখকদের লেখা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এসব অনুষ্ঠান ও সাহিত্যচর্চা ব্যাপকভাবে সেইসব বাংলাদেশীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, যারা দেশে থাকতেও কমবেশি সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ক্রমেই দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। কিছু প্রবাসী পরিবারে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা চর্চা শুধু কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যাদের অধিকাংশই বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না। অনেক বাংলাদেশী পরিবারে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের বাংলা উচ্চারণ ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ’ নাটকে ‘লর্ড ক্লাইভ’ অথবা ‘ওয়াটসন’ এর মুখে বাংলা ডায়ালগের মত: “হামরা বানিছ করিতে আসিয়াছে, হামরা বানিছ করিবে না কি নবাব কা ওয়াস্তে ঘোড়া কা ঘাস কাটিবে!” অথবা “এখানে টোমরা কী করিটেসে?” ইত্যাদি। বাংলা ভাষা ‘মোদের গরব মোদের আশা’ হলেও নতুন প্রজন্মের কাছে অদ্ভুত এক ভাষা। তাদের কাছে বাংলা বর্ণবাদী ভাষা, কারণ এই ভাষায় মানুষকে তাদের সামাজিক অবস্থান অনুসারে মর্যাদা দেওয়া হয়, ‘আপনি, তুমি, তুই,’ বলে সম্বোধনের মাধ্যমে। উপমহাদেশের সব ভাষায় এই বর্ণবাদের উপস্থিতি বিদ্যমান। এসব সম্বোধনের স্নেহ-ভালোবাসাসুলভ ব্যবহার যে নেই তা নয়, তবে বর্ণবাদী ব্যবহারই সর্বব্যাপী।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার ভাষার প্রশ্নে বিহার প্রদেশের দাবী মেনে নেয়ার জন্য স্কুলে দেবনাগরী হিন্দি চালু করার বিশেষ আদেশ দিয়েছিল। বাংলাভাষী মুসলমানরা তখন বাংলার পরিবর্তে ফারসিকে প্রাধান্য দিয়েছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও বিশেষ করে সুবে বাংলায় বিপদে পড়েছিল মোগল আমলের দেওয়ানি ও কর সম্পৃক্ত সবকিছু ছিল ফারসিতে। তারা কর আদায় ব্যাহত করতে ফারসি পরিবর্তন করেনি। তা না হলে বাংলা উপমহাদেশের শীর্ষ ভাষায় পরিণত হতে পারতো। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। তা হয়নি সম্ভবত বাংলা ভাষায় সমন্বয়ের সুযোগ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ বলে।
উপমহাদেশের ভাষাগুলোসহ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সকল ভাষায় লিঙ্গ আছে, রহস্যজনক কারণে বাংলা ভাষার কোনো লিঙ্গ নেই। ইংরেজিতে ‘হি,’ ‘হিম’ বললে পুরুষ, ‘শি’ ও ‘হার’ বললে নারী বোঝায়। বাংলা ভাষায় এটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ইউরোপ ও আমেরিকান ভাষাগুলোই শুধু নয়, উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষাগুলোতেও শুধু যে মানুষ ও প্রাণীর লিঙ্গ আছে তা নয়, জড়বস্তুরও পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ আছে। দিল্লিতে থাকাকালে বাসে যাতায়াত করতাম, প্রথম দিকে সব বাস রুট জানা ছিল না। বাস স্টপেজে কোনো বাস থামলে বাসের জন্য অপেক্ষমান যাত্রীর কাছে জানতে চাইতাম, ‘ইয়ে বাস কাহা জায়েগা?’ যাত্রী আমার হিন্দি সংশোধন করে দিত: ‘জায়েগা নেহি, জায়েগি।’ অর্থ্যাৎ বাসটি স্ত্রীলিঙ্গ। যে শিখ ভদ্রলোকের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, তাদের দুই কন্যা কোথাও যাচ্ছে দেখে যদি জানতে চাইতাম, ‘কাহা জা রাহা হ্যায়,’ তারা শুধুরে দিত, ‘কাহা জা রাহি হ্যায়।’
এসব নিয়ে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী আমেরিকানরা আমার এক বাল্যবন্ধু, বহু বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত। তার সন্তানেরা আমাকে তাদের পিতার ‘বেষ্ট ফ্রেণ্ড’ বলে জানে। আমার সঙ্গে সাক্ষাতে উচ্ছসিত হয়, তারা আমার কাছে তাদের বাপের কৈশোর, যৌবন সম্পর্কে জানতে চায়; কোনো মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম ছিল কিনা জানতে চায়। আমার সঙ্গে ওরা ইংরেজি টানে বাংলায় কথা বলে। তাদের পিতা আমাকে বলেন যে ওরা আমার সঙ্গে কথা বললেও ওদের মধ্যে দ্বিধা কাজ করে যে আমাকে ‘তুমি’, না ‘আপনি’ বলবে। কোন্টা আমার ক্ষেত্রে বেশি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট! আমি ওদের আশ্¦স্ত করি, কোনোটাতেই আমি কিছু মনে করবো না। এরপরও ওরা ‘আপনি’ ‘তুমি’তে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আরও বিপদ আছে, বাংলাভাষীরা সবকিছু খায়: ভাত খায়, পানিও খায়। কোনোকিছু পান করে না: মদ-বিড়ি-গাঁজা সবকিছু খায়। যেসব সমাজে সকল তরল বস্তু এবং আগুন জ্বালিয়ে টানলে ধুঁয়া নির্গত হওয়ার বস্তু পান করা হয়, তারা বাঙালিদের পানি ও বিড়ি সিগারেট খাওয়ার কথা শুনে হা করে থাকে। একটি জাতি শুধু খেয়ে এবং কোনোকিছু পান না করে কীভাবে টিকে থাকে?
প্রবাসে বাংলা চর্চা নবাগত বাঙালিদের মধ্যে সীমিত আকারে সীমিত থাকবে। কারণ বাংলা ভাষায় কথা জনসংখ্যার বিচারে তা উল্লেখযোগ্য হলেও বিশ্বে বাংলা ইংরেজির মত প্রভাবশালী ভাষা হয়ে ওঠতে পারেনি। আমাদের নেতারা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এসে বাংলায় বক্তৃতা দেন এবং এটিকে জাতির অর্জন ও ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে দাবী করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান জাতিসংঘে নিজেদের জাতীয় ভাষায় বক্তৃতা দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, জাতির জন্য অহঙ্কার বলেও মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো দেশ যদি চায় যে তাদের প্রতিনিধি জাতীয ভাষায় বক্তৃতা করবেন, তাহলে তাদেরকে নিজেদের দোভাষী নিয়োগ করতে হয় অথবা জাতিসংঘের ছয়টি অফিসিয়াল ভাষা আরবি, চাইনিজ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রুশ ও স্পেনিশ ভাষার মধ্যে কোনো একটি অফিসিয়াল ভাষায় বক্তৃতার অনুবাদ সরবরাহ করতে হয়। বলা যায়, এটি একটি রুটিন প্রক্রিয়া।
একটি ভাষা তখনই মানুষকে আকৃষ্ট করে যখন তারা একই সঙ্গে সেই ভাষার সৌন্দর্য ও উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারে। আমাদের অংশের পৃথিবী থেকে মানুষ আমেরিকায় আসে মুখ্যত অর্থ উপার্জন করতে, এবং দ্বিতীয়ত নিরাপদে বসবাস করতে এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। পাশ্চাত্যের যেকোনো দেশের মত যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থ উপার্জনে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কারও ফুরসত মেলে না। অনেকে ঠিকমত ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পায় না। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। অন্যকিছু করার সুযোগ কোথায়? ভাষাই বা শিখবে কখন? শিল্প-সাহিত্যের মত সৃজনশীল কাজে অর্থ নেই। আমেরিকার মত দেশে ‘অর্থই সকল সুখের মূল।’ তাই অর্থ ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না। পিতা তাঁর সন্তানকে কোনো কাজের দায়িত্ব দিলে সন্তান ঘন্টা হিসাব করে। এমন পরিবেশ মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রকাশের অনুকূল নয়। যারা লেখার মানুষ, তারা যেখানেই থাকবেন তাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশের জন্য লিখে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমেরিকায় বসে খুব কম সংখ্যক লেখকের পক্ষে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখকদের মানে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে আরও কম হবে। কারণ নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী আমেরিকানদের মধ্যে যদি দু’চার জন্য সাহিত্যের জগতে বিচরণ করতে আসেন, তারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে কতটুকু মাথা ঘামাবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।